হোমিওপ্যাথিক ঔষধের শক্তি ও মাত্রা তত্ত্ব

যে সকল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকগণ দশমিক ও শততমিক ঔষধ ব্যবহারের পক্ষে কথা বলেন সে সকল চিকিৎসকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি আপনারা জেগে জেগে ঘুমানোর ভান করেন কেন ? নতুন ডাক্তারদেরকে বিভ্রান্তিতে রেখে।
আপনারা হোমিওপ্যাথির মূলকথা সবই জানেন, তাহলে নতুনদেরকে কেন সব কথা খোলাখুলি বলছেন না। যাদের হোমিওপ্যাথিতে গ্রহণযোগ্যতা আছে তাদের এ ব্যাপারে কথা বলা উচিৎ।
বর্তমান সময়কাল বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথির সকল চাওয়া পাওয়া পূরণের উপযুক্ত সময়। এই সময় আমাদের যা প্রয়োজন তা সরকারের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়ার উপযুক্ত সময়। এখন আর পূর্বে সমাধান হয়ে আছে এমন বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে কি ?
হোমিওপ্যাথির মূলনীতি অনুযায়ী যেসব চিকিৎসক চিকিৎসাকার্য পরিচালনা করেন না, তাদের মহাত্মা হ্যানিম্যান অভিশাপ দিয়েছেন।
বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক মহামতি ডা. কেন্ট বলেন, ‘যে মুহূর্তে তুমি সততা বিসর্জন দিয়া মনে করিবে মানুষ আপন ইচ্ছামতো কাজ করিতে পারে, সেই মুহূর্তেই নীতি-সংশ্নিষ্ট সমুদয়ই তুমি হারাইলে এবং সাফল্যের ভিত্তি হইতে তোমার অধঃপতন হইল’।
হোমিওপ্যাথির নিয়ম অনুযায়ী রোগীর জন্য নির্বাচিত ওষুধ হতে হবে অত্যন্ত সূ²। কারণ, আমাদের জীবনীশক্তি অতীন্দ্রিয় অশরীরী শক্তি তাকে প্রাণক্রিয়া নামে অভিহিত করা হয়েছে, যা দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না আকার-আয়তনহীন অথচ তার অস্তিত্ব বিরাজমান। এই শক্তিস্তরে কোনো বস্তু বা জড় পদার্থ পৌঁছানো সম্ভব নয়, যতক্ষণ না ওষুধ বস্তুকে হোমিওপ্যাথিক নিয়ম অনুযায়ী শক্তিকরণ করা হয় সূ² থেকে সূ²তর স্তর পর্যন্ত। হোমিওপ্যাথিক শক্তিকৃত ঔষধের মধ্যে ঔষধ বস্তুর বস্তুগত কোনো অবস্থা বিরাজমান থাকে না। ঔষধ শক্তিকরণের মাধ্যমে জড়ত্বমুক্ত হয়। আর এই জড়ত্বমুক্ত ঔষধ দ্বারা আদর্শ আরোগ্য করা হয়।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনটি পদ্ধতিতে ঔষধ শক্তিকরণ করা হয়। যথা-
১. দশমিক পদ্ধতি
২. শততমিক পদ্ধতি
৩. ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতি
পৃথিবীতে যত চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে তার মধ্যে সর্বদিক বিবেচনায় হোমিওপ্যাথি ২য় অবস্থানে।
পৃথিবীতে যত চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে তার কোনটিরই আবিষ্কারক সংবিধান পর্যন্ত করে যেতে পারেন নাই। একমাত্র আবিষ্কারক মহাত্মা হ্যানিম্যান, যিনি চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করে সংবিধান পর্যন্ত তৈরি করে গেছেন। তাতে লাভ কি হলো! যেটুকু করে গেছেন সেখানেই থেমে আছে, মহাত্মা হ্যানিম্যানের রেখে যাওয়া হোমিওপ্যাথি।
