হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রা ও শক্তি নির্বাচন

মহাত্মা হ্যানিম্যান বলিয়াছেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সাফল্যের জন্য নির্ভুল ঔষধ নির্বাচনই যথেষ্ট নহে, পরন্তু কিরুপ ক্ষেত্রে কত শক্তির কি পরিমান বা মাত্রা প্রয়োগ করা উচিত সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা উচিত।
আমরা সকোলেই জানি হোমিওপ্যাথিতে রোগ বলিতে কোন স্হুল বস্তু বুঝায় না এবং তাহা আমাদের সুস্হ্য দেহকেও আক্রমণ করে না। সোরা যাহাকে আমি যৌন চেতনার বিকৃত পরিণতি বলিয়া মনে করি, তাহারই অধিকারে আমাদের জৈব প্রকৃতি রস্ স্বাভাবিক গতি বা রীতিনীতি বিশৃঙ্খলা হইয়া পড়িলে দেহ ও মনে যে অস্বাভাবিক অনুভুতি ও অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, ব্যাধি তাহার নামান্তর মাএ। ইহা কোন স্হুল ব্যাপারে নহে, কাজেই প্রতিকার কল্পে আমরা যে উপায় অবলম্বন করিব তাহা স্হুল হইলে চলিবে না। এইজন্য রোগশক্তির সমকক্ষ করিয়া তুলিবার জন্য ঔষধকেও সুক্ষ্ অথচ শক্তিশালী অবস্হায় লইয়া যাওয়া উচিত। উহাকে Dynamization বা তীক্ষ্ণ করা বুঝায়। Dilution ভুল এইজন্য যে তাহার অর্থ তরল করা।
অনেকের ধারণা এই যে, ঔষধ সুনির্বাচিত হইলে শক্তি নির্ণয়ের জন্য মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন নাই, যে কোন শক্তিতেই তাহা কাজ করিবে। এ ধারণা যথার্থ নয়। কারণ, ব্যবহারের ক্ষেএে দেখা যায়, মানসিক পীড়া প্রধান রোগীকে কোন সুনির্বাচিত ঔষধের নিম্ন শক্তি দিয়ে কোন ফল পাওয়া যায় নাই। সেখানে হয়তো সেই ঔষধের উচ্চতর শক্তি প্রয়োগ করিয়াই বিশেষ ফল পাওয়া গিয়াছে। তা ছাড়া রাসায়নিক ও খনিজ পদার্থ হইতে প্রস্তুত অনেক ঔষধ যেমন– সালফার, ক্যালকেরিয়া কার্ব্ব, নেট্রাম-মি, সাইলিসিয়া, ফেরাম, জিংঙ্কাম প্রভৃতি খুব নিম্ন শক্তিতে বিশেষ কার্যকরী হয় না। উচ্চ শক্তিতে তাহাদের কার্যকারীতাই অধিকতর পরিস্ফুট।
আবার আরেক দিকে এমন কতকগুলি অবস্হা আছে যেখানে উচ্চ শক্তির ঔষধ প্রয়োগ ছুঁরিকা বিদ্ধ করিয়া হত্যা করিবার নামান্তর বলে বর্ণিত হইয়াছে। যেমন- যক্ষ্ণা রোগে উচ্চশক্তির সালফার, সাইলেসিয়া প্রভৃতি। সেখানে এই সকল ঔষধ উচ্চ শক্তিতে প্রয়োগ করিলে রোগীকে মৃত্যুর পথে আরও অগ্রসর করিয়া দেওয়া হয় মাএ।
তাছাড়া সাধারণ চিকিৎসা ক্ষেএেও শক্তির তারতম্য যে রোগের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে এ বিষয়ে প্রত্যেক চিকিৎসক মাএেরই প্রত্যক্ষ্য অভিজ্ঞতা আছে। অনেকেই আছেন নিম্ন শক্তির ঔষধ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পরেছেন, উচ্চ শক্তির ঔষধের উপর তেমন নির্ভরতা দেখা যায় না। আবার যাঁহারা উচ্চ শক্তিতে আহরণ করিয়া আছেন, তাঁহারা উহার কার্য্যকারিতায় এরুপ আকৃষ্ট যে, নিম্ন শক্তিতে নামিতেই চান না। এই উভয় তন্ত্রের চিকিৎসক তাঁহাদের গোঁড়ামি পরিত্যাগ করিয়া বৈজ্ঞানিক মন লইয়া ঔষধের শক্তি সন্মন্ধে যদি গবেষণা করেন তাহা হইলে তাঁহাদের পুর্ণাঙ্গ অভিজ্ঞতার ফল সকল হোমিওপাথিক চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীগণের সহায়ক হইতে। তদপেক্ষা কম মাএায় মুখ হইতে লালা স্রাব, ঘর্ম্ম, বৃক্কের (Kidney) প্রদাহ প্রভৃতি লক্ষণ প্রকটিত করে, আবার তদপেক্ষা আরও স্বল্প মাএায় (অর্থাৎ হোমিওপাথিক উচ্চতর শক্তিতে) সুক্ষ্ম লক্ষণ সমুহ (মানসিক লক্ষণ) প্রকাশ করায়।
