হোমিওপ্যাথি: একটি ভ্রান্তির নিরসন ও সত্যের প্রকাশ

ডা. শাহীন মাহমুদ:
হোমিওপ্যাথি- প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি চলমান বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা এর জন্মের শুরু থেকেই বহুলভাবে বিতর্কিত । কিন্তু এই বহুল বিতর্ক এবং সেই সাথে বরাবর সমাজ ও রাষ্ট্রের শক্তিশালী শ্রেণিগুলোর তীব্র বিরোধিতা সত্বেও এর ২৩০ বছরেরও বেশী সময় যাবৎ সফলভাবে টিকে থাকা, ক্রমাগত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং আরোগ্যের লক্ষ লক্ষ প্রমাণ, আজ আমাদের দৃষ্টি পরিপূর্ণভাবে আকর্ষণের দাবী রাখে। এ যাবৎ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দেশেই, এবং প্রতিটি সময়েই বার বার এই ব্যবস্থাটিকে বন্ধ করতে, উৎখাত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। শুরু থেকেই বার বার বিভিন্ন অভিযোগ ও তদন্তের মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে চিকিৎসকই এই পদ্ধতিকে তদন্তের জন্য ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাদের বেশিরভাগই পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথিতে কনভার্ট হয়েছেন, নিদেনপক্ষে হোমিও চিকিৎসাব্যবস্থার কার্যকারিতার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। যাদেরকে হোমিওপ্যাথির স্তম্ভস্বরূপ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ধরা হয়, যেমন- ডা. জে. টি. কেন্ট, ডা. সি. হেরিং, ডা. ক্লার্ক, ডা. বয়েড, ইন্ডিয়ায় ডা. রাজেন দত্ত, ডা. মাহেন্দ্রলাল সরকার, এমনকি বর্তমান সময়ের বহু পথিকৃতগণও বেশিরভাগই প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে নিরাশ হয়ে, এবং মানুষের আরোগ্যকারী উত্তম চিকিৎসাব্যবস্থার খোঁজ করতে গিয়েই হোমিওপ্যাথিতে পৌছেঁছেন। এদের মধ্যে আবার অনেকে শুরুতে হোমিওপ্যাথির তীব্র বিরোধিতাই করতেন এবং তদন্ত করতে এসেই হোমিওপ্যাথির আশ্রয় নেন। কারণ কোন বিচক্ষণ ব্যক্তিই সত্যকে অস্বীকার করতে পারেন না, আর তারা ছিলেন সত্যিকারের মেধাবী। তাদের জীবন ইতিহাস এবং কর্ম সম্বন্ধে যারা জানেন, তারা একথা একবাক্যে স্বীকার করবেন। তারপরও কিছু খোঁড়া যুক্তি নিয়ে এর বিরোধিতা আজও রোয়ে গেছে। কিন্তু সে ব্যাপারে আলোচনার আগে, হোমিওপ্যাথির আবিষ্কার ও তার কারণ সম্পর্কে সংক্ষেপে একটা ধারণা নিয়ে নিই।

হোমিওপ্যাথির আবিষ্কর্তা তৎকালীন প্রচলিত ধারার সফল চিকিৎসক ডা. খ্রিশ্চিয়ান ফ্রেডরিখ স্যামুয়েল হানিম্যান [Dr. Christian Friedrich Samuel Hahnemann]। এই বিচক্ষণ মানুষটির মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর সর্বরকম বৈশিষ্ট্য তথা- অপরিসীম ধৈর্য্য, সত্য জানা ও মেনে নেয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সূক্ষ চিন্তাশক্তি, যৌক্তিক বিচারক্ষমতা ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান ছিলো। ছিলো ১১ টি ভাষার উপর পূর্ণ দক্ষতা, প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র ও সমকালীন চিকিৎসাতত্ত্ব ও শাস্ত্রগুলো সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ধারণা, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদবিদ্যা, জীববিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রে অগাধ পান্ডিত্য। জার্মানীর এনলার্জেন মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির চূড়ান্ত ডিগ্রি, ডক্টরেট অব মেডিসিন (MD) লাভ করেন এবং তাঁর গবেষণাপত্র এবং অন্যান্য লেখাগুলোর জন্য তৎকালীন সময়ের আদর্শ ও অনুসরণীয় চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃত হন। বর্তমানে যে হিপনোটিজম