Medorrhinum (মেডোরিনাম)- ডা: হাসান মির্জা

Medorrhinum (মেডোরিনাম)
মেডোরিনাম ঃ মেডোরিনামের প্রথম ও প্রধান কথা- বংশগত বা পুরুষানুক্রমিক প্রমেহদোষ। মেডোরিনামের পরিচয় জানতে হলে সাইকোসিস বা বংশগত সাইকোসিসের পাঠ সর্বাগ্রে নিতে হবে। আজকাল সরলমতি নিস্পাপ শিশুরা বাত বা হাঁপানি রোগে ভূগছে, মেনিঞ্জাইটিসের মত ভয়াবহ পীড়ায় শিশুরা আক্রান্ত, তারা রিকেটিক বা পুঁয়ে পাওয়া রোগে ভোগে। আবার মধ্যবয়স্ক বা প্রবীণব্যক্তিরা ক্যানসার, টিউমার বা অনুরূপ জটিল ও মরণপীড়ায় আক্রান্ত। এই সকল রোগের চিকিৎসার পূর্বে আমাদের সাইকোটিক গনোরিয়ার বিষ থেকে তৈরি মেডোরিনামের চরিত্র অনুধাবন করা উচিৎ।
সাইকোসিস ঃ কোন এক পুরুষে গনোরিয়া বিষ যখন সরলভাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন মেডোরিনাম ততটা কার্যকরী নয়, কিন্তু যখন তা বংশানুক্রমিকভাবে প্রকাশ পায় তখন তার চরিত্র এমনই দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায় যে চিকিৎসকের মনে ধাঁধাঁর সৃষ্টি করে এবং ঔষধ নির্বাচনও কঠিন হয়ে ওঠে। মেডোরিনাম ঠিক এই জায়গায় তার ম্যাজিক দেখাতে সক্ষম। এর ক্রিয়া অতিগভীর এবং বংশগত সাইকোসিসের মূলে পৌঁছতে সক্ষম। সাইকোসিস যেমন রক্তকে আক্রমণ করে রোগীকে রক্তশূন্য করে দেয় তেমনি দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রমণ করে ভয়াবহ প্রদাহ বা ব্যথাবেদনার সৃষ্টি করে। জেনে রাখা দরকার যে, দেহস্থ যেকোন প্রদাহ যখন ‘মারাত্মকভাবে এবং অতি যন্ত্রণাদায়করূপে’ প্রকাশ পায় তখন তার মূলে সাইকোসিস বা গনোরিয়া বিষ নিশ্চিতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে।
প্রমেহদোষ ঃ যারা রোগের প্রকৃত কারণটি অনুসন্ধান না করে শুধুমাত্র সাধারণ কিছু লক্ষণ বিচার করে চিকিৎসা করেন তারা এখনও হোমিওপ্যাথি বোঝেননি। রক্তের চাপবৃদ্ধি বা উচ্চরক্তচাপ, টিউমার, ক্যানসার, গ্রন্থিবৃদ্ধি, হাঁপানি, বাত, ব্রঙ্কাইটিস, মেনিঞ্জাইটিস, ভেদবমি, লিভারপ্রদাহ, জরায়ুপ্রদাহ, কিডনিপ্রদাহ, স্নায়ুশূল, কটিবাত, শিশুর মস্তকে একজিমা, শোথ বা সর্বাঙ্গীন শোথ, মাথাঘোরা, বহুমূত্র ইত্যাদি পীড়ার মূলে প্রমেহ দোষ আছে কিনা তা বিচার্য।
গনোরিয়া ঃ গনোরিয়া রোগটি স্পর্শাক্রমক। গনোকক্কাস নামক বিশেষ প্রকৃতির জীবাণুর দ্বারা সৃস্ট রোগটি দুষ্ট প্রকৃতির। মুত্রযন্ত্র ও জননযন্ত্রের প্রদাহ তৎসহ মূত্রনালী দিয়ে পুঁজ পড়তে থাকলে তাকে এককথায় গনোরিয়া বলা হয়। পুরুষের প্রষ্টেটগøান্ড, ইউরেথ্রা/মুত্রনালী, মূত্রমার্গ, রেতঃস্থলী মূত্রাশয়, ইপিডাইডিমিস/উপশুক্রাশয়, উপকোষ, অন্ডকোষের উপরের প্রান্ত, ব্লাডার/মূত্রথলী ইত্যাদি অঙ্গ আক্রান্ত হয়। রমণীদের ফেলোপিয়ান টিউব, ভ্যাজাইনা, সারভিক্স অঞ্চল, ইউরেত্রা, বারথ্যালিনাস গ্লাণ্ড গনোরিয়ার শিকার হয়। শিশুরাও গনোরিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে।