লক্ষণ সমুহঃ
(ক) স্হুুল দেহেই নিবন্ধ মুখ্য থাকিলে (Gross pathological states)ঃ নিম্ন শক্তি (৩x হতে ৩০)
(খ) যান্ত্রিক ক্রিয়ার গোলযোগ মুখ্য হইলে (Functional disorders)ঃ মধ্যম শক্তি (৩০ হইতে ২০০) (গ) সূক্ষ্ম মানসিক লক্ষণের প্রাধান্যেঃ উচ্চতর শক্তি (২০০ হইতে উর্দ্ধ) প্রযোগ করা যাইতে পারে।
(ঘ) ব্যবহারিক ক্ষেএে আরও একটি নিয়ম প্রণিধান যোগ্য যথা— “প্রাণ সংরক্ষণে” যে যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা যত কম (Less vital) ঔষধের শক্তি তাহাতে তত উচ্চ প্রয়োগ করা যাইতে পারে। অপর পক্ষে যে শারীর যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা যত বেশী তাহার জন্য তত নিম্ন শক্তির ব্যবহার প্রয়োজন হয়। দৃষ্টান্ত স্বরুপ বলা যাইতে পারে যে, কোনো রোগীর বৃক্ক যন্ত্রের গুরুতর পীড়ার লক্ষণ প্রকাশ পাইলে সেখানে নিম্ন শক্তির ঔষধ প্রয়োগ করাই সমীচিন। সেই রুপ কোন যক্ষ্ণা রোগীর ফুসফুস ভীষণ ভাবে আক্রান্ত হইলে সেখানেও উচ্চ শক্তি ব্যবহার করা বিধি সঙ্গত নহে। হৃদরোগ সন্মন্ধেও মনে হয় এ কথা খাটে। এ সন্মন্ধে ডাঃ কেন্ট বিশেষ ভাবে সতর্ক করিয়া গিয়াছেন। অপর পক্ষে, চর্ম্মরোগে উচ্চতর শক্তির ঔষধ দিতে কোন বাধা নাই, বরং সুচিন্তিত ও বিচারসহ বলিয়াই মনে হয়। তিনি বলেন,– কোনও রোগীর পীড়া- প্রবণতার ক্রম বা পরিমান (Degree of susceptibility) ব্যক্ত হয় তাহার লক্ষণ সমষ্টির ভিতর দিয়া। রোগের লক্ষণ সমষ্টি প্রকাশ পায় যত বেশী, নির্বাচিত ঔষধের সহিত তাহার সাদৃশ্যও মিলে তত বেশী। আবার ঔষধের সহিত লক্ষণ সমষ্টির সাদৃশ্য যত বেশী অনুভুত হয়, সেই ঔষধ যে তত বেশী গভীর প্রতিক্রিয়া আনয়ন করিতে সমর্থ হইবে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। সেই জন্য লক্ষণ সমষ্টির ব্যঞ্জনা যত অধিক স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পাইবে সুনির্বাচিত ঔষধের তত অল্প পরিমান (অর্থাৎ উচ্চশক্তি) ব্যবহার করাই সঙ্গত। অবশ্য গুরুতর যান্ত্রিক পীড়ায় যেখানে রোগীর জীবনী শক্তি অতি ক্ষীণ এবং ঔষধের প্রতিক্রিয়া সহ্য করিতে অসমর্থ সেখানে এ নিয়ম খাটে না — এই স্হলে ঔষধের নিম্ন শক্তি ব্যবহার করাই নিরাপদ।
সুতরাং ঔষধ সুনির্বাচিত হওয়া সত্বেও তাহার শক্তি নির্বাচন যে রোগ উপসমের পক্ষে একটি অপরিহার্য্ বিষয় তাহা স্বীকার করিতেই হইবে।সাধারনতঃ যাঁহারা নিম্ন শক্তির ঔষধই বেশী ব্যবহার করেন তাঁহাদের উচ্চ ও নিম্ন শক্তির স্ব স্ব ক্ষেএ আছে। সেই ক্ষেএে একটি বিশিষ্ট শক্তিই অন্যটি অপেক্ষা সমধিক উপযোগী।কোন বিশেষ ক্ষেএে, কোন শক্তি প্রয়োগ করা বিধেয়, সে সন্মন্ধে ধরাবাঁধা একটা নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়া চলে না। একজন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপরই তাহা প্রধানতঃ নির্ভর করে।সুস্হ দেহে ঔষধের প্রুভিং বা পরীক্ষা নিরীক্ষার দ্বারা হোমিওপাথিক ঔষধের লক্ষণ -সমষ্টি নির্ণীত হয়। ঔষধের লক্ষণ সমষ্টির সহিত শক্তি নির্বাচন সন্মন্ধেও একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া য়ায়।
সংকলিতঃ ঔষধের পরিচয় (নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপধ্যায়)