অর্গানন অব মেডিসিন: সূত্র-১৭২ থেকে ২৪৪ পর্যন্ত।

ডি.এইচ.এম.এস (ডিপ্লোমা) কোর্সঃ ৩য় বর্ষের সিলেবাসঃ ১ম পর্ব।
(২৫) এক দৈশিক চিররোগ সমূহ (সূত্র-১৭২-১৭৩)
#সূত্রঃ ১৭২। রোগ লক্ষণের অত্যন্ত স্বল্পতা হেতু আরোগ্যের পথে অনুরূপ অসুবিধা ঘটিয়া থাকে। ইহা এমন একটি অন্তরায় যাহা আমাদের বিশেষ মনোযোগের বিষয় । কারণ ইহা দূরীভূত হইলে সম্ভাব্য চিকিৎসাপদ্ধতি সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পূর্ণাঙ্গ এই চিকিৎসা প্রণালী ( যেখানে ইহার যন্ত্র স্বরূপ পরিচিতি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এখনও অসম্পূর্ণ সে ক্ষেত্র ছাড়া) পথে অবস্থিত সকল অন্তরায় দূরীভূত হইবে।
#সূত্রঃ ১৭৩। সেই সকল রোগ, যাহাতে লক্ষণ খুব কমই দেখা যায় এবং সেইজন্য দুশ্চিকিৎস্য তাহাকে একতরফা ব্যাধি (one-sided diseases) বলা হয়। ঐ সকল রোগে মাত্র দুই একটি প্রধান লক্ষণ দেখা গেলেও বাকি লক্ষণগুলি ঢাকা থাকে । সেইগুলি প্রধানত চিররোগের পর্যায়ভুক্ত ।
(২৬) স্থানীয় রোগ এবং চিকিৎসা (সূত্র-১৭৪-২০৩)
#সূত্রঃ ১৭৪। তাহাদের প্রধান লক্ষণ হয়তো কোন একটি অভ্যন্তরীণ উপসর্গ লইয়া ( যেমন, বহু বৎসরের মাথাধরা, অনেকদিনের উদরাময়, পুরাতন হৃদশূল প্রভৃতি), আর নয়তো বহিরাঙ্গিক কোন পীড়া। শেষোক্ত পীড়া কে সাধারণত স্থানীয় ব্যাধি (local maladies) নামে চিহ্নিত করা হয় ।
#সূত্রঃ ১৭৫। প্রথম প্রকারের একতরফা যে রোগ তাহার মূলে হইল চিকিৎসকের অন্তর্দৃষ্টির অভাব এবং যে সকল লক্ষণ প্রকৃতই রহিয়াছে এবং যেগুলির সাহায্যে তাঁহার পক্ষে রোগের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব সেগুলিকে সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কার করিতে না পারা।
#সূত্রঃ ১৭৬। তথাপি অল্প সংখ্যক এমন কয়েকটি রোগ আছে যেগুলি খুব সযত্ন প্রাথমিক পরীক্ষার অন্তে (সূত্র ৮৪-৯৮) মাত্র দুই একটি তীব্র প্রচন্ড লক্ষণ দেখা যায়; বাকিগুলি অস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
#সূত্রঃ ১৭৭। এরূপ ক্ষেত্র যদিও খুব বিরল তথাপি খুব সফলতার সহিত ইহার চিকিৎসা করিতে হইলে আমাদিগকে প্রথমত সেই কয়েকটি লক্ষণ ধরিয়া সেই ওষুধটি নির্বাচন করিতে হইবে যেটি আমাদের বিবেচনায় সর্বাপেক্ষা সদৃশ।
#সূত্রঃ ১৭৮। ইহারা নিঃসন্দেহে কখনও কখনও এ রূপ ঘটে যে, ঠিক হোমিওপ্যাথিক নিয়মে নির্বাচিত সেই ওষুধটি বর্তমান রূপটি কে ধ্বংস করিবার উপযোগী একটি সদৃশ কৃত্রিম রোগ যোগাইয়া দিতে পারে। এইরূপ ঘটা আরও সম্ভবপর হয় যখন এই প্রকার স্বল্প কয়েকটি পীড়ার লক্ষণ স্পষ্ট, নিশ্চিত, অসাধারণ এবং যথাযথ পরিচয়জ্ঞাপক হয় ।
#সূত্রঃ ১৭৯। তথাপি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রথম নির্বাচিত ঔষধ এরূপস্হলে আংশিকভাবে উপযোগী হয় অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গভাবে হয় না, কারণ ঠিক নির্বাচনের পথপ্রদর্শক বেশি লক্ষণ তাহাতে থাকে না ।
#সূত্রঃ ১৮০। এই স্তরে যথাসম্ভব সঠিক ভাবে নির্বাচিত, কিন্তু উল্লেখিত কারণে অসম্পূর্ণভাবে সদৃশ ঔষধ তাহার আংশিক সদৃশ রোগের উপায় ক্রিয়ায়—যেমন উল্লিখিত ক্ষেত্রে (সূত্র ১৬২ ও অন্যান্য) যেখানে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের সংখ্যা সীমাবদ্ধ বলিয়া পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন সম্ভব হয় না— অতিরিক্ত লক্ষণ প্রদান করে এবং নিজ লক্ষণ শ্রেণী হইতে উদ্ভূত কয়েকটি অবস্থা রোগীর অবস্থার সহিত যুক্ত হয়। সেইগুলি কিন্তু রোগেরই নিজস্ব লক্ষণ, যদিও ইতোপূর্বে সেগুলি কদাচিৎ দেখা গিয়েছে একেবারেই প্রতীয়মান হয় নাই। কতকগুলি লক্ষণ দেখা দেয় যেগুলি রোগী পূর্বে কখনো অনুভব করে নাই কিংবা অপর কতকগুলি যাহা কেবল অস্পষ্টভাবে অনুভূত হইয়াছিল তাহা অধিকতর স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
#সূত্রঃ ১৮১। ঐ অতিরিক্ত এবং রোগের সদ্যপ্রকাশিত নতুন লক্ষণাবলী সেই ঔষধ প্রয়োগের ফলে ঘটিয়েছে এই রূপ ধরিয়া লইলে আপত্তির কিছু নাই। সেইগুলি যে ঔষধ হইতে উদ্ভূত তাহা নিশ্চিত। কিন্তু সেইগুলি সর্বদা সেই প্রকারেরই লক্ষণ যাহা সেই রোগ নিজে সেই দেহে উৎপাদন করতে পারে এবং প্রযুক্ত ওষুধের সদৃশ লক্ষণ উৎপন্ন করিবার ক্ষমতা আছে বলিয়া তাঁহার সেই সকল লক্ষণকে আনিয়া তাহাদিগকে প্রকাশিত হতে বাধ্য করে। এক কথায়, অধুনা প্রতীয়মান সমগ্র লক্ষণ সমষ্টিকে রোগেরই নিজস্ব এবং তাহাকে তৎকালীন বাস্তব অবস্থা বলিয়া ধরিয়া লইয়া তদনুসারে আমাদের পরবর্তী চিকিৎসা পরিচালিত করিতে হইবে।
#সূত্রঃ ১৮২। ঔষধের অসম্পূর্ণ নির্বাচন—যাহা এই ক্ষেত্রে লক্ষণের স্বল্পতা হেতু তাই অবশ্যম্ভাবী—এইরূপে রোগ লক্ষণের পূর্ণ প্রকাশে সহায়তা করে এবং এই উপায় ও অধিকতর উপযুক্ত দ্বিতীয় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের আবিষ্কার সহজ করিয়া দেয় ।
#সূত্রঃ ১৮৩। সেই জন্য যখনই প্রথম ঔষধের মাত্রা আর কাজ না করে (যদি নুতন আবির্ভূত লক্ষণসমূহ এর গুরুত্ব হেতু দ্রুত সাহায্যের প্রয়োজন না হয় যাহা হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অতি ক্ষুদ্র মাত্রার জন্য এবং সুদীর্ঘ একান্ত বিরল) তখনই আবার নূতন করিয়া রোগ পরীক্ষা করিয়া তখনকার রোগের অবস্থা লিপিবদ্ধ করিতে হইবে এবং তদনুসারে একটি দ্বিতীয় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, যাহা তখনকার অবস্থার ঠিক উপযুক্ত, নির্বাচন করিতে হইবে। এই অবস্থায় লক্ষণসমূহ সংখ্যাই অধিক এবং পূর্ণাঙ্গ হওয়ায় অধিকতর উপযোগী ঔষধ তখন পাওয়া যায়।
#সূত্রঃ ১৮৪। এইরূপ ভাবে ঔষধের প্রত্যেকটি নতুন মাত্রার ক্রিয়া শেষ হইলে যখন তাহার উপযোগিতা ও উপকারিতা আর থাকে না, তখন রোগের বাকি অবস্থার অবশিষ্ট লক্ষণগুলি আবার নূতন করিয়া লিখিতে হইবে এবং তখনকার প্রতীয়মান লক্ষণগুলি এর জন্য যতদূর সম্ভব উপযোগী আরেকটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ অনুসন্ধান করিতে হইবে। যতদিন আরোগ্য সম্পূর্ণ না হয় ততদিন এই ভাবে চলিতে হইবে।
#সূত্রঃ ১৮৫। একতরফা ব্যাধিসমূহের মধ্যে তথাকথিত স্থানীয় ব্যাধিগুলি একটি প্রধান স্থান অধিকার করে আছে; যে সকল পরিবর্তন এবং পীড়া দেহের বহির্ভাগে দেখা যায় সেই গুলিকে এই আখ্যা দেওয়া হয়। এই পর্যন্ত শিক্ষালয় এই ধারণাই চলিয়া আসিতেছে যে, এই সকল অংশই কেবল পীড়িত, দেহের বাকি অংশের সহিত পীড়ার কোন যোগ নাই। অনুমানসাপেক্ষ এই অসঙ্গত মতবাদ অত্যন্ত বিপজ্জনক চিকিৎসা পদ্ধতির প্রবর্তন করিয়াছে।