মনের কষ্টে বারবার একটি কথা বলি- সকল প্যাথি যাচ্ছে তাদের মতে, উন্নতির দিকে আর আমরা যাচ্ছি পিছনের দিকে।
আমার এই কথার প্রমাণ যদি পাইতে বা দেখতে চান তা হলে বিভিন্ন হোমিওপ্যাথিক চেম্বারের দিকে তাকালেই বুঝে যাবেন আমি কেন এই কথা বলছি। আপনি কোন কোন হোমিওপ্যাথিক চেম্বারের সাইনবোর্ডটি যদি সরিয়ে ফেলেন, বুঝতেই পারবেন না এটা কিসের ফার্মেসী, হারবাল না ইউনানী, না এলোপ্যাথি। ডাক্তারের কাছে জানতে হবে ভাই এটি কিসের ফার্মেসী ? কারণ চেম্বারের তাক-এ শুধুই সিরাপের বোতল যেটি হোমিওপ্যাথির সাথে কোনই মিল নাই।
মহাত্মা হ্যানিম্যান সিরাপ ছেড়ে সদৃশবিধান চালু করলেন, আর আমরা হোমিওপ্যাথির সাইনবোর্ড দিয়ে হ্যানিম্যানের ছেড়ে আশা সেই বিষাক্ত সিরাপ বিক্রি করছি।
আজ পর্যন্ত হ্যানিম্যান বেঁচে থাকলে ঔষধের শক্তিকরণ পদ্ধতি তিন ধাপ থেকে ত্রিশধাপে সামনের দিকে উন্নিত হতো।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূলনীতি রোগীকে একটি মাত্র ঔষধ শক্তিকৃত ও সূ²মাত্রায় প্রয়োগ করা। এই শক্তিকৃত ও সূ²মাত্রা যতবেশী সামনের দিকে যাবে হোমিওপ্যাথির স্বাদ ততবেশী জনগণ ও চিকিৎসকরা ভোগ করবে।
যে সব হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক দশমিক ও শততমিক ঔষধ ব্যবহারের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শ দেন, সে সকল চিকিৎসকগণ যা বলেন, তহলো-
১. যখন ঔষধ লক্ষণ ও রোগীর লক্ষণ বহুল অংশে মিলে যায় বিশেষ করে মানসিক লক্ষণ তখন আপনি উচ্চ শক্তি ব্যবহার করতে পারবেন।
২. যখন ঔষধের মানসিক লক্ষণ ও রোগীর মানসিক লক্ষণ খুবই কম মিলে তখন আপনি নিম্নশক্তি ব্যবহার করতে পারবেন।
৩. রোগী যদি শারীরিক পরিশ্রম খুবই কম করেন অর্থাৎ অফিসে বসে বসে কাজ করে, মানসিক চাপ বেশি থাকে শারীরিক কোন ধরণের পরিশ্রম হয় না এমন রোগীকে উচ্চ শক্তি দেওয়া যেতে পারে।
৪. রোগী যদি মানসিক পরিশ্রম কম ও শারীরিক পরিশ্রম বেশী করেন তাহলে নিম্নশক্তি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৫. রোগীর রেজিষ্ট্যান্ট পাওয়ার, জীবনী শক্তি ভাল থাকলে যেমনটা কিশোর ও যুবকদের দেখতে পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে উচ্চ শক্তি দেওয়া যেতে পারে।
৬. রোগীর বয়স বেশী, রেজিষ্ট্যান্ট পাওয়ার কম, জীবনী শক্তি দুর্বল এমন হলে নিম্নশক্তি দ্বারা চিকিৎসা করা ভাল।
৭. যদি ঔষধ নোসড হয় তাহলে নিম্ন শক্তি না দিয়ে মধ্যম বা উচ্চ শক্তি ব্যবহার করে রোগীর চিকিৎসা করা ভাল।
৮. রোগীর শারীরিক লক্ষণ বেশী এবং মানসিক লক্ষণ কম এমন অবস্থায় রোগীকে নিম্নশক্তি দেয়া উত্তম।
৯. যখন প্যাথলোজিক্যাল সিম্পটম বেশী কিন্তু মানসিক লক্ষণ কম এমন ক্ষেত্রে নিম্নশক্তি ব্যবহার করা ভাল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে আলসার, ক্ষত।
