রেপার্টরির ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা।

ডা. অমরনাথ চক্রবর্তী
১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত প্রতিটি রোগীর রেপার্টরি করে নিশ্চিন্ত হয়ে তবেই ওষুধ দিয়েছি। সকাল ৮ টা থেকে শুরু আর শেষ রাত ১০/ ১১ টায়। প্রচুর রোগী। গুরু ডাঃ দাস বলতেন এত রোগী দেখিস না। রোগী কম দেখে পড়াশোনা করতে উপদেশ দিতেন। তখন পাঁচটি চেম্বারে বসতাম। এত সাফল্যের মধ্যেও কিছু ঘটনা কাঁটার মত অন্তরে বিধছিল। আমার ধারণা ছিল রেপার্টরি করে ওষুধ দিলে ভুল হয় না। তবে যেগুলি পারতাম না সেই রোগী ঠিক বলেনি তাই আমি ব্যর্থ। কিন্তু নিজের ভুল খুব কমই চোখে পড়তো।
তখন কয়েকটি ওষুধ বেশি নির্বাচিত হত যেমন সালফার। ডাঃ কেন্ট সালফারের ভুল নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন, ” It seems that the less a physician knows of the Materia Medica the oftener he gives Sulphur, and yet it is very frequently given, even by good prescribes; so that the line between physicians’ ignorance and knowledge cannot be drawn from the frequency with which Sulphur is prescribed by them. কেন্টের উপদেশের পরেও আমি সালফার নির্বাচন আমি কমাতে পারিনি।
ডাঃ জে. এন. কাঞ্জিলালের বইতে পড়লাম, SULPHUR CAN NEVER BE INDICATED WITHOUT MANIFESTATION —- IN THE FIRST DEGREE OR GRADE — OF CONGESTION, BURNING AND REDNESS. First degree burning সম্পর্কে তিনি এক জায়গায় বলেছেন , First degree burning বলতে বোঝায় সারা বছর একটানা ভয়ংকর জ্বালা। যদি না থাকে তবে সালফার হবে না। বাস্তব হচ্ছে রেপার্টরি করলে সালফার বেশি আসে।
আবার আর একটি পর্যবেক্ষণ আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। পুরান কিছু রোগী আবার পুরানো লক্ষণ বা পুরানো লক্ষনের সহিত কিছু নতুন লক্ষণ নিয়ে ফিরে এল। প্রমান হল সালফারে এদের আরোগ্য হয় নি। যাদের First degree burning ছিল না তাদের অন্য ওষুধ দিলাম। কয়েকটি সফলতা পেলাম। রেপার্টরি করে সালফার এসেছিল কিন্তু ডাঃ কাঞ্জিলালের উপদেশে পরীক্ষামূলক ভাবে এটা করেছিলাম। এরপর দুটি চেম্বার বন্ধ করে নতুন ভাবে পড়াশোনা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে বুঝলাম যে রোগী হেরিং ও কেন্টের আরোগ্যকারী পর্য়বেক্ষণ অনুসরণ করে আগে আরোগ্য হয়নি সেই রোগীই পরে ফিরে এসেছিল। আবার দর্শন নতুন ভাবে পড়তে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে লন্ডন থেকে একটি রেপার্টরি আনিয়েছি তবুও সমস্যা রয়ে গেল।
এরপর ডাঃ তপন কাঞ্জিলালের সান্নিধ্যে এলাম। তার কাছে শিখলাম অনেক সালফারের রোগী আসলে মেডোর রোগী যা রেপার্টরি করে আনা সম্ভব নয়। এইভাবে ভুল থেকে সত্যের দিকে পরিচালিত হলাম। ডাঃ কাঞ্জিলালের নির্দেশে আরো দুটি চেম্বার বন্ধ করে তাঁর নির্দেশ অনুসারে পড়া শুরু করলাম। ডাঃ কাঞ্জিলালের “রেপার্টরি প্রসঙ্গে ” নামে একটি বই আছে। সেখানে রেপার্টরির ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। তার ওপর ভিত্তি করে বিষদ ভাবে আলোচনা করবো।
ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা —–