#সূত্রঃ ১৮৬। তথাকথিত ঐ সকল স্থানীয় ব্যাধি যেগুলি কিছুকাল আগে মাত্র বাহ্যক্ষত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে সেই গুলিকে তবুও প্রথম দিষ্টিতে স্হানীয় ব্যাধি নাম দেওয়া চলে। সেই ক্ষেত্রে কিন্তু ঐ ক্ষত নিশ্চয়ই অত্যন্ত তুচ্ছ এবং তেমন কিছু গুরুতর নহে কারণ বাহির হইতে যে আঘাত দেহের উপর লাগে তা যদি প্রচন্ড হয় তাহলে সমগ্র জীবসত্তা সমবেদনা প্রকাশ করে, জ্বরাদি লক্ষণ দেখা দেয়। এই প্রকার ব্যাধির চিকিৎসা অস্ত্রোপচারের বিধানে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়, আক্রান্ত স্থানে যতোটুকু বাহ্য প্রতিকার প্রয়োজন ঠিক ততটুকুর জন্য। তাহাতে যে আরোগ্য হয়—-যাহা কেবল জীবনী-শক্তির ক্রিয়াশীলতার ভিতর দিয়াই আশা করা যায়—তাহার পথে যে বাহ্য বাধাসমূহ থাকে তাহা স্হূল উপায়ে দূর করা হয় যেমন, সন্ধিচ্যূত স্থানের পুনঃসংযোগ, সেলাই ও ব্যান্ডেজের সাহায্যে ক্ষতের মুখগুলিকে জোড়া লাগানো, বাহির হইতে চাপ দিয়া উন্মুক্ত ধমনীতে রক্ত স্রাব বন্ধ করা, দেহের কোন অংশে কিছু বিধিয়া থাকিলে তাহা টানিয়া বাহির করা, দেহের ভিতরে কোন গহ্বরে প্রদাহকর পদার্থ থাকিলে তাহা বাহির করিয়া দিবার জন্য প্রস্তুত করিয়া দেওয়া, সঞ্চিত রস বা তরল পদার্থ নিঃসারণ করা, ভগ্নাস্তির প্রান্ত গুলিকে সংযুক্ত করা এবং যথোপযুক্ত ব্যান্ডেজের সাহায্যে সেই গুলিকে যথাস্থানে রক্ষা করা প্রভৃতি। কিন্তু এই প্রকার আঘাতে সমগ্র জীবসত্তা যখন আরোগ্য কার্য সমাধানের জন্য জীবনীশক্তির সূকক্রিয়ার প্রয়োজন বোধ করে, জাহা সে সর্বদাই ভূত করিয়া থাকে, যেমন বিস্তৃতভাবে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া, পেশি, শিরা, ধমনী ছিড়িয়া গিয়া প্রবল জ্বড় দেখা দিলে অভ্যন্তরীক ঔষধ প্রয়োগে যখন তাহা দূর করিবার দরকার হয় বা যখন ঝলসানো বা দগ্ধস্হানের বাহ্ যন্ত্রণা হোমিওপ্যাথিক মতে প্রশমিত করা হয়, তখন সূক্ষ্ম শক্তিতত্ত্বপন্থী চিকিৎসকের সেবা এবং তাহার সাহায্যকারী হোমিওপ্যাথির প্রয়োজন উপস্থিত হয়।
#সূত্রঃ ১৮৭। কিন্তু বহিরঙ্গে প্রকাশমান ঐসকল ভোগ পরিবর্তন এবং পীড়া বাহ্য আঘাত হইতে উৎপন্ন না হইলে কিংবা সামান্য মাত্র বাহ্য আঘাত তাহাদের উত্তেজনার অব্যবহিত কারণ হইয়া থাকিলে সেইগুলি উদ্ভূত হয় সম্পূর্ণ অন্য প্রকারে। আভ্যন্তরিক কোন ব্যাধি হইলে তাহাদের উৎপত্তিস্থল। সেইগুলিকে কেবল স্থানীয় ব্যাধি বলিয়া ধরা এবং সেই সঙ্গে কেবল অস্ত্রোপচারের সাহায্য পাই সেই রূপে স্থানীয় প্রলেপ কিংবা সেই জাতীয় ঔষধ দ্বারা সেইগুলির চিকিৎসা করা—যাহা পুরাতন চিকিৎসা পন্থিগণ বহু যুগ হইতে করিয়া আসিতেছেন— যেমন অযৌক্তিক তেমনি অনিষ্টকর তাহার ফল।
#সূত্রঃ ১৮৮। এই সকল ব্যাধিকে কেবলমাত্র স্থানীয় বলিয়া ধরা হইত এবং সেইজন্য সেইগুলিকে স্থানীয় ব্যাধি আখ্যা দেওয়া হইত, যেন সেই গুলি কেবলমাত্র ঐ সকল স্থানে সীমাবদ্ধ, তাহার সহিত জীবদেহের সম্পর্ক যেন অল্পই কিংবা একেবারেই নাই। ঐ সকল বিশেষ সুস্পষ্ট অংশের পীড়া সম্বন্ধে জীবদেহের বাকি অংশ যেন কোন খবরই রাখে না।
#সূত্রঃ। ১৮৯। তথাপি অতি অল্প চিন্তা করিলেই ইহা বুঝা যাইবে যে, কোন বাহ্যিক রোগ (যদি তাহা বাহিরের আঘাতজনিত না হয়) উৎপন্ন হইতে পারে না, টিকিয়া থাকিতে পারে না, এমনকি অধিকতর মন্দাবস্থার দিকে যাইতে পারে না যদি না কোন আভ্যন্তরীক কারণ থাকে এবং যদি না সমগ্র জীবসত্তা অসুস্থ থাকার ফলে সহানুভূতিশীল হয়। ইহার উদ্ভব আদৌ সম্ভব পর হইতে না যদি বাকি স্বাস্থ্য তাহা সমগ্রভাবে অনুমোদন না করিত এবং জীবসত্তার বাকি অংশ (দেহের অনুভূতিশীল) তাহাতে অংশগ্রহণ না করিত । বস্তুত দেহের সকল অংশ অনুভূতি ও ক্রিয়ার দিক দিয়া এমন ঘনিষ্ঠ ও একাত্ম ভাবে পরস্পর গ্রথিত যে সমগ্র জীবদেহের ( বিশৃঙ্খলাপ্রাপ্ত) সাহায্য ব্যতীত কে হার উদ্ভব সম্বন্ধে ধারণা করা অসম্ভব’। ঠোঁটের উপর কোন উদ্ভিদ, আঙ্গুলহাড়া কখনই প্রকাশিত হইতে পারে না যদি পূর্ব হইতে এবং তৎকালীন আভ্যন্তরিক অসুস্থতা বিদ্যমান না থাকে।
#সূত্রঃ ১৯০। অতএব, বহিরঙ্গে প্রকাশিত যে রোগ বাহিরের অল্প আঘাতে কিংবা কোন আঘাত ব্যতীত উৎপন্ন হইয়াছে তাহার প্রকৃত চিকিৎসা ন্যায়সঙ্গতভাবে, নিশ্চিতরূপে, সাফল্যের সহিত এবং সম্পূর্ণভাবে করিতে হইলে তাহা সমগ্র সত্তার উপর পরিচালিত করিতে হইবে যাহাতে আভ্যন্তরিক ঔষধ প্রয়োগে সর্বাঙ্গীণ ব্যাধি ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া আরোগ্য সাধিত হয়।
#সূত্রঃ ১৯১। ইহা সন্দেহাতীতভাবে অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত হইয়াছে যে, সকল ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি বলশালী ঔষধ আভ্যন্তরিক প্রয়োগের পরেই এই প্রকার রোগীর সাধারণ স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়ন করে, বিশেষ করিয়া আক্রান্ত বহিরঙ্গে (সাধারণ চিকিৎসক মন্ডলী যাহাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলিয়া মনে করেন), এমনকি দেহের সম্পূর্ণ বহিরংশের তথাকথিত স্থানীয় ব্যাধিতেও। ইহা দ্বারা যে পরিবর্তন সাধিত হয় তাহা সমগ্র দেহের স্বাস্থ্যকে ফিরাইয়া আনে এবং সেইসঙ্গে বাহ্য ব্যাধি ও (কোন ব্যাহ্য ঔষধের সাহায্য ব্যতীত) তিরোহিত হয় বলিয়া তাঁহা পরম উপকারী, অবশ্য যদি সমগ্র অবস্থাকে লক্ষ্য করিয়া প্রযুক্ত আভ্যন্তরিক ঔষধ হোমিওপ্যাথিক মতে সঠিক নির্বাচিত হইয়া থাকে।
#সূত্রঃ ১৯২। ইহা সর্বাপেক্ষা ভালোভাবে সম্পূর্ণ করা যায় না যখন ঐ রোগ সম্বন্ধে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাধির ঠিক প্রকৃতি এবং রোগীর স্বাস্হ্যে যে সকল পরিবর্তন, যন্ত্রণা ও লক্ষণ দেখা যায় তাহা এবং ঔষধ ব্যবহার করিবার পূর্বে যেমন দেখা গিয়াছিল সেই সকল একত্রিত করিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রস্তুত করা যায়। যে সকল ঔষধের বিশেষ সামরিক লক্ষণ জানা আছে তাহাদের মধ্যে হইতে পরে লক্ষণ সমষ্টির সদৃশ এমন একটি অনুসন্ধান করা যায় যাহার নির্বাচন ঠিক হোমিওপ্যাথি সম্মত ।
#সূত্রঃ ১৯৩। কেবলমাত্র এই ওষুধের আভ্যন্তরিক প্রয়োগ দ্বারা দেহের সাধারণ রুগ্নাবস্হার সহিত স্থানীয় ব্যাধি দূরীভূত হয়। পূর্বেরটির সঙ্গে পরেরটি ও একই সময়ে সারিয়া যায়। তাহা হইতে প্রমাণিত হয় যে স্থানীয় পীড়া দেহের বাকি অংশের ব্যাধির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল এবং সেইজন্য তাহাকে সমগ্রের সহিত অবিচ্ছিন্ন এবং সমগ্র ব্যাধির সর্বপ্রধান গণনীয় বিশিষ্ট লক্ষণসমূহের অন্যতম বলিয়া ধরিতে হইবে।
#সূত্রঃ ১৯৪। নবাগত অচিররোগেই হোক কিংবা বহুদিন স্থায়ী স্থানীয় ব্যাধিতেই হউক না কোন বাহ্য ঔষধের মহৌষধি হইলেও এবং সদৃশ লক্ষণহেতু তাহা আভ্যন্তরিক প্রয়োগে হইলেও, আক্রান্ত স্থানে তাহার মর্দন বা বাহ্য প্রলেপের আবশ্যকতা নাই, এমনকি একই সময়ে তাহা আভ্যন্তরিক প্রয়োগ করা হইলেও নহে। কারণ সেই সকল অচির ও স্থানীয় ব্যাধি (যেমন, বিশেষ স্থানের প্রদাহ, ইরিসিপেলাস ) যাহাদের উদ্ভবের সহিত বাহ্য আঘাতের প্রচণ্ডতার ঠিক মিল নাই, আভ্যন্তরিক কোন সূক্ষ্ম কারণ হইতেই যাহা উদ্ভূত, তাহা পরীক্ষিত ঔষধসমূহের সাধারণ ভান্ডার হইতে নির্বাচিত সেই ওষুধের আভ্যন্তরিক প্রয়োগেই সুনিশ্চিতভাবে প্রশমিত হয়, যে ওষুধ বাহির ও ভিতরের প্রতীয়মান স্বাস্থ্য অবস্থার উপযোগী ও লক্ষণসদৃশ; সাধারণত অন্য কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই সকল রোগ যদি সেই ওষুধের কাছে সম্পূর্ণভাবে বশ্যতা স্বীকার না করে এবং পথ্যাদির সুব্যবস্থা সত্ত্বেও যদি আক্রান্ত স্থানের ও সমগ্র শরীরের স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধারে জীবনীশক্তির অক্ষমতায় অবশেষ থাকিয়া যায় তাহা হইলে সেই অচিররোগ ( যাহা প্রাই ঘটে) সোরাবীজের ফল, যাহা এযাবৎকাল ভিতর লুকাইয়াছিল, কিন্তু এখন প্রবলবেগে বাহির হইয়া স্পষ্ট চিররোগে পরিণত হইতে চলিয়াছে।