এবং মেডিটেশনের আরোগ্যক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে, সে সময়ে ছিলো এর তীব্র বিরোধিতা, তৎকালীন বৈজ্ঞানিকদের দৃষ্টিতে- এটা ছিলো প্রচন্ড অবৈজ্ঞানিক (তখন এর নাম ছিলো মেসমেরিজম, ডা. মেসমারের নামানুসারে) কিন্তু তখনও এই দূরদর্শী চিকিৎসক এর স্বীকৃতি দান করেন এবং এটাকে একটি সফল বিকল্প ধারার চিকিৎসার হিসাবে এর সম্ভাব্যতা, সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সুস্পষ্ট সূত্র প্রদান করেন। উনিই প্রথম প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিকে “এলোপ্যাথি” হিসেবে নামকরণ করেন এবং সুস্থ মানবদেহে ঔষধ পরীক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সর্বোপরি উনিই সেই চিকিৎসক, যিনি (সমকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসারে) সফলতার চূড়ান্ত অবস্থায় থাকাকালীন সময়ে ঘোষণা করেন,
“আমি এমন সব ঔষধ- রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করি, যা সম্বন্ধে খুব কমই জানি এবং এগুলো মানুষের শরীরে ঠিক কি ধরণের কাজ করে, এর অর্ন্তনিহিত ক্রিয়াধারা কি- তার প্রায় কিছুই জানি না। কাজেই মানুষের চিকিৎসার নামে তার বৃহত্তর অনিষ্ট সাধনের থেকে অব্যাহতি পেতে হলে এই চিকিৎসাবৃত্তি পরিত্যাগ করা ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা নেই। বরঞ্চ আমি মনে করি আমি যে সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা কোরেছি, তাদের যদি কোন ঔষধই প্রদান করা না হতো তাহলে তারা এখন যা আছেন তার চাইতে ভালো থাকতেন।”

আর এটাই হোচ্ছে হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারের মূলকথা। প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতিতে ঔষধ আবিষ্কারে কোনকালেই চিরায়ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়নি, আজও হয় না। কোন একটা আবিষ্কারের মূল পদ্ধতি হচ্ছে- অনুমান, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ এবং এরপর সিদ্ধান্ত। এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হলে, একটা ঔষধ বাজারজাত করার ২ বৎসর পর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া উপলব্ধি ও আবিষ্কার করে তা প্রত্যাহার করার কথা নয়, যা প্রচলিত পদ্ধতিতে অবিরতই হচ্ছে। আজকের আলোচ্য বিষয় এটি নয়। তাই এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ডা. হানিম্যান ঠিক এই কারণেই, এই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সমর্থন করতে পারেননি বলেই এবং এর থেকে প্রদত্ত ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, স্বাস্থ্যহানি- এগুলোকে আরোগ্যপদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দান করতে পারেননি বলেই, ঐ সময়ই চিকিৎসা বৃত্তি ত্যাগ করেন। এই প্রচন্ড মেধাবী ব্যক্তিটি প্রভূত অর্থ উপার্জন করার অপরিসীম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন ভাষার বইয়ের অনুবাদ করে অতিকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। এবং ১৭৯০ সালে, এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা আবিষ্কার করতে সমর্থ হন যার মূল কথা হচ্ছে “সদৃশ সদৃশকে আরোগ্য করবে” এবং যে প্রাকৃতিক নীতিটিই প্রথম চিকিৎসা ব্যবস্থাতে অনুমান, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও সিদ্ধান্তের চিরায়ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দ্বারা প্রবর্তিত হয়।