১০. রোগী দেখার সময় যদি এমন মনে হয় যে রোগ তীব্র আকার ধারণ করেছে উদহারন স্বরূপ টিউবারকিউলোসিস, এইচআইভি, ক্যান্স্যার এর শেষ অবস্থা হলে নিম্নশক্তি ব্যবহার করাই ভাল।
১১. কিছু কিছু রোগী তীব্র ড্রাগ সেনসিটিভ হয়ে থাকে। সামান্য ঔষধ প্রয়োগেই ক্রিয়া প্রকাশ পায় এমন রোগীর ক্ষেত্রে নিম্নশক্তি ব্যবহার করা ভাল।
১২. এমন কিছু ঔষধ আছে যেমন, হিপার সালফ, সাইলিসিয়া মেটেরিয়া মেডিকাতে কোন কোন ডাক্তারগণ উল্লেখ করেছেন নিম্নশক্তিতে যে ধরণের ক্রিয়া প্রকাশ করে উচ্চ শক্তিতে তার বিপরীত ক্রিয়া করে থাকে। উদহারণ স্বরূপ বলা যেতে পারে সাইলিসিয়া নিম্নশক্তি পুঁজ উৎপাদন করে কিন্তু উচ্চ শক্তিতে তা শুকিয়ে দেয়।
১৩. কিছু ঔষধ নোসড নয় তবু তীব্র ক্রিয়া প্রকাশ করে যেমন ফসফরাস, সাইলিসিয়া তীব্র ও দীর্ঘ ক্রিয়া প্রকাশক। এ ধরণের ঔষধগুলি ব্রঙ্কাইটিস, টিউবারকিউলোসি এর মত তীব্র পীড়াদায়ক রোগে ব্যবহার করলে রোগীর শরীরে তীব্র ক্রিয়া প্রকাশ পায়; রোগীর রোগ কষ্ট বেড়ে যায়। তাই শুধু রেপার্টরি নির্ভর না করে মেটেরিয়া মেডিকা অনুসরণ করে ঔষধের মেরিট অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র করা উচিত।
যে সকল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এত কষ্টকরে চিকিৎসকদের এত সুন্দর পরামর্শ দিচ্ছেন, সহজ করে একথা বললেইতো পারেন যে একে বারেই পার্শ প্রতিক্রিয়া মূক্ত ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করতে পারেন। তা হলে আপনাদের এত কষ্টকরে পুরাতন ভাঙ্গা গাড়ী চালানোর নিয়োম কানুন বারবার বাতলাতে হতো না।
শোনেন ডাক্তার ভাইরা একটা গল্প বলি- কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এক ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে, যে সব যাত্রী ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন তাদের কাছে একই ভিক্ষুক একাধিক বার আসছে, তখন পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন এই যে ভিক্ষুক তুমি কিছুক্ষণ আগেই কেবল ভিক্ষা নিয়ে গেলে আবার এসেছ কেন? ভিক্ষুক জবাব দিচ্ছে ভাইসব আপনাদের এই এক দোষ সব সময় অতীত নিয়ে পরে থাকেন এই জন্য আমাদের দেশে কোন উন্নতি হয় না।
যে সকল চিকিৎসক দশমিক ও শততমিক পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করেন তাতে আমাদের কিছুই আসে যায় না। কিন্তু পিছনে রেখে আসা পদ্ধতি ব্যবহারের অন্যদের উৎসাহিত করবেন না।
আমার কাছে আসেন এমন ডাক্তারা কখনো প্রশ্ন করেন না যে কোন পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করবে ? কারণ যে সব চিকিৎসক আমার কাছে যাতায়াত করেন সকলে ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ ব্যবহার করেন। বিভিন্ন সময় ফোন করে জানতে চান কোন পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করবে। তখন যদি বলি ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করেন। তখন প্রতি উত্তরের বলেন সম্পূর্ণ সাদৃশ্য না হলে নাকি ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির ঔষধ কাজ করে না ? ঠিক সেই মূহুর্তে ভাবতে থাকি এখন কি দশমিক ও শততমিক ব্যবহারের সমস্যার কথা বলবো না ৫০ সহস্রতমিক পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহারের সুবিধার কথা বলবো।