যৌবনে নারী-পুরুষের কু-অভ্যাস ও কুসংসর্গ শেষ পর্যন্ত তাদের শিশুদেরকেও ভোগায়। সাইকোসিস দোষযুক্ত কোন মাতা পেটে সন্তান বহন করার সময় সন্তানের চক্ষুতে এর পুঁজ যদি লেগে যায় তাহলে উদরস্থ শিশুটি অপথ্যালমিয়া নিউনেটোরাম নামক চক্ষুপীড়ায় আক্রান্ত হতে পারে এবং তৎকারণে শিশুটির অন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
গনোরিয়া স্রাব: গনোরিয়া রুদ্ধ হেতু যেকোন পুরাতন রোগের একমাত্র মহৌষধ মেডোরিনাম উচ্চশক্তিতে প্রয়োগ করলে রুদ্ধগনোরিয়া ¯্রাব পুনঃপ্রকাশিত হবে। এটা খুব ভালো লক্ষণ, ভয় পেলে চলবে না। অনেক মহিলার মসিক ঋতু¯্রাবের সময় মুখমন্ডলে ছোট ছোট ফোঁড়া হয। মেডোরিনাম মহিলাদের ঐ রমকম ফোড়া নিশ্চিতভাবে ভালো হবে। ইহা মুখের বয়ঃব্রনের উত্তম ঔষধ। অনেক রোগি রাতে অসাড়ে মূত্রপাত হয়ে যায়। মেডো ব্যবহারে ঐরকম রোগি ভালো হয়ে যায়। পুরুষের ধ্বজভঙ্গে এর অসীম উপকারিতা দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন।
স্ত্রীরোগ ঃ কোন স্ত্রীলোক বিবাহের পূর্বে বেশ সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী ছিল। কিন্তু বিবাহরে পর থেকে স্ত্রীলোটি স্বামী-গৃহে স্বামীসংসর্গে থাকার পর থেকে তার দেহে নানরাকম জটিলতার সৃষ্টি হয়। সে রুগ্না হয়, তার শরীর ভেঙে পরে, ঋতুর গোলযোগ বা সাদা¯্রাবে ভুগতে থাকে, ডিম্বাশয়ে ব্যথাবোধ শুরু হয, স্বামীসহবাস ইচ্ছার অবনতি ঘটে, ক্রমশঃ সে বিবর্ণ ও মোমবর্ণ ধারণ করে। দৈহিক ক্রমাবনতির সঙ্গে মহিলাটি মানসিকভাবে হীনবল হয়ে পড়ে। আমরা এই শ্রেণীর রমণীর স্বামীর ইতিহাস সন্ধান করলে তার রোগের উৎস খুঁজে পাবো। অর্থাৎ স্বামীর মধ্যে থাকা সাইকোসিস দোষ স্ত্রীদেহে সঞ্চারিত হওয়ার কারণটি জানা যাবে এবং রমণীর রোগটি মেডোরিনাম দ্বারা আরোগ্যলাভ করবে।
শিশুরোগ ঃ কোন শিশুর পিতা যদি কখনো দুরারোগ্য ব্যাধি গনোরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং যদি দেখা যায় শিশুটি কোন জটিল পীড়ায় আক্রান্ত যেমন শীর্ণতাপ্রাপ্তি বা পুঁয়ে পাওয়অ শিশু, হাঁপানীদোষ, মস্তকত্বক বা মুখমন্ডলে কেশদাদ বা চর্মরোগ, চক্ষু ও নাসিকার দুর্দমনীয় সর্দিতে আক্রান্ত তাহলে শিুটিকে মেডোরিনাম দিয়ে তার জটিলতা দূর করতে হবে। শিশুর মাথায় একজিমা।