কিন্তু তা সত্বেও, আজও হোমিওপ্যাথিকে অবৈজ্ঞানিক, পশ্চাৎপদ, প্রতারণামূলক চিকিৎসাপদ্ধতি হিসাবে প্রদর্শন করার প্রচেষ্টা বিদ্যমান। ব্যাপক অপপ্রচারের দরুণ সাধারণ মানুষের মনেও এই ধারণাই প্রোথিত। যদিও গত কয়েক দশকে এর আরোগ্যক্ষমতার গুণে এ ব্যবস্থাটা বহুলভাবে প্রসার লাভ করেছে এবং জনমনে কিছুটা হলেও ভ্রান্ত ধারণাগুলো ম্লান হয়েছে। হোমিওপ্যাথি রোগ এবং ঔষধের কঠিন কঠিন গালভরা ল্যাটিন নাম দিয়ে সাজানো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, এটা হচ্ছে পদ্ধতিগত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। আর এ কারণেই ২২৫ বৎসর আগে আবিষ্কৃত ঔষধটি একই গতিতে, একই শক্তিতে আধুনিক প্রাণঘাতি রোগগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, মানুষকে আরোগ্য করছে। এর প্রতি শরীরের প্রতিরোধ-ক্ষমতাও তৈরী হয়নি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কোনদিন সৃষ্টি হয়নি, কাজেই আজ পর্যন্ত একটা হোমিওপ্যাথিক ঔষধও বাজার থেকে প্রত্যাহার করার প্রয়োজন পড়েনি, বিকল্প ঔষধ আবিস্কারের প্রয়োজনীতাও অপরিহার্য হয়ে কোনদিন দেখা দেয়নি।

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, কি সেই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা, যা ডা. হ্যানিমান আবিষ্কার করেছেন এবং কিসের ভিত্তিতে দাবী কেরছেন যে তাঁর চিকিৎসা ব্যবস্থাটিই বৈজ্ঞানিক সত্য? এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে, প্রথমেই বলতে হবে- কোন বৈজ্ঞানিক সত্যই মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না, পারে শুধু উদঘাটন করতে, আবিষ্কার করতে। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, বস্তু-শক্তি-সময়ের আপেক্ষিকতা, নিউরনের কার্যপদ্ধতি, জেনেটিক কোড, গ্যাসের গতি, ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ডের বৈশিষ্ট্য, পরমাণুর গঠন, আলোর হিসাব- কোনকিছুই মানুষ সৃষ্টি করেনি। সৃষ্টিকর্তাই সৃষ্টি করেছেন। এটা মহাবিজ্ঞানী স্রষ্টা মহাবিশ্বে যে বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা তৈরী করে দিয়েছেন, যে ফিতরাত বেঁধে দিয়েছেন – তারই বিভিন্ন দিক। মানুষ এগুলো স্রষ্টার দয়ায়, বিশেষ নির্দেশনায় জ্ঞানপ্রাপ্ত হবার পর তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রযুক্তি তৈরী করে, আরাম আয়েশের উপকরণ তৈরী করে। এই বিজ্ঞানগুলোকে ব্যবহারে করেই সে প্রকৃতির অন্যান্য যে শৃঙ্খলা তাদের ক্ষতি করবে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যেমন, খরার সময় কৃত্রিম বৃষ্টি আনয়নের যে পদ্ধতি, তা যৌগটির সাথে বায়ু ও পানির কি প্রতিক্রিয়া হবে সেটা আবিষ্কারের পরই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়ার পদ্ধতি কোন মানুষ সৃষ্টি করেনি। এই ভারসাম্য, এই প্রতিক্রিয়া পদ্ধতি আল্লাহর তৈরী- আমরা এই সত্যটা জানার পর তা ব্যবহার করছি মাত্র।
লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, এই প্রায়োগিক কাজগুলো কিন্তু মূল বৈজ্ঞানিক সত্যটার অনুকূলেই করতে হয়। কেউ যদি মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটাকে অবজ্ঞা করে রকেট চালানোর চেষ্টা করে- তাহলে কি হবে? কিংবা আর্কিমিডিসের সূত্র হিসাবে না রেখে, যদি সাবমেরিন তৈরী করে পানিতে নামানো হয়, তাহলে তাকে কি বলবেন? সবাই বলবে- এটা আত্মহত্যার নামান্তর, এবং কেউই এটাকে বিজ্ঞান বলবেন না। তাহলে আল্লাহ যে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার আরোগ্যপদ্ধতির কি এই রকম কোন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, প্রাকৃতিক নীতি কি স্রষ্টা সৃষ্টি করেননি? এমন কোন প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা কি তিনি সৃষ্টি করেননি, যা দিয়ে মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়?