#সূত্রঃ ১৯৫। এই সকল রোগকে- যাহা মোটেই বিরহ নহে- নির্মূল করিতে হইলে তাহাদের আক্রমণের প্রথম বেগ অনেকটা কমিয়া গেলে অবশিষ্ট লক্ষণের এবং রোগীর পূর্বের রুগ্নাবস্থার প্রতিকারের জন্য যথোচিত সোরাবিষঘ্ন চিকিৎসা ( আমার ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থের উপদেশ অনুসারে ) করিয়া যাওয়া অবশ্যই প্রয়োজন । যে সকল পুরাতন স্থানীয় ব্যাধি স্পষ্টতই যৌন কারণ হইতে উৎপন্ন নহে তাহাদের জন্য সোরাবিষঘ্ন আভ্যন্তরিক চিকিৎসারই একমাত্র প্রয়োজন।
#সূত্রঃ ১৯৬। বস্তুত ইহা মনে হইতে পারে যে, লক্ষণসমূহ অনুসারে যথার্থ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শুধু আভ্যন্তরিক প্রয়োগে নহে তৎসহ ভাজ্য প্রয়োগে এইরূপ রোগসমূহের আরোগ্য সম্পাদন ত্বরান্বিত হইবে, কারণ রোগের স্থানে ওষুধের প্রলেপ লাগাইলে তাহার ক্রিয়া রোগের দ্রুত পরিবর্তন সাধন করে।
#সূত্রঃ ১৯৭। সোরাবীজ হইতে উদ্ভূত স্থানীয় ব্যাধি সম্পর্কেই শুধু নয়, সিফিলিস ও সাইকোসিসবীজ হইতে উৎপন্ন ঐ প্রকার ব্যাধি সম্বন্ধেও এই প্রকার চিকিৎসা সমর্থন করা যায় না কারণ, কোন স্থায়ী স্থানীয় ব্যাধিই যেখানে প্রধান লক্ষণ, সেখানে কোন ওষুধের বাহ্য ও আভ্যন্তরিক প্রয়োগ একই সঙ্গে করার বড় অসুবিধা এই যে, এরূপ বাহ্য প্রয়োগের ফলে প্রধান লক্ষণটি ভিতরের ব্যাধি অপেক্ষা দ্রুত লোপ পায় এবং তখন সারিয়া গিয়াছে বলিয়া আমরা প্রতারিত হয়; অথবা অন্তত স্থানীয় লক্ষণটি অকালে অন্তর্হিত হওয়ায় এই একই সময়ে যে আভ্যন্তরিক ওষুধ প্রয়োগ করা হইয়াছিল তদ্দ্বারা সমগ্র ব্যাধি বিনষ্ট হইল কিনা তাহা নির্ণয় করা কেবল কঠিন তাহাই নহে কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্ভব।
#সূত্রঃ ১৯৮। সেবন করা হইলে যে সকল ঔষধ আরোগ্যদানে সমর্থ, চিররোগবীজজাত ব্যাধির বাহ্য লক্ষণে সেগুলির কেবলমাত্র স্থানীয় প্রয়োগ সেই কারণে একেবারেই সমর্থনযোগ্য নহে। কারণ চিররোগের স্থানীয় লক্ষণটি যদি কেবল স্থানীয় এবং একতরফাভাবে অপসারিত হয়, তাহা হইলে আভ্যন্তরিক চিকিৎসা যাহা স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য তাহা সংশয়ের দুর্বোধ্যতায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে। প্রধান লক্ষণটি ( স্থানীয় ব্যাধি) চলিয়া গেলে থাকে কেবল বিশেষত্বহীন সেই লক্ষণগুলি যেগুলি স্থানীয় ব্যাধি অপেক্ষা কম অপরিবর্তনীয় ও কম স্থায়ী এবং যাহা প্রায়ই অসাধারণত্ববর্জিত বলিয়া রোগচিত্রের স্পষ্ট ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পরিচয়ের লক্ষণরূপে অত্যন্ত দুর্বল।
#সূত্রঃ ১৯৯। যথাযথ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আবিষ্কৃত হইবার পূর্বে যখন স্থানীয় লক্ষণগুলি ক্ষয়িষ্ণু, শোষক প্রভৃতি ঔষধের বাহ্য প্রয়োগে কিংবা অস্ত্রোপচারে বিনষ্ট করা হইত তখন অবশিষ্ট লক্ষণগুলি অত্যন্ত অস্পষ্ট ও পরিবর্তনশীল থাকায় রোগ আরো বেশি দুঃসাধ্য হইয়া পড়িত। কারণ ঠিকমত ঔষধ নির্বাচন এবং যে পর্যন্ত রোগটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত না হয় সে পর্যন্ত ওষুধটির আভ্যন্তরিক প্রয়োগ করিবার নির্দেশ যেসকল লক্ষণ হইতে পাওয়া যাইত, অর্থাৎ বাহিরের প্রধান লক্ষণ, তাহাকে আমাদের দৃষ্টিবহির্ভূত করা হইয়াছে।
#সূত্রঃ ২০০। আভ্যন্তরিক চিকিৎসার জন্য তখনো যদি উহা বিদ্যমান থাকিত তাহা হইলে সমগ্র ব্যাধির জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খুঁজিয়া বাহির করা যাইতে পারিত এবং তাহা পাওয়া যাইলে স্থানীয় ব্যাধির অস্তিত্ব হইতে বুঝা যাইতো যে আরোগ্য সম্পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু উহা যথাস্থানে থাকিয়া আরোগ্যলাভ করিলে নিঃসংয়ভাবে প্রমানিত হইত যে রোগটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হইয়াছে এবং সমগ্র রোগ হইতে ঈপ্সিত আরোগ্যপ্রাপ্তি পূর্ণভাবে সাধিত হইয়াছে । পূ্র্ণ আরোগ্যপ্রাপ্তির পক্ষে ইহাই হইলো অমূল্য ও অপরিহার্য উপায়।
#সূত্রঃ ২০১। ইহা স্পষ্ট যে মানুষের জীবনীশক্তি যখন চিররোগগ্রস্থ হয়, যাহাকে উহা সামাজিকভাবে নিজ ক্ষমতায় পরাভূত করিতে অসমর্থ, তখন তাহা দেহের উপরে কোথাও একটি স্থানীয় ব্যাধি উদ্ভবের ব্যবস্থা করে কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যে যে, যে অংশটি জীবনের পক্ষে অপরিহার্য নহে তাহাকে অসুস্থ করা এবং অসুস্থ অবস্থায় রাখা যাহাতে আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে প্রশমিত রাখা যায় যাহা অন্যথায় জীবনরক্ষক যন্ত্রসমূহকে ধ্বংস করেছে ( এবং রোগীর প্রাণনাশ করিতে ) পারে। বলিতে গেলে উহা আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে প্রতিনিধিরূপে স্থানীয় ব্যাধিতে রূপান্তরিত করিয়া তথায় আকর্ষণ করিয়া রাখে। এই স্থানীয় পীড়ার উপস্থিতি কিছুকালের জন্য আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে দমন করিয়া রাখে, যদিও তাহাকে নিরাময় করিতে বা হ্রাস করিতে পারেনা। স্থানীয় রোগ সমগ্র ব্যাধির অংশ ব্যতীত কিছুই নহে, কিন্তু সেই অংশ জীবনীশক্তি কর্তৃক কেবল একমুখী বর্ধিত অবস্থা- আভ্যন্তরিক পীড়ার প্রশমনার্থে যাহা দেহের কম মারাত্মক স্থানে ( বাহিরে ) স্থানান্তরিত হয় মাত্র। কিন্তু ( যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে ) এই স্থানীয় লক্ষণ আভ্যন্তরিক ব্যাধির প্রশমন করিলেও সমগ্র ব্যাধির হ্রাস বা আরোগ্যকল্পে জীবনীশক্তির কিছুই লাভ হয় না। অপরপক্ষে তাহা সত্ত্বেও আভ্যন্তরিক ব্যাধি ক্রমশ বাড়িয়াই চলে এবং প্রকৃতিও স্থানীয় লক্ষণকে অধিক হইতে অধিকতর বিস্তার ও বর্ধিত করিতে বাধ্য হয় যাহাতে তাহা বর্ধিত আভ্যন্তরিক ব্যাধির পরিবর্তে যথেষ্টভাবে বিদ্যমান থাকিয়া তাহাকে দমন করিয়া রাখিতে পারে ।আভ্যন্তরিক সোরা যতদিন না আরোগ্যপ্রাপ্ত হয় ততদিন পায়ের ক্ষত খারাপের দিকে চলে, আভ্যন্তরীণ সিফিলিস আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত স্যাঙ্কার বাড়িয়াই চলে, ডুমুরাকৃতি অর্বুদসমূহ সাইকোসিস আরোগ্য প্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত বৃদ্ধি পাইতে ও উৎপন্ন হইতে থাকে; তাহার ফলে শেষোক্তটির আরোগ্যলাভ অধিকতর কঠিন হইয়া পড়ে, কারণ কালক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে আভ্যন্তরিক পীড়াও বাড়িয়া চলে।