শীর্ণতা ঃ শীর্ণদেহী মোমবর্ণ যুবক যারা তামাকদ্রব্য সেবী বা মাদকাসক্ত, পরিশ্রমকাতর, বায়ুপ্রবাহে অত্যন্ত অনুভূতিশীল, শীতকাতর এবং গনোরিয়ার ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর যবকটি আর সুস্থ হয়ে উঠছেনা, স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটছে- আপনি তার জন্য মেডোরিনাম ব্যবস্থা করুন।
জ্বালা ঃ জ্বালা মেডোরিনামের নিত্যসহচর এবং এর অন্যতম চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে হস্তপদে জ্বালা থাকবেই। জ্বালা এত ভীষণ যে, আক্রান্ত অঙ্গ রোগী কখনো ঢেকে রাখতে পারেনা এবং ক্রমাগত বাতাস চায় বা ঠান্ডা লাগাতে চায়। শুধু কি তাই, হিমাঙ্গ অবস্থাতেও রোগী বাতাস কামনা করে। হাতে জ্বালা, পায়ে জ্বালা, ব্রক্ষতালুতে জ্বালা, সর্বাঙ্গে জ্বালা মেডোকে চিনতে বড়ই সাহায্য করে।
বাত-ব্যথা ঃ মেডোরিনামে জ্বালা যেমন ব্যথাও তেমনি। বাত, কটিবাত, গেঁটেবাত, সর্বাঙ্গে ব্যাথাবোধ ও কামড়ানি। পদতলে ব্যথা ও স্পর্শকাতরতা। পায়ের গোড়ালীতে ব্যথা বা গোড়ালীর স্পর্শকাতরতা সাইকোসিসের একটি বৈশিষ্ট্যগত লক্ষণ। সুতরাং মেডোরিন এক্ষেত্রে চমৎকার সাড়া দেবে। এ ক্ষেত্রে এন্টিম ক্রড একটি মহাদামি ঔষধ এবং বহুক্ষেত্রে এই ঔষধ প্রয়োগে আমি কাক্সিক্ষত ফল পেয়েছি।
স্পর্শকাতরতা ঃ অত্যন্ত গরমকাতর। মেডোরিনামে জ্বালা যেমন, ব্যথা যেমন, স্পর্শকাতরতাও তেমনি। লিভার-কিডনি-জরায়ু-মেরুদÐ সবই স্পর্শকাতর হয়, মহিলাদের স্তন স্পর্শকাতর হয়। চক্ষুরোগে চক্ষু স্পর্শকাতর হয, আলোকাতঙ্ক, লক্ষ্য করলে দেখবেন অনেক শিশু আছে যাদের গায়ে হাত দিলে ভীষণ রিক্ত হয়, ক্রদ্ধ হয়ে ওঠে। আসলে শিশুটি মেডোরিনামের স্পর্শকাতরতায় ভুগছে। দৈহিক ও মানসিক স্পর্শকাতর রোগীদের সুশৃঙখলায় ফিরিয়ে আনতে এই নোসোড বন্ধুটির সাহায্য ছাড়া গতি নেই।
দিবাভাগে বৃদ্ধি ঃ মেডোরিনামের প্রায় সকল রোগ দিবাভাগে বৃদ্ধি পায়। সিফিলিনামের ঠিক উল্টো অর্থাৎ নিশীথে বৃদ্ধি যেমন সিফিলিনামকে নির্দেশ করে তেমনি দিবসে বৃদ্ধি মেডোরিনামের গুণগত বৈশিষ্ট্য। সূর্যোদয়ের পর রোগবৃদ্ধি।
স্নায়ুবিক দুর্বলতা ঃ রোগী প্রায় বলতে থাকে তার দেহের ভিতরটা যেন কাঁপছে। রোগীদেহের এই অভ্যন্তরীণ কম্পনের কারণটি হল তার স্নায়ুবিক দৃবলতা। এই দুর্বলতার কারণে মাথা ঘোরে, রোগী কোনরকম শ্রম সহ্য করতে পারেনা, কখনো মুর্ছা যায়।