(১) কোন রেপার্টরি সম্পূর্ণ নয় কারণ প্রতিদিনই হোমিওপ্যাথিক শাস্ত্রে নতুন ওষুধ ও লক্ষণের সংযোজন হচ্ছে এবং আগামী দিনে তা আরো হবে।
(২) বিভিন্ন রেপার্টরি বিভিন্ন সংখ্যক ওষুধ নিয়ে তৈরি। যেমন কেন্টের রেপার্টরিতে ৬৪৮ টি আর সিন্থেসিস রেপার্টরিতে ( ৭•১ সংস্করণ ) ৩৬৮০ টি। তাই বিভিন্ন রেপার্টরি ব্যবহার করলে কিছু ওষুধ বাদ পড়ার সম্ভবনা আছে।
(৩) বিভিন্ন ওষুধের বিভিন্ন লক্ষণ বিভিন্ন রেপার্টরিতে পাওয়া যায় অর্থাৎ একটি ওষুধের সব লক্ষণ একটি রেপার্টরিতে পাওয়া যায় না। যেমন , Nat – mur ওষুধটিতে < Music ( কেন্টের মেটিরিয়া ) লক্ষণটি তাঁর রেপার্টরিতে Rubric — SENSITIVE, oversensitive, music, to: এইভাবে আছে। আবার বোনিংহাউসেনের রেপার্টরিতে এই ওষুধটির Rubric —Sensitive: music, to: এইভাবে আছে। কিন্তু কেন্টের রেপার্টরিতে Nat – mur আছে কিন্তু বোনিংহাউসেনের রেপার্টরিতে পাওয়া যায় না।
(৪) কোন বিশেষ লক্ষণে কোন ওষুধের মূল্যমান প্রতিটি রেপার্টরিতে এক নয় যেমন, বোরিক ও লিপ্পিতে দুই রকমের, কেন্টে তিন রকমের, বোনিংহাউসেনে পাঁচ রকমের, জেন্ট্রীতে ছয় রকমের এবং নারেতে আট রকমের মূল্যমান আছে। এই মূল্যমান রেপার্টরি গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। মূল্যমান ভিন্ন থাকায় ক্ষেত্র বিশেষে যখন একটির বেশি রেপার্টরির সাহায্য একসাথে নিতে হয় তখন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।
কেন্টের রেপার্টরিতে Love, ailments, from disappointed – rubric টি আবার বোনিংহাউসেনের রেপার্টরিতে Love, unfortunate. এখানে ভাষার পার্থক্য বিপথে চালিত করতে পারে। আমার মাথার উপর ডাঃ কে.সি. দাস ছিলেন তাই সামান্য শিখতে পেরেছি। কিন্তু বিশেষ করে নতুনদের কাছে বড়ই অসুবিধা। অভিধানের অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই হোমিও ক্ষেত্রে অচল। আমি এই বিষয়ে RESURRECTION — Categorization and classification of symptoms এ বিষদ আলোচনা করেছি। কেন্টের রেপার্টরিতে love, ailments, from disappointed, rubric টিতে Nat – mur এর মূল্যমান প্রথম শ্রেণি কিন্তু বোনিংহাউসেনের রেপার্টরিতে দ্বিতীয়শ্রণিতে আছে। সাংখ্য মান যথাক্রমে ৩ ও ৪। এই মূল্যমান মেলাবেন কিসের ভিত্তিতে ? অনেকেই এই মূল্যমানের উপর ভিত্তি করে ওষুধ নির্বাচন করেন। মনে রাখবেন, PICTURE IS NOT A GEOMETRY BUT GEOMETRY IS DEFINITELY PICTURE. আমার ইঙ্গিত বুদ্ধিমান বন্ধুরা অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন। গানে তাল বা ছন্দ (বিজ্ঞান) অবশ্যই থাকে কিন্তু তালে গাইলেই সব গান গান হয় না। এই আর্টের বৈশিষ্ট্য আপনাকে বলে দেবে এটা রবীন্দ্রসংগীত বা নজরুলগীতি বা অতুলপ্রসাদ বা রামপ্রসাদ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই আর্টটি আপনি বুঝবেন মায়াজমের বৈশিষ্ট্য দিয়ে। তাই আর্টকে বাদ দিয়ে রেপার্টরি করলে বিপদ আছে। এখানে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। আশাকরি রেপার্টরির দুর্বল জায়গাটা বোঝাতে পেরেছি। সমস্যা হচ্ছে রেপার্টরিকে বাদ দিয়ে চলাও সম্ভব নয়। তাই মেটিরিয়া, রেপার্টরি ও দর্শনের ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে।