#সূত্রঃ ২০২। সমগ্র ব্যাধি সারিয়া যাইবে এই বিশ্বাসে এখন যদি পুরাতন পন্থী চিকিৎসক বাহ্য ঔষধ প্রয়োগে স্থানীয় লক্ষণকে নষ্ট করেন তাহা হইলে আভ্যন্তরিক ব্যাধি এবং অন্যান্য লক্ষণ যাহা পূর্ব হইতে স্থানীয় লক্ষণের পাশাপাশি সুপ্ত অবস্থায় ছিল সেইগুলিকে জাগরিত করিয়া প্রকৃতি তাহার ক্ষতিপূরণ করে, অর্থাৎ আভ্যন্তরিক ব্যাধিকে বাড়াইয়া তোলে। যখন এই রূপ ঘটে তখন ইহা বলা হয়, যদি ভুলক্রমে, স্থানীয় ব্যাধিকে বাহ্য ওষুধ প্রয়োগে দেহাভ্যন্তরে কিংবা স্নায়ুযন্ত্রে ফেরত পাঠান হইয়াছে।
#সূত্রঃ ২০৩। এইরূপ স্থানীয় লক্ষণসমূহের প্রত্যেকটির ক্ষতিকর বাহ্য চিকিৎসা, যাহার উদ্দেশ্য হইল দেহের বহির্দেশ হইতে সেইগুলিকে দূর করা, অথচ আভ্যন্তরিক রোগবীজকে অচিকিৎসিত অবস্থায় ফেলিয়া রাখা, যেন নানাপ্রকার মলম-প্রয়োগে সোরাবীষজাত উদ্ভিদকে অপসারিত করা, কস্টিক দ্বারা উপদংশ ক্ষতকে পোড়াইয়া ফেলা, অর্বুদ গুলিকে তাহাদের স্থান হইতে ছুরিকা দ্বারা বন্ধনী বা উত্তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা ধ্বংস করা- এযাবৎকাল এরূপ ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হইয়া আসিতেছে যে তাহা মানবের যন্ত্রণাদায়ক পরিচিত-অপরিচিত সকল প্রকার চিররোগের মূল কারণ। ইহা চিকিৎসাজগতের সর্বাপেক্ষা গর্হিত অপরাধমূলক অনুষ্ঠানসমূহের অন্যতম; তথাপি ইহা সাধারণভাবে এযাবৎ গৃহীত হইয়া আসিতেছে এবং শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ হইতে একমাত্র উপায় বলিয়া শিক্ষা দেওয়া হইতেছে।
(২৭) ক্রনিক রোগের চিকিৎসা (সূত্র-২০৪-২০৯)
#সূত্রঃ ২০৪। যে সকল চিররোগ দীর্ঘকালব্যাপী অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা হইতে উদ্ভূত এবং যে সকল অসংখ্য ব্যাধি যাহা প্রাচীনপন্থী চিকিৎসকগণ কর্তৃক তুচ্ছ রোগের অযৌক্তিক, পৌনঃপুনিক, বিরক্তিকর ও অনিষ্টজনক চিকিৎসা হইতে প্রায়ই উৎপন্ন, সেইগুলিকে বাদ দিলে যে চিররোগগুলি অবশিষ্ট থাকে তাহাদের অধিকাংশের মূল হইল তিনটি চিররোগজীব, আভ্যন্তরিক সিফিলিস, আভ্যন্তরিক সাইকোসিস এবং প্রধানত ও সর্বাপেক্ষা বহুল পরিমাণে আভ্যন্তরিক সোরা। প্রত্যেকটি নিজস্ব প্রাথমিক ও স্থানীয় লক্ষণ প্রকাশিত হইবার পূর্বে ( সোরার ক্ষেত্রে খোস পাঁচড়া, সিফিলিসের স্যাঙ্কার বা বাগী, সাইকোসিসের অর্বুদ ) ইহাদের প্রত্যেকটির সংক্রমণ পূর্ব হইতে সর্বদেহে বিদ্যমান থাকে ও সকল দিকে অনুপ্রবিষ্ট হয়। এই সকল চিররোগবীজঘটিত ব্যাধিসমূহের স্থানীয় লক্ষণগুলিকে যদি অপসারিত করা হয় তাহা হইলে শক্তিশালিনী প্রকৃতি কর্তৃক অনিবার্যভাবে বিকশিত হইয়া তাহারা শীঘ্র বা বিলম্বে সবেগে বাহির হইয়া পড়ে। তাহার ফলে নামহীন অগণিত দুঃখময় চিররোগ বিস্তার লাভ করিয়া শত সহস্র বৎসর ধরিয়া মানবজাতির যন্ত্রণার কারণ হইয়াছে। সেইগুলির একটিও পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইতে পারিত না যদি চিকিৎসকগণ যুক্তিযুক্তভাবে সেইগুলিকে নির্মূল করতে চেষ্টা করিতেন, যদি বাহ্যলক্ষণ অনুসারে স্থানীয় ঔষধ প্রয়োগ না করিয়া প্রত্যেকটির জন্য একমাত্র যথার্থ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের আভ্যন্তরিক প্রয়োগের উপর আস্থা রাখিয়া এই তিনটি রুক অফিসকে দেহাভ্যন্তরে বিনষ্ট করিতে পারিতেন।
#সূত্রঃ ২০৫। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক চিররোগবীজঘটিত প্রাথমিক লক্ষণসমূহের একটিকে ধরিয়া বা তাহাদের অধিকতর পরিণতিজনিত গৌণ রোগগুলির কোনটিকে লইয়া বাহ্য ওষুধ প্রয়োগে (এমনকি যে সকল বাহ্যবস্তু সূক্ষ্মভাবে কার্য করে তাহাদের দ্বারাও নহে, আবার যেগুলি স্থূলভাবে কার্যকরী তাহাদের দ্বারাও নহে ) কখনও চিকিৎসা করেন না। যে প্রধান রোগবীজকে অবলম্বন করিয়া যখন যেটি আবির্ভূত হয় সেই গুরুত্বপূর্ণ রোগবীজেরই তাহারা চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। তাহার ফলে সেটির প্রাথমিক ও গৌণ লক্ষণগুলি আপনা হইতেই তিরোহিত হয়। কিন্তু হায়! পূর্ববর্তী পুরাতনপন্থী চিকিৎসকগণ এই পন্থা অনুসরণ করেন নাই বলিয়া পরবর্তী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক দেখেন যে প্রাথমিক লক্ষণগুলিকে বাহ্য ওষুধ ব্যবহারের পূর্বেই নষ্ট করা হইয়াছে এবং তখন তাহাকে গৌণ লক্ষণ লইয়া বেশি কাজ করিতে হইবে। অর্থাৎ সেই সকল লক্ষণ লইয়া যেগুলি অন্তর্নিহিত রোগবীজের বহিঃস্ফূরণ ও বিকাশ হইতে উৎপন্ন, বিশেষত সেই সকল চিররোগ যাহা অন্তর্নিহিত সোরা উৎপন্ন এবং যাহাদের আভ্যন্তরিক চিকিৎসা, যাহা কোন চিকিৎসকের পক্ষে বহু বর্ষব্যাপি একক মননশীলতা, পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দ্বারা পরিস্ফুট হওয়া সম্ভব- তাহাই আমি আমার ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থে নির্দেশ দিবার চেষ্টা করিয়াছি। তাহা আমার পাঠকগণকে দেখিতে বলি।
#সূত্রঃ ২০৬। কোন চিররোগ চিকিৎসা শুরু করিবার পূর্বে বিশেষ সতর্কতার সহিত অনুসন্ধান করা আবশ্যক রোগীর কোন যৌনব্যাধি হইয়াছিল কিনা (কিংবা যে অর্বুদযুক্ত গনোরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছিল কিনা) তাহা হইলে, যখন কেবল সিফিলিসের লক্ষণ কিংবা বিরল ক্ষেত্রে অর্বুদযুক্ত রোগলক্ষণ বিদ্যমান থাকে তখন কেবল সেইদিকে লক্ষ্য করিয়া চিকিৎসা পরিচালিত করিতে হইবে, যদিও আজকাল এই রোগ এককভাবে কদাচিৎ দেখা যায়। এইরূপ সংক্রমণ যদি পূর্বে ঘটিয়া থাকে তাহা হইলে সোরাগ্রস্ত রোগীর চিকিৎসা করিবার সময়ে সে কথা মনে রাখিতে হইবে কারণ তাহার সহিত সোরা জড়িত থাকে এবং সেই সকল ক্ষেত্রে কেবল সিফিলিসের লক্ষণ পাওয়া যায় না। ইহার কারণ, চিকিৎসক যখনই কোনো পুরাতন যৌনব্যাধির রোগী পান তখনই তাহাকে সর্বক্ষেত্রে কিংবা প্রায়ই সিফিলিসরোগের সহিত সোরাযুক্ত রোগের চিকিৎসা করতে হয়, কারণ, আভ্যন্তরিক কন্ডুয়নপ্রবণতা ( সোরাবীজ ) অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিররোগসমূহের জনক। চিররোগগ্রস্ত দেহে কখনও কখনও উভয় রোগবীজই সাইকোসিস সঙ্গে জড়িত থাকিতে পারে, কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইরূপ প্রায় দেখা যায় যে সোরাই অন্যান্য রোগের একমাত্র মূল কারণ, নাম যাহাই হউক না। উপরন্তু সেইগুলির প্রায়ই এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অপটুতা হেতু ভীষণভাবে বিকৃত, বর্ধিত ও কদর্যরূপে পরিবর্তিত করা হয়।
#সূত্রঃ ২০৭। এই সকল বিষয় জানিবার পর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে আরো জানিতে হইবে যে সেই দিন অবধি ঐ চিররোগের কি প্রকার এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করা হইয়াছে, প্রধানত কি প্রকার বিকৃতিজনিত ঔষধ অধিক দিন ধরিয়া প্রয়োগ করা হইয়াছে, কি প্রকার খনিজ প্রস্রবণে স্নান করিয়াছে এবং তাহার ফলই বা কি হইয়াছে। এই সকল বিষয় দ্বারা রোগের মূল অবস্থা হইতে অবনতি কিছু পরিমাণে বুঝিয়ে পারা যাইবে। সম্ভবস্থলে এই সকল প্রক্রিয়ার অংশত সংশোধন করা যাইতে পারে কিংবা যে সকল ঔষধ পূর্বে অযথা ব্যবহার করা হইয়াছে সেইগুলো বর্জন করা যাইতে পারে।
