হোমিওপ্যাথিতে থেরাপিউটিকস বই পড়া বা শিখা

-ডা. রবিন বর্মন
এখনই অনেকে বলতে পারে– স্যার, আপনি থেরাপিউটিকস জাতীয় বইগুলি বেশী পড়তে বারণ করেন, বা পছন্দ করেন না, অথচ অনেক থেরাপিউটিকস বইয়ের কথা বলছেন, ছবি দিচ্ছেন, তাহলে ব্যাপারটা কন্ট্রাডিক্টরি হচ্ছে না?
উত্তর —–যে কোনো রোগ ও তার ঔষধ নিয়ে আলোচনা করা বইয়ের নামই হলো থেরাপিউটিকস, এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেরাপ্-টিকস থেকে। যাই হোক— হোমিওপ্যাথি যেহেতু রোগের চিকিৎসা করে না রোগীর চিকিৎসা করে, সেই জন্য এই রোগের -এই ঔষধ —এই পদ্ধতিত আমাদের চিকিৎসা হয় না, আর সেজন্যই থেরাপিউটিক ওয়েতে চিকিৎসা করার কথা বারণ করা হয়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ফলপ্রসূও হয় না, অর্থাৎ আরোগ্য স্থায়ী হয় না।
কিন্তু, নানা রকম থেরাপিউটিকস বই পড়তে বা দেখতে কারুর বারণ নেই,
দরকার যেটা—-
থেরাপিউটিকস বই পড়ে, সেই নলেজ নিয়ে রোগীতে ঔষধ সিলেকশন করতে তার ইম্প্লিকেশন, বা অ্যাপ্লিকেশন হবে জুডিশিয়াল ,
যেমন—-অ্যাপেন্ডিসাইটিসের থেরাপিউটিক বইয়ে অনেক লক্ষনের অনেক ঔষধের কথা বিভিন্ন ভাবে বলা থাকতে পারে–
দুই একটি উদাহরণ দিই —
উদাহরণ—-১)
★ পেটের ব্যথা সকাল ৭ টায় বাড়ে, একটাই ঔষধ আছে— ইউপেটোরিয়াম পার্ফ– ফার্স্ট গ্রেডে,
কোন চিকিৎসক তার একটি রোগীর এ্যাপেনডিকুলার ব্যথা সকাল ৭ টায় বাড়ে বলে ইউপেটোরিয়াম ঔষধটি প্রেসক্রাইব করলেন, কারন থেরাপিউটিক বইয়ে ইউপেটোরিয়াম ঔষধটি সকাল ৭ টায় ব্যথা বাড়ে ফার্স্ট গ্রেডে আছে,
কিন্তু এই ইউপেটোরিয়াম প্রেসক্রিপশনে হয়ত তার সেই রোগীর কোন কাজ না হতেও পারে, কারন তার রোগীর হাতে, পায়ে বা শরীরের অন্য কোথাও হাড় ভাঙা ব্যথা লক্ষনটি নেই, যেটি ইউপেটোরিয়াম পার্ফ র একটি প্রধান চরিত্রগত লক্ষন,
—- তাহলে এই ক্ষেত্রে থেরাপিউটিক ধরে ঔষধ দিয়ে কোন লাভ হল না,
কারন– চিকিৎসক –থেরাপিউটিকস বইয়ে দেওয়া সকাল ৭ টায় এ্যাপেনডিকুলার ব্যথার বৃদ্ধির জন্য ফার্স্ট গ্রেডের ঔষধটি প্রেসক্রিপশন করল বটে, কিন্তু ইউপেটোরিয়ামের যে মেইন সিমপটম— সারা শরীরের হাড়গোড়ের মধ্যে অসম্ভব ব্যথা,
— এই কার্ডিনাল সিমপটম না থাকলে যে ইউপেটোরিয়াম দেওয়া যাবে না, তা ভাবে নি, ফলে তার রোগীর এ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথা কমবে না, কারন এক্ষেত্রে ইউপেটোরিয়ামের কার্ডিনাল সিমপটম কাভার করে নি,
যদি, সকাল ৭ টায় বৃদ্ধি + হাড়ভাঙা ব্যথা যদি ঐ রোগীর ক্ষেত্রে মিলত, তাহলে ইউপেটোরিয়াম ঔষধ সিলেকশন ঠিক হতো এবং হয়ত রোগী উপকার পেতো,
উদাহরণ —২)
ধরা যাক— অন্য একজন চিকিৎসকের এক এ্যাপেনডিসাইটিসের ব্যথার রোগীর ব্যথা বিকাল ৪ টার পর থেকে বাড়তে আরম্ভ করে,
থেরাপিউটিক বই খুলে দেখা গেল— ২ টি ঔষধ দেওয়া আছে– লাইকো– ফার্স্ট গ্রেড, এবং এলুমিনা — থার্ড গ্রেড,
এখানে সেই চিকিৎসক -ব্যথা ৪ টায় বাড়ে ফার্স্ট গ্রেডে লাইকো আছে বলে লাইকো প্রেসক্রিপশন করলেন,