যে সব লোক উল্টো দিকে চলে তাদের এই চলার পক্ষে কিছু যুক্তি তৈরী করা থাকে। আর যে সব চিকিৎসক দশমিক ও শততমিক পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করেন তাদের কিছু হতাশার কথা আছে যার দিকে আমরা কেউ কর্ণপাত ও করি না। তাদের একটাই কথা এত রোগ এত ঔষধ কি করে পার্থক্য করি তাই কোন রকম সাদৃশ্য হলেই ঔষধ একটি দিয়ে দেই।
দশমিক ও শততমিক ব্যবহারের অসুবিধার কথা বাদদিয়ে ৫০ সহস্রতমিকের সুবিধার কথা বলছি, যথা-
১. সুনির্বাচিত ঔষধ প্রতিদিন বা প্রয়োজনে ঘন্টা পরপর বা একই ঔষধ শক্তি বৃদ্ধি করে মাসের পর মাস একই রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে।
২. এই পদ্ধতির ঔষধের ক্রিয়া দ্রæত এবং মৃদুতম।
৩. এই পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহারে রোগী অতি দ্রæত আরোগ্য লাভ করে।
৪. এই পদ্ধতির ঔষধ উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন।
৫. এই পদ্ধতির ঔষধের ক্রিয়ায় বিপজ্জনক তীব্রতা বা বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না।
৬. এই পদ্ধতির ঔষধ তরুন রোগে ব্যবহারের সময় প্রয়োজনে একই দিনে ঔষধ পরিবর্তন করা যেতে পারে।
৭. এই পদ্ধতির ঔষধ পুরাতন রোগে ব্যবহারের সময় দশমিক ও শততমিক পদ্ধতির ঔষধের মত ক্রিয়াকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয় না, কারণ ইহার ক্রিয়া কাল স্বল্প, তাই ১/২ দিন ঔষধ বন্ধ রেখেই পরবর্তি ঔষধ প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৮. এই পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহারের সময় ঔষধ জনিত বৃদ্ধি হলে ২/১ দিন ঔষধ বন্ধ রাখলেই বৃদ্ধি কেটে যায়।
৯. চিকিৎসক একবার ঔষধ সংগ্রহ করে নিজেই শক্তির পরিবর্তন করা শিখে নিলে, সহজে আর ঔষধ কেনার প্রয়োজন হয় না। এটা কি চিকিৎসকের সুবিধা নয়।
১০.এই পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহারে রোগীদের ঔষধ জনিত বৃদ্ধিও কম দেখতে পাওয়া যায়।
১১. এই পদ্ধতির ঔষধ প্রয়োজনে এই মাত্র জন্ম হওয়া শিশুকেও দেওয়া যেতে পারে। তবে কাপিং করে।
১২. এই পদ্ধতির ঔষধ ব্যবহারে ঔষধের ফলাফল কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়।
১৩. হোমিওপ্যাথিক ঔষধে প্রথমে বাড়ে পরে কমে এ কথা সাধারন মানুষের মুখে মুখে, আর যে সকল চিকিৎসক ৫০ সহস্রতমিকপদ্ধতির ঔষধ ব্যবহার করেন তাদের সামনে এই কথা কোন রোগী বলতে পারে না। কারণ এই পদ্ধতিতে শক্তিকৃত ঔষধের বৃদ্ধি সামান্যতম, নাই বললেই চলে।