যদি তা থেকে থাকে, তবে তাকে বলা হবে চিকিৎসাতত্ত্ব। এবার প্রচলিত ধারার চিকিৎসাগুরুদের চিকিৎসার চিরায়ত মূলনীতি ও তত্ত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে দেখুন। প্রশ্ন কোরে দেখুন- রোগ কী? আরোগ্য কী? রোগের কারণ কি? আরোগ্য পদ্ধতি কি? মোটকথা, চিকিৎসাতত্ত্ব কি? কোন প্রাকৃতির শৃঙ্খলার সূত্র দিয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হয় এবং রোগ থেকে আরোগ্য হয়? কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর কারো কাছ থেকেই পাবেন না। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে- যুগে যুগে তারা নতুন নতুন তত্ব হাজির করছেন, আগের তত্ত্ব বাতিল ঘোষণা করছেন। কিন্তু এখানে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন এসে যায়, সত্যকে বা সত্যের উপর ভিত্তি করা তত্ত্বকে কি বাতিল করা যায়? আর্কিমিডিসের সূত্র, পিথাগোরাসের সূত্র, নিউটনের সূত্র, আইনস্টাইনের সূত্রকে কি বাতিল করা গেছে?
সত্য সর্বসময়ই একক, শ্বাশ্বত, ধ্রূব, অপরিবর্তনীয়। একসময় পৃথিবীকে সমতল বলে ধারণা করা হতো। ধারণা করা হতো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কিন্তু তখনও পৃথিবী গোলাকারই ছিলো এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতো। গ্যালিলিওকে পুড়িয়ে মেরেও এই সত্যের ব্যতিক্রম হয়নি। এই সত্যকে আর আপডেট করার প্রয়োজন হয়নি, কারণ সত্যের আধুনিকায়ন হয় না। বাতিল হওয়া প্রাচীন ধারণাগুলো- পৃথিবী সমতল বা সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার ধারণাগুলো যখন বাতিল হলো, তার আগ পর্যন্ত কিন্তু ওগুলোকেও বৈজ্ঞানিক সত্যই মনে করা হতো (যদিও কোন প্রকৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে এই ধারণাগুলো করা হয়েছিলো না, যেমনটা আজকের চকচকে প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় করা হয় না )।
আজ প্রচলিত ধারার চিকিৎসকগণ, তাদের ঔষধপ্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন তত্ত্ব, নতুন ঔষধ, নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা উদ্ভাবন করে সগর্বে দাবী করেন যে, তারা চিকিৎসাব্যবস্থার আধুনিকায়ন সম্পন্ন করছেন। কিন্তু এ কথা আশ্চর্য- এত মেধাবী লোকগুলো এটা ভেবে দেখেন না, এটা তাদের দুর্বলতারই নামান্তর, তাদের ভিত্তিহীনতারই প্রমাণ। এটা প্রমাণ করে যে, তারা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রাকৃতিক, ধ্রুব, অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত মূলনীতি আবিষ্কার করতে সমর্থ হননি।

আর এখানেই ডা. হানিম্যানের কৃতিত্ব। এই মহাবিজ্ঞানী ২৩০ বৎসর আগে আবিষ্কার করেছেন, মানুষের রোগের কারণ কী? রোগতত্ত্ব কী? আরোগ্য প্রক্রিয়া কি? আজ সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যত হোমিওপ্যাথ আছেন, সবাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন- সবাই একবাক্যে একই উত্তর দেবেন এবং সেই অনুসারে মানুষকে আরোগ্য করে দেখাবেন। ২৩০ বছরেও এই সত্যকে আপডেট করার প্রয়োজন হয়নি। এটা যদি পশ্চাৎপদতা হয়, তবে আর্কিমিডিস, নিউটন, নিলস বোর, পিথাগোরাস, গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, এরিস্টটল এরা সবাই পশ্চাৎপদ, এদের তত্ত্বগুলোও ব্যবহার অযোগ্য, পরিহারযোগ্য।