কারন তার মাথায় ঢুকেছে, বা সে প্রেজুডিসড হয়েছে যে, রেপার্টরীর বা থেরাপিউটিকসের
ফার্স্ট গ্রেড বা প্রথম শ্রেনীর লক্ষনের দাম সব থেকে বেশী, কিন্তু দেখা গেল লাইকো প্রেসক্রিপশনের পরে একটা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করেও কোন কাজ হলো না,
সে হয়ত সিনিয়রদের বলতেও থাকলো–
স্যার, লাইকোর সব সিমপটমস থাকা সত্বেও কোন কাজই হলো না,
ধরা যাক, এই রোগী পরে অন্য একজন হোমিও চিকিৎসককে দেখলেন, তিনিও বিকাল ৪ টার পরে পেট ব্যথা বাড়ে শুনে থেরাপিউটিকস বা রেপার্টরী বই খুলে দেখলেন, ঐ লাইকো ফার্স্ট গ্রেড, এবং এ্যালুমিনা থার্ড গ্রেডে আছে,
কিন্তু —তিনি ভাল করে কেস টেকিং করে টোটাল সিমপটোমেটোলজী থেকে লাইকোর অন্যান্য সিমপটমস তেমন কিছু পেলেন না, বরং পেলেন–
* রোগীনী খুব কোষ্ঠবদ্ধতায় ভোগে,
* আলু খেতে চায় না – কারন আলু খেলে তার পায়খানা আরও শক্ত হয়,
* তার প্রচুর পরিমানে সাদা স্রাব হয়,
* তার মাসিকের সময় খুব দূর্বলতা বোধ হয়,
* আর তার পায়ে একটা চর্মরোগ আছে যা শীতকালে বাড়ে,
— তাহলে সে দেখলো রোগিনীর সব সিমপটমস এলুমিনা কাভার করছে, ইনক্লুডিং তার এ্যাপিন্ডিসাইটিসের ব্যথাও বিকাল ৪ টায় বাড়ে — যা থেরাপিউটিকসে এ্যালুমিনা দেওয়া আছে — যদিও থার্ড গ্রেডে,
তাই কেস টেকিং, মেটিরিয়া মেডিকা আর থেরাপিউটিকসের ইন্টিগ্রেটেড এ্যাপরোচে, অর্থাৎ সম্মিলিত সমন্বয়ে এলুমিনা ঔষধটি প্রেসক্রাইব করা সহজ ও নীতি সাপেক্ষে হলো, এবং রোগীর আরোগ্যও ত্বরান্বিত হলো,
তাহলে এখানে দুটি জিনিস দেখার বা শেখার আছে–
১) শুধু থেরাপিউটিকস বা রেপার্টরী দিয়ে একটি বা দুইটি সিমপটমসের উপরে ঔষধ সিলেকশন করলে তা সঠিক না হওয়ার সম্ভাবনা বেশী,
— তাই শুধু থেরাপিউটিকস নির্ভর চিকিৎসা করতে বারন করা হয়,
২) কেবল মাত্র রেপার্টরী বা থেরাপিউটিকসের ফার্স্ট গ্রেড বা প্রথম শ্রেনীর সিমপটমস নিলেই যে বাজী মাত হবে, তা নয়, তা করলে সঠিক প্রেসক্রিপশন মোটেই করা যাবে না, তা মোটেই ঠিক নয়, গ্রহণযোগ্য নয়,
কারন—–
বহু ক্ষেত্রে সেকেন্ড গ্রেড বা থার্ড গ্রেডের ঔষধও–
a mouse can help a lion র মতন, অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে।
তাই কেবলমাত্র রেপার্টরী বা থেরাপিউটিকসের প্রথম শ্রেনীর লক্ষন জানলে বা পড়লে যে শুধু সেই কয়েকটি ঔষধের উপর ভিত্তি করে আমাদের প্রেসক্রিপশন হবে, সঠিক ঔষধ সিলেকশন হবে তা মোটেই বলা যাবে না, তা মোটেই করা যাবে না,
*প্রথম শ্রেনীর লক্ষন ( বোল্ড) ,
বেশীর ভাগ প্রুভারের মধ্যে পাওয়া গেছে,
*দ্বিতীয় শ্রেনীর লক্ষন ( ইটালিক) — কিছু কম সংখ্যক প্রুভারের মধ্যে পাওয়া গেছে, কিন্তু বহু ক্লিনিকাল কেসে বহুবার পুনঃ পরীক্ষিত হয়েছে,
* আর তৃতীয় শ্রেণীর লক্ষন প্রুভিংয়ের সময় অল্প কিছু লোকের মধ্যে পাওয়া গেছে এবং মাঝেমধ্যে ক্লিনিক্যালি প্রুভড হয়েছে,
তাই সেকেন্ড গ্রেড বা দ্বিতীয় শ্রেনীর লক্ষন, এবং থার্ড গ্রেড বা তুতীয় শ্রেণীর লক্ষনগুলি ফ্যালনা জিনিস নয়, তাদের খুব কম দাম দেবো তা কিন্তু নয়,