#সূত্রঃ ২০৮। রোগীর বয়স, তাহার আহারবিহার, বৃত্তি, সাংসারিক পদমর্যাদা, সামাজিক আত্মীয়কুটুম্বিতা প্রভৃতি তারপর পর বিবেচনা করিতে হইবে। এইগুলি তাহার রোগ বৃদ্ধির কারণ কি না কিংবা উহা চিকিৎসার পক্ষে কতখানি সহায়ক বা প্রতিবন্ধক তাহা নির্ধারণ করা যাইতে পারে। এইরূপভাবে তাহার প্রকৃতি ও মানসিক অবস্থা সম্বন্ধেও মনোযোগী হইতে হইবে, যাহাতে বুঝিতে পারা যায় উহা চিকিৎসায় বাধাপ্রদান করিতেছে কি না বা তাহাকে পরিচালনা করা, উৎসাহ প্রদান করা অথবা নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়োজন আছে কি না।
#সূত্রঃ ২০৯। ইহা করা হইলে রোগীর সহিত পুনঃ পুনঃ কথাবার্তার ভিতর দিয়া চিকিৎসকে, পূর্ববর্ণিত নির্দেশ অনুসারে, যথাসম্ভব রোগের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কনের চেষ্টা করিতে হইবে, যাহাতে বিশিষ্ট পরিচায়ক লক্ষণগুলি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে উঠে। তদানুসারে তিনি প্রথম সোরাবিষঘ্ন কিংবা সদৃশতম অন্য কোন ঔষধ নির্বাচন করিয়া চিকিৎসা শুরু করিতে ও তাহা চালাইয়া যাইতে পারেন। সৃষ্টি করিয়া তাহা চালাইয়া যাইতে পারে।
(২৮) মানসিক ব্যাধি ও ইহার চিকিৎসা (সূত্র-২১০-২৩০)
#সূত্রঃ ২১০। পূর্বে যে সকল ব্যাধিকে একতরফা বলিয়া উল্লেখ করিয়াছি তাঁহাদের প্রায় সকলগুলিই সোরা হইতে উদ্ভূত। একতরফা লক্ষণের জন্য সেগুলিকে নিরাময় করা অপেক্ষাকৃত কঠিন ব্যাপার, একটিমাত্র প্রধান ও সুস্পষ্ট লক্ষণকে সম্মুখে রাখিয়া অন্য সব রোগলক্ষণ যেন অন্তর্হিত হয় । যেগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলা হয় সেগুলিও এই ধরনের। অন্যসব ব্যাধি হইতে পৃথক করিয়া তাহাদিগকে বিশেষ কোনো এক শ্রেনীভুক্ত বলিয়া গণ্য করা হয় না, কারণ তথাকথিত অন্যান্য শারীরিক ব্যাধিগুলিরও সকল ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও মনের অবস্থা পরিবর্তিত হয় এবং যে সকল রোগী চিকিৎসার জন্য আসে তাহাদের সকল ক্ষেত্রেই যদি একটি যথার্থ চিত্র অঙ্কিত করিয়া হোমিওপ্যাথিক মতে চিকিৎসা দ্বারা সাফল্য লাভ করিতে হয় তাহা হইলে রোগীর ধাতুপ্রকৃতি ও তৎসহ লক্ষণসমষ্টি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিতে হইবে।
#সূত্রঃ ২১১। ইহা এতদূর সত্য যে মুখ্যত রোগীর প্রকৃতিই অনেক সময়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচনে নির্দেশ প্রদান করে। কারণ, নিশ্চিতভাবে একটি পরিচারক লক্ষণ বলিয়া তাহা যথার্থ পর্যবেক্ষনকারী চিকিৎসকের নিকট সর্বাপেক্ষা কম লুক্কায়িত থাকিতে পারে।
#সূত্রঃ ২১২। রোগনিরাময়কারী বস্তুসমূহের স্রষ্টা ব্যাধিসমূহের প্রকৃতি ও মনের পরিবর্তনরূপ এই প্রধান বিষয়ের প্রতি বিশেষ মর্যাদা দান করিয়াছেন। কারণ জগতে এমন কোনো শক্তিশালী ভেষজ নাই যাহা পরীক্ষণকারী সুস্থ ব্যক্তির প্রকৃতি ও মনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধন না করিতে পারে। প্রত্যেকটি ঔষধই বিভিন্ন প্রণালীতে তাহা করিয়া থাকে।
#সূত্রঃ ২১৩। অতএব আমরা কখনই প্রকৃতির অনুগামী হইয়া অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক মতে আরোগ্য সাধন করিতে সমর্থ হইব না যদি আমরা প্রত্যেকে রোগীর ক্ষেত্রে, এমন কি অচিররোগেও অন্যান্য লক্ষণের সহিত মন ও প্রকৃতির পরিবর্তন সম্পর্কিত লক্ষণ পর্যবেক্ষণ না করি এবং যদি আমরা রোগীর আরোগ্যের জন্য ওষুধাবলীর মধ্য হইতে এমন একটি রোগ উৎপাদিকা শক্তি নির্বাচন না করি যাহা রোগের অন্যান্য লক্ষণের সহিত সদৃশ হওয়া ছাড়াও প্রকৃতি ও মনের ঠিক অনুরূপ অবস্থা উৎপন্ন করিতে পারে।
#সূত্রঃ ২১৪। মানসিক ব্যাধির আরোগ্যবিধান সম্পর্কে আমার যে উপদেশ দিবার আছে তাহা অল্পকথায় বলা যাইতে পারে যে, অন্যান্য রোগের মতোই তাহাদেরও একই প্রকার চিকিৎসাব্যবস্থা যথা, এমন একটি ঔষধ দ্বারা যাহার আর সুস্থ ব্যক্তির দেহে ও মনে রোগীর প্রায় সদৃশ পীড়া উৎপাদন করিবার শক্তি আছে। আর অন্য কোন উপায়েই আরোগ্য সম্ভব নহে।
#সূত্রঃ ২১৫। তথাকথিত মানসিক ও চিত্তাবেগ সম্পর্কিত প্রায় সকল রোগ শারীরিক ব্যাধি ছাড়া আর কিছুই নহে। ইহাতে প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য অনুসারে মন ও প্রকৃতিগত বিশৃংখলার লক্ষণই বড় হইয়া উঠে । দৈহিক লক্ষণগুলি ( অল্পাধিক দ্রুতভাবে ) কমিয়া যায় এবং অবশেষে তারা একতরফার বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয় । তখন তাহা যেন মন বা প্রকৃতির অদৃশ্য সূক্ষ্মযন্ত্রে একটি স্থানীয় ব্যাধি।
#সূত্রঃ ২১৬। এরূপ ক্ষেত্র বিরল নহে যেখানে তথাকথিত দৈহিক রোগ- যাহা মারাত্মকরূপে ভীতিজনক যেমন, ফুসফুসে পুঁজ জমা বা অন্য কোন প্রধানযন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা অচির প্রকৃতির অন্য কোন রোগ যেমন, প্রসবসম্বন্ধীয়- উন্মত্ততা, একরূপ বিষাদ অবস্থা বা একটা বাতিকে রূপান্তরিত হয় যেখানে পূর্ব হইতে কতকগুলি মানসিক লক্ষণ থাকে যাহার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে ও শারীরিক লক্ষণগুলির বিপদজ্জনক অবস্থা কাটিয়া যাই; পরে প্রায় পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করে বা লক্ষণগুলি এইরূপ পরিমাণে হ্রাস পায় যে তাহাদের প্রচ্ছন্ন অবস্থিতি কেবলমাত্র অধ্যবসায়শীল ও সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণেই ধরা পড়ে। এইভাবে সেগুলি একতরফা অবস্থায় এবং এমন একটি স্থানীয় ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয় যাহাতে মানসিক বিকৃতির লক্ষণ, যাহা পূর্বে অল্পই ছিল ক্রমশ বৃদ্ধি পাইয়া প্রধান লক্ষণরূপে প্রকাশিত হয় এবং বহুল পরিমানে অন্যান্য (শারীরিক) লক্ষণের তীব্রতাকে সাময়িকভাবে উপশমিত করিয়া তাহাদের স্থান অধিকার করিয়া বসে। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, দেহযন্ত্রের স্থূল পীড়াগুলি যেন সূক্ষ্ম মনোময় ক্ষেত্রে এবং আবেগপ্রধান যন্ত্রগুলিতে পরিচালিত হয়, যাহার সন্ধান শরীরস্থানবিদগণ তাহাদের ছুরিকার সাহায্যে এখনো পান নাই এবং কখনো পাইবেন না।
#সূত্রঃ ২১৭। এই সকল ব্যাধিতে দৈহিক লক্ষণ এবং আরও বিশেষ করিয়া মন ও প্রকৃতি ঠিকমতো বুঝিবার পক্ষে তাহার প্রধান লক্ষণের বৈশিষ্ট্যসম্পর্কিত সমগ্র ঘটনার সহিত আমাদের মনোযোগের সহিত পরিচিত হইতে হইবে যাহাতে সমগ্র ব্যাধিকে ধ্বংস করিবার জন্য যে সকল ঔষধের বিশুদ্ধ গুনাগুন জানা আছে তাহাদের মধ্য হইতে সদৃশধর্মী রোগউৎপাদিকা ভূমিকা একটি ভেষজ শক্তি নির্ধারণ করা যায় এমন একটি ঔষধ লক্ষণ তালিকায় আমাদের চিকিৎসাধীন রোগীর শুধু শারীরিক নয় মানসিক আবেগ প্রধান অবস্থাও সর্বাধিক প্রকটিত হয়।