মনে রাখবেন, ডা. হানিম্যান প্রচলিত ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা ত্যাগ করার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন, ঔষধের ক্রিয়াধারা ও মানবশরীরে এর প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অজ্ঞতাকে। এই অজ্ঞতা শুধু তার একার ছিলো না, কারণ উনি ছিলেন সবোর্চ্চ ডিগ্রিধারী প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক। সমকালীন সময়ে তার লেখাগুলোকে চিকিৎসাক্ষেত্রে অনুসরণীয় নির্দেশনা হিসাবে গ্রহণ করা হতো। এই অজ্ঞতা ছিলো পুরো ব্যবস্থাটার এবং তা আজো রয়ে গেছে। ইন্টারনেট বা প্র্যাকটিস অভ্ মেডিসিনের বই খুলে একটা ঔষধ সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে দেখুন। দেখবেন বলা হচ্ছে, এই ঔষধের এই এই স্বল্পমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, দীর্ঘমেয়াদী এই এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং আরো কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অজ্ঞাত। পরে যখন এই অজ্ঞাত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর কিছু কিছু জ্ঞাত হয় এবং লাভের চাইতে লোকসানের পাল্লা ভারী হয়, এবং কোথাও কোথাও প্রতিবাদ হয়, মামলা হয় তখন ঔষধটিকে বাতিল ঘোষণা করা হয়। এরপর নতুন করে শুরু হয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলা।
যাই হোক, আমি জানি, আমার একদিনের একটা আর্টিকেলে বা একটা কথায় এতদিনকার সঞ্চিত ও পরিপোষিত বিভ্রান্তি দূর হবে না। আদৌ কোন আচঁড় কাটবে কিনা সন্দেহ। আমার এই লেখার পরে, আরও নতুন নতুন প্রশ্ন জাগবে। প্রশ্ন জাগবে, তাহলে কেন হোমিওপ্যাথির মতো বৈজ্ঞানিক সত্য অন্যান্য বিজ্ঞানগুলোর মতো প্রতিষ্ঠিত হয় নি? কেন প্রচলিত ধারার চিকিৎসকদের হোমিওপ্যাথির প্রতি এত তীব্র বিরোধিতা ও সঞ্চিত ক্ষোভ? কেন আপনি বা আপনার অমুক আত্মীয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করেও সুস্থ হননি? ইত্যাদি ইত্যাদি। ইনশা-আল্লাহ, হয়তো অন্য কোন লেখায় আপনাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করবো। কারণ, পরিসংখ্যান যাই বলুক (পরিসংখ্যানে তা প্রস্তুতকারী কর্তৃপক্ষের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ইত্যাদি সংক্রান্ত সুবিধা-অসুবিধা যে তাকে প্রভাবিত কেরবে না , তা কে বলতে পারে!), আমরা আমাদের নিজেদের এবং পারিপার্শ্বিকতার দিকে তাকালেই আজ এই ভ্রান্তি নিরসন করে, চিকিৎসাব্যবস্থাকে শাশ্বত, চিরায়ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা হিসেবে প্রাপ্তির প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করতে পারবো।