মৃত্যুভয় ঃ উদ্বেগ, আশঙ্কা, নৈরাশ্য রোগীচিত্তে মৃত্যুভয় তৈরি হয়। মনে করে সে মহাপাপ করেছে, সর্বদা এক কাল্পনিক ভাবনায় রেগী ব্যস্ত হয়ে ওঠে। রোগী ক্রমাগত তার দেহ নিয়, রোগ নিয়ে অভিযোগ জানাতে থাকে এমনকি চিকিৎসককে পর্যন্ত বিরক্ত করে তখন আমরা রোগীটি মেডোর অধিকারভূক্ত কিনা চিন্তা করে দেখতে পারি।
স্মৃতিশক্তি দুর্বল ঃ মেডোর স্মৃতিশক্তিও ভীষণ দুর্বল। নিজের নাম ঠিকানা, নিজের পরিচয়ও বিস্মৃত হয়। পথ ঠিক করনতে পারেনা। প্রত্যেক কথা ও কাজে তার ভুল হতে থাকে। অন্ধকারভীতি, আত্মহত্যার চিন্তা, অস্থিরতা, খিটখিটে স্বভাব। সাইকোসিস বুদ্ধিবৃত্তিকে বিভ্রান্ত করে।
ক্রন্দনশীলতা ঃ মেডোরিনামের একটি মজার লক্ষণ হল রোগের বিরণী দিতে রোগীর চক্ষুদ্বয় অশ্রæসিক্ত হয়ে ওঠে। যাহা ‘ক্রন্দনশীলতা’ ভাষায় প্রকাশ করা হয়।
প্রবল মাদকদ্রব্য সেবনেচ্ছা ঃ মেডোরিনামে মাদকদ্রব্য সেবনের ইচ্ছা প্রবল। সে মিষ্টি, টক, ঝাল, লবণ, কাঁচা ফলমূল খেতে চায়।
শোথ ঃ মূত্রস্বল্পতা ও শোথ। চক্ষুর নিম্ন পাতায় শোথ।
মাথাঘোরা ঃ মাথাঘোরা প্রায় প্রত্যেক রোগের সঙ্গেই থাকে। ভীষণ মাথাঘোরা।
মূত্রযন্ত্র ঃ বহুমূত্র, মূত্রকষ্ট, মূত্রপাথরি, রক্তমূত্র, তীব্র গন্ধযুক্ত মূত্র। মূত্রত্যাগকালে জ্বালা, কিডনিতে গড়গড় শব্দ।
ঋতুস্রাব ঃ মহিলাদের ঋতু¯্রাব অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। ঋতুর দাগ কাপড়ে লাগে।
কাশি ঃ কাশি, প্রবল কাশি, শুষ্ককাশি।
নিদ্রা ঃ নিদ্রাকালে জিভ কামড়ে ফেলা মেডোরিনের মজার কথা।
হৃদপিন্ড ঃ হৃদপিন্ডের দুর্বলতাবশতঃ বামহস্ত অসাড়বোধ বা ব্যথা।
নাকের ডগা ঘষা ঃ রোগীর নাকের ডগা বা অগ্রভাগ সড়সড় করে এবং তজ্জনিত কারণে সে নাকের ডগায় হাত বুলায়, ক্রমাগত নাগের ডগা ঘষতে থাকে তাহলে আপনি একবার মেডোকে স্মরণ করবেন। ক্রিমির জন্য সিনার রোগীও ঐরকম আচরণ করে।
আঙুলের সন্ধি স্ফীতি ঃ হস্তপদের আঙুলের গাঁটগুলি ফুলো ফুলো। হস্তপদাঙ্গুলির ছোটছোট হাড়ের উপর লিডাম, এসিড বেঞ্জয়িক খুব ক্রিয়াশীল ঔষধ। কিন্তু লক্ষ্য রাখা উচিৎ রোগী সাইকোটিক ধাতুর হলে মেডোরিন এবং তদসদৃশ ব্যবস্থাই কার্ম।
আড়াআড়িভাবে রোগাক্রমণ ঃ ডান উর্দ্ধাঙ্গে এবং বাম নিম্নাঙ্গে কিংবা বাম হইতে ডানে (ল্যাকেসিস) রোগাক্রমন। মেডোরিন সম্পর্কে ডাঃ নরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের এই উক্তি প্রয়োগে রোগীতে যে সাফল্য পেয়েছি তাকে শুধু অসাধারণ বলাই যথেষ্ট নয়, অসাধারণের অসাধারণ বলা উচিৎ।
পোকা হাঁটার ন্যায় প্রবল অনুভূতি ঃ রোগীদেহে কখনো উর্দ্ধাঙ্গে, কখনো নিম্নাঙ্গে, কখনোবা সর্বাঙ্গে পোকা হাঁটার অত্যানুভুতির কারণে রোগী অস্থির হয়ে উঠে। রোগী গৃহস্থ সকলকে অস্থি করে তোলে। উক্ত রোগীর জন্য মোডারিনই যথেষ্ট।