#সূত্রঃ ২১৮। এই লক্ষণসংগ্রহের মধ্যে প্রথমত থাকিবে একতরফা মানসিক লক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়া মানসিক রোগ ও স্বভাবে পরিণত হইবার পূর্বের তথাকথিত শারীরিক রোগের সমগ্র ঘটনাবলির যথাযথ বর্ণনা। ইহা রোগীর বন্ধু-বান্ধবগণের নিকট হইতে জানা যাইতে পারে।
#সূত্রঃ ২১৯। সেই সকল পূর্ববর্তী শারীরিক রোগের লক্ষণের সহিত অবশিষ্ট যাহা কিছু তখনও আছে, যদিও সে সকলের অনুভূতি অনেক পরিমাণে হ্রাসপ্রাপ্ত ( কিন্তু যাহা তখনও কোন কোন সময়ে যখন প্রকৃতিস্থ অবস্থা আসে এবং মানসিক রোগের সাময়িক প্রশমন ঘটে তখন প্রাধান্য লাভ করে) তাহার তুলনা করিলে ইহা প্রমাণিত হয় যে যদিও অস্পষ্ট তথাপি তখনও তাহারা বিদ্যমান।
#সূত্রঃ ২২০। চিকিৎসক এবং রোগীর বন্ধুগণ কর্তৃক যথার্থভাবে পরিলক্ষিত মন ও স্বভাব ইহার সহিত যোগ করিলে রোগের একটি পূর্ণাঙ্গচিত্র রচনা করা যাইবে।হোমিওপ্যাথি মতে ইহার আরোগ্য সাধনের জন্য সোরাবিষঘ্ন ঔষধসমূহের মধ্য হইতে এমন একটি ঔষধের অনুসন্ধান করিতে হইবে যাহা যথাযথ সদৃশ লক্ষণ, বিশেষত অনুরূপ মানসিক বিকৃতি- যদি মানসিক ব্যাধি বহুদিন ধরিয়া চলিয়া থাকে- উৎপন্ন করিতে সমর্থ।
#সূত্রঃ ২২১। কিন্তু যদি রোগীর সাধারণ শান্ত অবস্থায় হঠাৎ উন্মত্ততা কিংবা বাতিক ( ভয়, বিরক্তি, সূরার অপব্যবহারে প্রভৃতি হইতে উৎপন্ন) অচিররোগরূপে দেখা দেয়, যদিও তাহা প্রায় ক্ষেত্রে অগ্নিশিখার মতো অন্তর্হিত সোরা হইতে উদ্ভূত, তথাপি যখন তাহা তীব্রভাবে আসে তখনই তাহাকে সোরাদোষঘ্ন ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করা উচিত নহে; প্রথমে অন্য শ্রেণীর পরীক্ষিত ( যথা একোনাইট, বেলেডোনা, স্ট্রামোনিয়াম, মার্কারি প্রভৃতি ) উচ্চশক্তির হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ক্ষুদ্র মাত্রায় প্রয়োগ করা উচিত যাহাতে সাময়িকভাবে সোরা দমিত হইয়া পূর্বের সুপ্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসে এবং রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলিয়া বোধ হয়।
#সূত্রঃ ২২২। কিন্তু সোরাবিষনাশক নহে এইরূপ ওষুধ ব্যবহারে মানসিক বা চিত্তাবেগজনিত পীড়ার তীব্র অবস্থা সারিয়া গেলেও রোগী আরোগ্যলাভ করিয়াছে মনে করা কখনই উচিত নহে। বরং সুদীর্ঘকাল সোরাদোষনাশক চিকিৎসার দ্বারা যাহাতে তাহাকে পুরাতন সোরাবিষ হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত করা যায় সেইজন্য একটুও সময় নষ্ট করা উচিত নহে। সোরাদোষ তখন সুপ্ত হইয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু যে কোনো সময়ে নূতন করিয়া তাহা আবির্ভূত হতে পারে। ইহা করা হইলে আর পুনরাক্রমণের ভয় থাকে না, যদি রোগী তাহার পথ্যাদির বিধিব্যবস্থা ঠিকমতো মানিয়া চলে।
#সূত্রঃ ২২৩। কিন্তু যদি সোরাবিষঘ্ন চিকিৎসা করা না হয় তাহা হইলে মানসিক বিকৃতির প্রথম কারণ অপেক্ষা তূচ্ছতর কারণে আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং অধিকতর প্রচণ্ড দ্রুত নূতন আক্রমণ ঘটিবে ইহা আমরা প্রায় নিশ্চিত অনুমান করতে পারি। তখন সোরা প্রায় সম্পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়া সাময়িক কিংবা স্থায়ী মানসিক ব্যধিরূপে পরিণত হয় এবং তখন তাহাকে সোরাবিষঘ্ন ঔষধ দ্বারা আরোগ্য করা অধিকতর কঠিন হয়।
#সূত্রঃ ২২৪। মানসিক রোগের যদি সম্পূর্ণভাবে না হইয়া থাকে এবং প্রকৃত শারীরিক ব্যাধি হইতে উৎপন্ন অথবা শিক্ষার দোষ, কুঅভ্যাস, দুর্নীতি, অসংযম, কুসংস্কার বা অজ্ঞতার ফল হইতে উদ্ভূত সেই বিষয়ে যদি সন্দেহ থাকে, তাহা হইলে সিদ্ধান্তে আসিবার জন্য যদি তারা পরবর্তী কারণগুলির মধ্যে কোন একটি হইতে ঘটিয়া থাকে তবে যুক্তিপূর্ণ সহৃদয় অনুরোধ, সান্তনাপূর্ণ প্রতিবাদ, গাম্ভীর্যপূর্ণ আবেদন এবং উপযুক্ত পরামর্শ দ্বারা তাহা প্রশমিত বা সংশোধিত হইবে। কিন্তু সত্যিকার নৈতিক বা মানসিক ব্যাধি যাহা শারীরিক ব্যাধি হইতে উদ্ভূত তাহা অনুরূপ অবস্থায় দ্রুত বৃদ্ধি পাইবে । বিষন্ন রোগী অধিকতর বিষাদগ্রস্ত, কলহপ্রিয় অপ্রবোধনীয় এবং তূষ্ণীভাব বিশিষ্ট হইবে ; বিদ্বেষপরায়ণ উন্মাদ তদ্দারা অধিকতর কুপিত এবং বাচাল নির্বোধের বোকামি আরো বেশি প্রকটিত হইবে।
#সূত্রঃ ২২৫। এমন কতকগুলি সুনিশ্চিত চিত্তাবেগপূর্ণ রোগ আছে, যেগুলির কথা ইতোপূর্বে বলা হইয়াছে, যাহা কেবল দৈহিক পীড়া হইতে উদ্ভূত হইয়া ঐ অবস্থায় পরিণত হয় নাই। বরং শরীর একটু অসুস্থ অবস্থায় থাকায় সেইগুলি বিপরীতভাবে আবেগমূলক কারণসমূহ হইতে, এমন অবিরত উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, অন্যায় এবং পুনঃপুনঃ বিষম আশঙ্কা ও ভীতিযুক্ত ঘটনা হইতে উদ্ভূত হয় ও বজায় থাকে। এই প্রকার আবেগপ্রধান রোগ সময় দৈহিক স্বাস্থ্যকে নষ্ট করিয়া দেয় এবং তাহা প্রায়ই অধিক পরিমাণে করে।
#সূত্রঃ ২২৬। কেবলমাত্র এই প্রকার আবেগপ্রধান ব্যাধিসমূহ, যেগুলির মন হইতে উৎপত্তি ও মনেই স্থিতি, যদি অল্পদিনের হয় এবং দৈহিক অবস্থার বিশেষ ক্ষতিসাধন না করিয়া থাকে, তাহা হইলে মনস্তাত্ত্বিক বিধানসমূহদ্বারা যথা, আশ্বাসপ্রদান, বন্ধুত্বপূর্ণ আবেদন, যুক্তিপূর্ণ পরামর্শ এবং অনেক ক্ষেত্রে সুসম্পাদিত প্রচ্ছন্ন ছলনা দ্বারা দ্রুত সুস্থ মানসিক অবস্থা ফিরাইয়া আনা যাইতে পারে ( এবং তাঁহার সহিত উপযুক্ত আহারবিহারের ব্যবস্থা দ্বারা দৃশ্যত দেহের সুস্থভাবেরও পুনরানয়ন সম্ভব)।
#সূত্রঃ ২২৭। কিন্তু এই সকল ক্ষেত্রেও মূল কারণ হইল সোরা, যদিও তাহা কখনো পূর্ণ বিকাশের অবস্থা লাভ করে নাই। সাবধানতার জন্য আপত নীরোগ সেই রোগী পুনরায় যাহাতে ঐরূপ মানসিক রোগগ্রস্থ না হয়, যাহা সহজেই ঘটিতে পারে, তাহাকে নির্মূলকারী সোরাদোষনাশক চিকিৎসার অধীনে রাখা উচিত ।
#সূত্রঃ ২২৮। শারীরিক ব্যাধি হইতে উৎপন্ন মানসিক এবং চিত্তাবেগপ্রধান রোগসমূহে- যাহা কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক সেরাদোষনাশক ওষুধ প্রয়োগে ও তাহার সহিত জীবনযাত্রাকে সুবিন্যস্ত করিয়া নিরাময় করা সম্ভব- সাহায্যকারী বিধিব্যবস্থারূপে চিকিৎসক এবং রোগীর সঙ্গীগণের রোগীর প্রতি উপযুক্ত মনস্তাত্ত্বিক আচরণ সাবধানতার সহিত রক্ষা করা অবশ্যই কর্তব্য। প্রচন্ড উন্মত্ততার সম্মুখে অবিচল সাহস, শান্ত ও দৃঢ় সংকল্প, বিষণ্ন ও অসন্তুষ্ট খেদোক্তির সম্মুখে দৃষ্টি ও ইঙ্গিতে সমবেদনা, অর্থহীন বাচালতায় সম্পূর্ণ অবহেলা না দেখাইয়াও নির্বাক ভাব, বিরক্তিকর ও ঘৃণার্হ ব্যবহারে এবং ঐরূপ কথাবার্তায় সম্পূর্ণ অবহেলা প্রদর্শন করা উচিত। রোগীকে তাহার আচরণের জন্য তিরস্কার না করিয়া আমরা কেবল চারিপাশের দ্রব্যাদির নষ্ট ও ক্ষতি নিবারণ করিবার চেষ্টা করিব। সবকিছু এমনভাবে সাজাইয়া রাখিতে হইবে যাহাতে দৈহিক শাস্তি দিবার বা উৎপীড়ন জাতীয় কিছু করার প্রয়োজন না হয়। এইটুকু অনেক সহজেই সম্পন্ন করা যায় কারণ, ওষুধপ্রয়োগই একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে বলপ্রয়োগ করা সংগত হইতে পারে, কিন্তু সেস্থলে উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের স্বল্পমাত্রা স্বাদগ্রাহ্য নহে বলিয়া রোগের অজ্ঞাতে তাহার পানীয়ের সঙ্গে দেওয়া যাইতে পারে, সুতরাং বলপ্রয়োগের দরকার হয় না।