তাছাড়া প্রথম শ্রেনীর লক্ষন কয়টি? মেটিরিয়া বা রেপার্টরীর ৮০ ভাগ সিমপটমস দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেনীর সিমপটমস, ( ইটালিকস বা নর্মাল টাইপের ) ,
তাই প্রথম শ্রেনীর সিমপটমসের ঔষধ গুলি আমরা দেখতে পারি, মুখস্ত রাখতে পারি, অবশ্যই গুরুত্ব দিতে পারি, কিন্তু তার মানে এই নয় যে কেবল ঐ সিমপটমসগুলি দিয়েই আমরা সব কেসেই সঠিক প্রেসক্রিপশন করতে পারবো।
তাই, শুধু থেরাপিউটিকস নির্ভরতার অনেক অসুবিধা, এবং রোগী আরোগ্যের পরিবর্তে অনারোগ্যই বেশী হবে, কারন হোমিওপ্যাথিক নিয়ম ও নীতি ফলো হয় না,
আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক–
চর্ম রোগের থেরাপিউটিকস বইয়ে একজিমার জন্য গ্রাফাইটিসে বলা অাছে–
–চটচটে, আঠার মতন রস বেরুলে গ্রাফাইটিস ,
কিন্তু, শুধু এই একটি পার্টিকুলার সিমপটমসে গ্রাফাইটিস দিলে এ্যালোপ্যাথিক ঔষধের মতন রোগীর একজিমা সাময়িক কমতে পারে , যাকে বলা হয়—Surface Palliation ,
কিন্তু অর্গাননের ৬৪ নং এ্যাফরিজমে বলা অাছে —- রোগটি কিছুদিন পরে ডাবল বেগে ফিরে আসবে,
The primary action will soon follow the secondary counter action,
কিন্তু, এক্ষেত্রে হয়ত গুছিয়ে কেস টেকিং করলে দেখা যেতো – গ্রাফাইটিসের —মিষ্টি খেতে চায় না, দেখতে মোটাসোটা, শীত বেশী, সেক্স আর্জ কম, চট করে কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কোষ্ঠবদ্ধতা, ইত্যাদি, কিছুই নেই, আবার ঘায়ের রসটা সত্যিই আঠালো বা চটচটে কি না তাও নিজে কোন কাগজে এক ফোঁটা নিয়ে চিকিৎসক পরীক্ষা করে নি, রোগী বলেছে তাই লিখেছে , এমনও হতে পারে তার একজিমার রস আসলে পাতলা, আঠাআঠা নয়, রোগী গুরুত্ব না দিয়ে যাহোক কিছু বলে দিয়েছে, যা ভেরিফাই করা হয় নি,
কিন্তু একটু গুছিয়ে কেস টেকিং করলে হয়ত দেখা যেতে পারে–
★ তার এই চর্মরোগটি ছোট থেকেই, সে অনেকবার অনেক রকম মলম লাগিয়েছে,
★ সে মিষ্টি খেতে ভালবাসে,
★ সে স্নান করতে পছন্দ করে না,
★ সে সকালে ঘুম থেকে উঠেই মলত্যাগ করতে দৌড়ায়, ইত্যাদি,
তাহলে থেরাপিউটিকসের উপরে নির্ভর করে গ্রাফাইটিসের কোন সিমপটমস না থাকা সত্ত্বেও জোর করে গ্রাফাইটিস দিয়েছিলাম, আর সব সিমপটমস সালফারের হওয়া সত্ত্বেও থেরাপিউটিকস নির্ভরশীল হয়ে সালফারের কথা একবারও ভাবিনি,
তার মানে থেরাপিউটিকস নির্ভরশীল হয়ে সারা জীবন পড়া– রোগের নয়, রোগীর চিকিৎসা করতে হবে,
এই ডিকটিমটা বেমালুম ভুলে গিয়ে,
একজন রোগীর চামড়া নিয়ে পড়ে ছিলাম, তার ভিতরের সত্ত্বা, বা ভিতরের মানুষটির আইডেনটিকাল সিমপটমস সব নিতে হবে বা দেখতে হবে ,
তা একবারও ভাবার অবকাশ হয় নি,
তাই বারে বারে বলছি—
এসব থেরাপিউটিকস বই অবশ্যই দেখা যেতে পারে ,
পড়া যেতে পারে,
বাড়ীত নিশ্চয় রাখা যেতে পারে,
কিন্তু ঔষধ সিলেকশন হবে–
কেস টেকিং করে,
সব সিমপটমস মিলিয়ে,
মায়াজম এ্যানালিসিস করে,
রোগীর ইন্টিগ্রেটেড এ্যাপরোচ নিয়ে,
—–যা সম্ভব –হোমিওপ্যাথিক মেটিরিয়া মেডিকা ও হোমিওপ্যাথিক ফিলজফির সমন্বিত নলেজ দিয়ে,