#সূত্রঃ ২২৯। আবার এই প্রকার রোগীদের নিকট প্রতিবাদ, সাগ্রহে বুঝান, রূঢ়ভাবে দোষ সংশোধন ও কটুক্তি করা যেমন অচল, তেমনি দুর্বলতা প্রদর্শন ও ভয়ে নতি স্বীকার করারও কোন স্থান নাই। দুইটিই মানসিক ও চিত্তাবেগজনিত রোগের চিকিৎসায় সমান ক্ষতিকর। এইরূপ রোগীরা প্রায় সকলেই ঔদ্ধত্য, ছলনা ও প্রতারণা ধরিতে পারিলে চটিয়া যায় ও তাহাদের রোগ বৃদ্ধি পায়। তাহাদের যে বুদ্ধিবিবেচনা আছে ও তাহাদের বিশ্বাস করিতেছেন এইরূপ ভান লইয়া চিকিৎসক ও রক্ষীকে সর্বদা চলিতে হইবে। তাহাদের অনুভূতি ও প্রকৃতির পক্ষে বিরক্তিকর সকল বাহ্যপ্রভাব সম্ভবমতো সরাইয়া দেওয়া উচিত। তাহাদের বিষাদময় মন ও মেজাজের জন্য তাহাদের নিকট কোন আমোদ-প্রমোদ উপভোগ্য নহে। একমাত্র আরোগ্যলাভ ছাড়া কোন হিতকর আকর্ষণ, কোন প্রকার পরামর্শ, মনোরম আলাপ-আলোচনা, পুস্তক বা অন্যকিছু তাহাদের ক্ষুব্ধ ও পীড়িত দেহে শৃঙ্খলিত অন্তরাত্মার নিকট প্রাণবন্ত বোধ হয় না। দৈহিক স্বাস্থ্যের যখন ক্রমোন্নতি হয় তখনই শান্তি ও আরামের আলোকরশ্মি তাহাদের মনে প্রতিফলিত হয়।
#সূত্রঃ ২৩০। মানসিক ও চিত্তাবেগজনিত রোগের প্রত্যেকটি বিশিষ্ট ক্ষেত্রে (যারা অবিশ্বাস্যরূপে বহু প্রকারের) নির্বাচিত সোরাদোষনাশক ঔষধসমুহ যদি হোমিওপ্যাথি মতে যথাযথভাবে নিরূপিত রোগচিত্রের উপযুক্ত হয় যাহা সম্ভব হইবে যদি এই প্রকারের যথেষ্ট সংখ্যক ওষুধের গুনাগুন জানা থাকে তাহা হইলে সর্বাধিক উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের জন্য অক্লান্ত অনুসন্ধান আরও সহজে করা যায়। যখন আবেগ ও মানসিক অবস্থা এইরূপ রোগীর মুখ্য লক্ষণ তখন তাহা এত নির্ভুলভাবে বুঝিতে পারা যায় যে অবিলম্বে বিশেষ উন্নতির লক্ষণ– যাহা অনুপযুক্ত এলোপ্যাথিক ঔষধের বৃহত্তম মাত্রা রোগীকে আমরন পুনঃপুনঃ প্রয়োগ দ্বারাও আনা যায় না—লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত বহু অভিজ্ঞতার ফলে আমি বিশ্বস্তভাবে নিশ্চয় করিয়া বলিতে চাই যে, দৈহিক পীড়া হইতে উদ্ভূত কিংবা তাহার সহিত বিকাশপ্রাপ্ত দীর্ঘদিনের মানসিক ও আবেগজনিত পীড়ায় হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতির যে শ্রেষ্ঠ সাফল্যের গৌরব তাহা, আমার ধারণার মধ্যে অন্যান্য যে সকল চিকিৎসাপদ্ধতি আছে , তাহাদের কোনোটিতে নাই।
(২৯) সবিরাম রোগ (সূত্র-২৩১-২৩৫)
#সূত্রঃ ২৩১। সবিরাম ব্যাধিসমূহ এবং যে সকল ব্যাধি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পুনঃপুনঃ দেখা দেয় যেমন, বহু প্রকারের সবিরাম জ্বর এবং সবিরাম জ্বরের মতো যে সকল বাহ্যতে জ্বরবিহীন ব্যাধি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে পুনঃপুনঃ হয় এবং সেই সকল ব্যাধিও যেগুলি অনির্দিষ্ট সময় অন্তর এক এক প্রকারের লক্ষণ লইয়া পর্যায়ক্রমে আসে– সেই সকল বিশেষভাবে আলোচনার যোগ্য।
#সূত্রঃ ২৩২। শেষোক্ত প্রকারের পর্যায়শীল ব্যাধিসমূহ সংখ্যাতেও অনেক কিন্তু সেইগুলি শ্রেণীভুক্ত। সেইগুলি সাধারণত সোরারই পূর্ণ বিকাশ মাত্র, ক্বচিৎ কখনো সিফিলিসের সঙ্গে জটিলতা প্রাপ্ত হয় এবং সেইজন্য পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে সোরাদোষনাশক ওষুধ দ্বারা আরোগ্য করা যায় এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে ক্রনিক ডিজিজেস গ্রন্থে আমার উপদেশ অনুযায়ী সিফিলিসদোষনাশক ওষুধের পর্যায়ক্রমে ব্যবহার দ্বারা আরোগ্য করা যায়।
#সূত্রঃ ২৩৩। সেইগুলিই হইল খাঁটি সবিরাম ব্যাধি যেখানে অপরিবর্তিত লক্ষণ প্রায় নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ফিরিয়া আসে, সেই সময়ের মধ্যে রোগী আপত সুস্থ অবস্থায় থাকে এবং সেইরূপ একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই রোগাবস্থা অন্তর্হিত হয়। বাহ্যত জ্বরবিহীন রোগলক্ষণ যেগুলি কোন কোন সময়ে পর্যায়বৃত্তভাবে আসে যায় এবং সেই সকল জ্বর যেমন নানা প্রকারের সবিরাম জ্বর, তাহাদের ক্ষেত্রে এইরূপ দেখা যায়।
#সূত্রঃ ২৩৪। যে সকল বাহ্যত জ্বরবিহীন বিশিষ্ট পর্যাবৃত্ত রোগলক্ষণের কথা এখন বলা হইল যাহা একসময়ে একটিমাত্র রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় ( ইহা বিক্ষিপ্তভাবে বা মহামারীরূপে দেখা যায় না ), তাহা সর্বদাই সোরাদোষগ্রস্ত চিররোগের অন্তর্ভুক্ত, কদাচিৎ সিফিলিসের সঙ্গে জড়িত দেখা যায় এবং একই পন্থায় সাফল্যের সহিত চিকিৎসা করা। তথাপি তাহাদের পর্যায়ক্রমিক আবির্ভাব সম্পূর্ণভাবে রোধ করার জন্য সিঙ্কোনাছালের শক্তিকৃত দ্রবের একটি ক্ষুদ্র মাত্রা কখনো কখনো অন্তর্বর্তীকালীন ওষুধরূপে ব্যবহার করা প্রয়োজন হয়।
#সূত্রঃ ২৩৫। যেসকল সবিরাম জ্বর বিক্ষিপ্তভাবে কিংবা মহামারী রূপে দেখা (জলাভূমি অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে যেগুলি দেখা যায় সেগুলি নহে) তাহাদের প্রত্যেক আক্রমণে দুইটি বিপরীত পর্যায়শীল অবস্থা (শীত, উত্তাপ–উত্তাপ, শীত), অধিকাংশ সময়ে তিনটি ও (শীত, উত্তাপ, ঘর্ম ) লক্ষ্য করা যায়। সেইজন্য পরীক্ষিত অসৎ সমূহের সাধারণ শ্রেণী (সোরাদোষঘ্ন ছাড়া অন্য কিছু) হইতে নির্বাচিত ঔষুধের (এবং এই প্রকার ঔষধি সুনিশ্চিত) সুস্থ শরীরে দুইটি (বা তিনটিই) অনুরূপ পর্যায় শীল অবস্থা সম্পাদন করিবার ক্ষমতা থাকা চাই কিংবা সদৃশ লক্ষণ অনুসারে সর্বাপেক্ষা সুচিহ্নিত, প্রবলতম ও বিশিষ্ট পর্দাশীল অবস্থার সহিত (আনুষাঙ্গিক লক্ষণ সহ প্রত্যেকটির শীত, উত্তাপ কিংবা ঘর্মাবস্থা যেটি সবচেয়ে প্রবল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ) মিল থাকা চাই। কিন্তু রোগীর বিজ্বর অবস্থার লক্ষণসমূহই সর্বাধিক উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচনের প্রধান নির্দেশক।
(৩০) ঔষধ প্রয়োগের সময় (সূত্র-২৩৬-২৪৪)
#সূত্রঃ ২৩৬। এই সকল ক্ষেত্রে ঔষধ প্রয়োগের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ও কার্যকরী সময় হইল আক্রমণ শেষ হইবামাত্র কিংবা তাহার অতি অল্পক্ষণ পরেই, যখন রোগী কিয়ৎ পরিমাণে সুস্থবোধ করিয়াছে। স্বাস্থ্য পুনরানয়নের জন্য যে সকল পরিবর্তন সাধন করিবার প্রয়োজন তাহা তখন করিবার সময়। তাহাতে বেশি কিছু গোলযোগ বা প্রবল আলোড়ন হয়না। পড়ন্তু খুব উপযুক্ত ঔষধ ও যদি আক্রমণের পূর্বে প্রয়োগ করা হয় তাহা হইলে ওষুধের ক্রিয়া পীড়ার স্বাভাবিক গতির সহিত মিলিত হইয়া দেহে এরূপ প্রতিক্রিয়া ও প্রচণ্ড বিক্ষোভ আনে যে সেই জাতীয় আক্রমণে জীবনহানি না হইলেও অত্যন্ত বলহানি হয়। কিন্তু ঔষধ যদি বৃদ্ধির শেষে, অর্থাৎ যখন জ্বর বিচ্ছেদ হইয়াছে এবং পরবর্তী আক্রমণ শুরু হইতে বহু বিলম্ব আছে সেই সময়ে দেওয়া হয় তাহা হইলে দেহের জীবসত্তা ঔষধ দ্বারা শান্তভাবে পরিবর্তিত হইবার সর্বোত্তম সুযোগ লাভ করে এবং এইরূপে পুনরায় সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়া আসে।
#সূত্রঃ ২৩৭। কিন্তু বিজ্বর অবস্থা যদি খুব সংক্ষিপ্ত হয় যেমন কতকগুলি অতি দুষ্ট জ্বরে ঘটে বা পূর্ববর্তী আক্রমণের পরবর্তী যন্ত্রণা ভোগ দ্বারা তাহা বিঘ্নিত হয় তাহা হইলে ঘাম কমিয়া আসিতে থাকিলে বা বিলীয়মান আক্রমণের পরবর্তী অবস্থাগুলি হ্রাস পাইতে থাকিলে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করা কর্তব্য।
#সূত্রঃ ২৩৮। উপযুক্ত ঔষধ এর কেবল একমাত্র সচরাচর পীড়ার কতকগুলি আক্রমণ বন্ধ করিয়া দিতে পারে এবং স্বাস্থ্যকে ফিরাইয়া আনিতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি আক্রমণের শেষে একমাত্রা করিয়া ঔষধ দিতে হইবে। আরও ভালো হয় লক্ষণের প্রকৃতির পরিবর্তন না হওয়াকালীন যদি সেই ঔষধই পুনঃ প্রয়োগের নূতন নিয়মানুসারে (২৭০ সূত্রের পাদটীকা দ্রষ্টব্য) ঔষধপূর্ণ শিশিটিকে প্রত্যেক পরবর্তী মাত্রা প্রয়োগের সময় দশ-বারো বার ঝাঁকি দিয়া শক্তিকৃত করিয়া দেওয়া হয়। তথাপি সময়ে সময়ে এরূপ ক্ষেত্র আসে, যদিও তাহা বিরল, যেখানে কিছুদিন ভালো থাকার পর সবিরাম জ্বর আবার ফিরে আসে।রোগী সুস্থ থাকার পর একই জ্বরের এইরূপ প্রত্যাবর্তন কেবলমাত্র সম্ভবপর হয় সেখানে যে দূষিত কারণে জ্বরের প্রথম সূত্রপাত তাহা যদি সদ্যোরোগমুক্ত রোগীর উপর ক্রিয়া করিতে থাকে, যেমন জলাভূমি অঞ্চলে ঘটে। এই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র উত্তেজনা—কারণ হইতে দূরে সরিয়া গেলেই স্থায়ী স্বাস্থ্য লাভ হইতে পারে, যেমন জলাভূমি অঞ্চলের গড় পার্থক্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করিলে ঘটে।
#সূত্রঃ ২৩৯। প্রায় প্রত্যেকটি ঔষধ যখন তাহার বিশুদ্ধ ক্রিয়ায় এক বিশেষ প্রকৃতির উৎপাদন করে এমনকি পর্দাশীল অবস্থা যুক্ত এক প্রকার সবিরাম জ্বর, যাহা অন্যান্য ঔষধ সৃষ্ট জ্বর হইতে পৃথক, তখন বহু প্রকার প্রাকৃতিক সবিরাম জ্বরের জন্য বিশাল ভেষজের ভান্ডার হইতে সঠিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পাওয়া সম্ভব। সুস্থ দেহে পরীক্ষিত অষুধের পরিমিত সংগ্রহের মধ্যেও এরূপ অনেকগুলি জ্বরের জন্য ঔষধ পাওয়া যায়।
#সূত্রঃ ২৪০। কিন্তু সবিরাম জ্বরের কোন ব্যাপক হারে যাহা অমোঘ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রূপে গণ্য তাহা যদি কোন কোন রোগীকে সম্পূর্ণ আরোগ্য দান করিতে সমর্থ না হয় এবং জলাভূমি অঞ্চলের অভাব যদি আরোগ্যলাভের প্রতিবন্ধক রূপে সাব্যস্ত না হয়, তাহা হইলে তাহার পিছনে নিশ্চয় সোরাবীজ আছে এবং সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত সোরাদোষনাশক ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে।
সূত্রঃ ২৪১। যে সকল স্থানে মহামারীরূপী সবিরাম জ্বর আমিও কারণ হতে উদ্ভূত নহে সেই সকল স্থানে তাহা চিররোগের প্রকৃতি বিশিষ্ট এবং তাহার একটিমাত্র প্রবল আক্রমণ হয়। প্রত্যেকটি মহামারীতেই আক্রান্ত ব্যক্তিদের সকলের মধ্যে একটি বিশেষ প্রকারের বৈশিষ্ট্যসূচক লক্ষণ দেখা যায় এবং যখন ইহা সকলের মধ্যেই লক্ষণ সমষ্টিরুপে দেখা যায় তখন তাহা সকল ক্ষেত্রে উপযোগী এক নির্দিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ওষুধের সন্ধান দেয় যে ঔষধ যেসকল রোগীর পূর্বে মোটামুটি সুস্থ ছিল, অর্থাৎ উদ্দীপ্ত সোরার আক্রমণে চিররোগগ্রস্থ হয় নাই, তাহাদের পক্ষে সর্বজনীনভাবে উপকারী।
#সূত্রঃ ২৪২। এরূপ মহামারীরূপী সবিরাম জ্বরের প্রথম আক্রমণ যদি অনারোগ্য অবস্থায় থাকে বা অনুপযুক্ত এলোপ্যাথিক চিকিৎসার ফলে রোগী দুর্বল হইয়ে পড়ে, তখন অন্তর্নিহিত সোরা, যাহা কত লোকের ভিতরে হায়! সুপ্ত রহিয়াছে, তাহা উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিয়া সবিরাম জ্বরের প্রকৃতি গ্রহণ করে এবং দৃশ্যত সবিরাম জ্বরের মহামারীর ভূমিকা অভিনয় করে। সেইজন্য প্রথম আক্রমণে যে ওষুধ প্রয়োজন ছিল (কদাচিৎ তাহা সোরাবিষঘ্ন) এখন তাহার আর উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা থাকেনা। এখন সোরা হইতে উৎপন্ন সবিরাম জ্বর হিসেবে তাহাকে ধরিতে হইবে এবং উচ্চশক্তির সালফার কিংবা হিপার সালফারের ক্ষুদ্র মাত্রায় (কাদাচিৎ পুনঃপ্রয়োগে) তাহা প্রশমিত হইবে।
#সূত্রঃ ২৪৩। সেই সকল অত্যন্ত মারাত্মক সবিরাম জ্বরের ক্ষেত্রে যেখানে জলা অঞ্চলে বাস না করিয়া ও দেহ আক্রান্ত হয়, সেখানে প্রথমে সোরাজনিত সাধারণ অচিররোগে যেমন করা হয় তেমনি অন্য শ্রেণীর পরীক্ষিত ঔষধ (সোরাদোষনাশক নহে) ইহাতে সেই বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য এটি হোমিও ঔষধ নির্বাচন করিয়া কয়েকদিন ধরিয়া তাহার প্রয়োগ করিয়া কতটা কি কার্য হয় দেখিতে হইবে। কিন্তু যদি এইরূপ করা সত্ত্বেও আরোগ্য বিলম্বিত হয় তখন বুঝিতে হইবে যে, মূলে যে সোরা আছে তাহার প্রতিবিধান আবশ্যক এবং সেই ক্ষেত্রে একমাত্র সোরাদোষনাষক ওষুধই চূড়ান্তভাবে আরোগ্য দান করিতে সমর্থ।
#সূত্রঃ ২৪৪। জলাভূমি অঞ্চলের স্থানীয় এবং যে সকল অঞ্চল প্রায়ই বন্যা প্লাবিত হয় সেখানকার সবিরাম জ্বর সম্বন্ধে পুরাতন পন্থী চিকিৎসকগণের তৎপরতা দেখা যায়। তথাপি কোন স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি যৌবনে জলাভূমি বাস করিতে অভ্যস্ত হইয়া সুস্থ জীবন কাটাতে পারে যদি সে পথ্যাপথ্য সম্বন্ধে ত্রুটিহীন নিয়ম পালন করে এবং যদি অভাব, ক্লান্তি ও দুষ্টু প্রবৃত্তির দ্বারা তাহার দৈহিক শক্তির অপচয় না ঘটে। সেখানে প্রথম আসিলে সেখানকার স্থানীয় সবিরাম জ্বর বড়জোর তাহাকে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু সিঙ্কোনা ছালের নির্দেশের উচ্চশক্তির দুই কোটি ক্ষুদ্র মাত্রা ও পূর্বোল্লিখিত সুনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা তাহাকে দ্রুত রোগ মুক্ত করিতে পারে। কিন্তু উপযুক্ত দৈহিক ব্যায়াম এবং সুস্থ মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য বিধিব্যবস্থা পালন সত্ত্বেও যে সকল ব্যক্তির জলাভূমি অঞ্চলের সবিরাম জ্বর এইরোপ দুই একটি ক্ষুদ্র মাত্রায় সিঙ্কোনা প্রয়োগে সারে না, তাহাদের পীড়ার মূল কারণ রূপে সোরা সর্বদা বিদ্যমান রহিয়াছে তাহা বিকশিত হইবার চেষ্টা করিতেছে এবং জলাভূমি অঞ্চলে তাহাদের সেই সবিরাম জ্বর সোরাদোষ নাশক ঔষধ ব্যতীত আরোগ্য লাভ করিতে পারে না। কখনো কখনো যদি যদি অবিলম্বে জলাভূমি অঞ্চল ছাড়িয়া শুষ্ক অঞ্চলে যায় তাহা হইলে দৃশ্যত আরোগ্য শুরু হয় (জ্বর ছাড়িয়া যায়) অবশ্য যদি তাহারা তখন ও গভীরভাবে না হইয়া থাকে অর্থাৎ যদি সোরা তাহাদের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে বিকাশ লাভ না করিয়া থাকে এবং সেইহেতু পুনরায় তাহা সুপ্ত অবস্থায় ফিরিয়া আসিতে পারে, কিন্তু সোরাদোষনাশক চিকিৎসা ছাড়া তাহাদের পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করা কখনই সম্ভব নহে ।