( ৫ ) প্রতিটি রেপার্টরির দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। যেমন ডাঃ কেন্টের দর্শন GENERAL TO PARTICULAR আবার ডাঃ বোনিংহাউসেনের দর্শন PARTICULAR TO GENERAL. দুটি বিপরীত দর্শনের সংঘাতের সম্ভাবনা প্রবল। কাকে রাখব আর কাকে ছাড়ব। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া বড়ই কঠিন আর নতুনদের পক্ষে খুবই বিভ্রান্তকর। বাস্তবে এদের দুইজনকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এদের কি ভাবে কাজে লাগাব ? তাই সংক্ষিপ্ত রুপরেখা দেবার চেষ্টা করছি।
(ক) GENERAL TO PARTICULAR — General & Particular symptom সম্পর্কে আমি বিস্তারিত আলোচনা করেছি RESURRECTION — 17|03|2018 থেকে 30|03|2018 পর্যন্ত। আমি এখানে এই দর্শন অনুসারে কিভাবে লক্ষণ সাজাব এবং এর সুবিধা ও অসুবিধার সম্পর্কে কিছু বলব।
ওষুধ নির্বাচনের অনেক পদ্ধতি আছে। ডাঃ কাঞ্জিলাল এই পদ্ধতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন। যারা মায়াজম বোঝেন না তারাও এই পদ্ধতি অবলম্বন করে অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন। তিনি লক্ষণের গুণগত মান অনুসারে লক্ষণগুলিকে সাজিয়েছেন। এই পদ্ধতির সঙ্গে তাঁর মেটিরিয়া গভীর ভাবে অনুশীলন করলে আমরা সাফল্যের আশা করতেই পারি। কারণ তাঁর মেটিরিয়ায় দর্শনের প্রয়োগের কথা, এমনকি মায়াজমের কথা ও তাঁর প্রয়োগের কথাও বলেছেন। এর সঙ্গে হ্যানিম্যান ও অ্যালেনের দর্শনের মিলন হলে অতি উত্তম।
ডাঃ কেন্ট কিভাবে সাজিয়েছেন সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করছি। প্রথমে মানসিক ( এর তিনটি গুণগত মান আছে। এর মান অনুসারে সাজাতে হবে ) লক্ষণ, পরে সার্বিক ( General ) হ্রাস — বৃদ্ধি বা কারণ এবং খাবার ইচ্ছা — অনিচ্ছা ইত্যাদি। এই সার্বিক লক্ষণগুলির মধ্যে বর্তমান ওষুধগুলিকে বাছাই করতে হবে।
এর পরের ধাপে PARTICULAR লক্ষণগুলি নিতে হবে। অবশ্যই এগুলি উচ্চশ্রেণির হবে। এই ভাবে আমরা ১ |২ | ৩ টি সদৃশ ওষুধের সন্ধান পেতে পারি। তবে সিদ্ধান্ত দেবে মেটিরিয়া । এইভাবে সদৃশতম ওষুধটি আমরা পাব।
এই পদ্ধতির কিছু ত্রুটিও আছে। নতুনদের এই পদ্ধতি অনুসরণ করা বেশ কঠিন। মানসিক লক্ষণ বার করতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন যা নতুনদের থাকেনা। এই লক্ষণ বার করা খুব সময় সাপেক্ষ। তাই পরিশ্রম করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। বর্তমানে জটিল রোগীর সংখ্যা বেশি তাই সময় বেশি দিতে হবে। সেই সহজের খোঁজ করতে গিয়ে অনেকেই বিপথে চলে যান। বেশি সময় প্রথমে দিলে পরে পরমানন্দ পাওয়া যায়। অভ্যাস করতে করতে বিষয়টা সোজা হয়ে যাবে। এটা বাস্তব অসুবিধা। অনেক রোগীর সার্বিক লক্ষণের অভাব থাকে সেক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অচল। সেখানে অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
আমরা যেভাবে এখন লক্ষণ পাই সেভাবে লক্ষণ হোমিওপ্যাথি আবিষ্কারের প্রথম দিকে ছিলনা। হ্যানিম্যানের বন্ধু বোনিংহাউসেন লক্ষণকে একটি নির্দিষ্ট রুপ দিয়েছিলেন। হ্যানিম্যান তার অবদান মেনে নিয়েছিলেন। একটি সম্পূর্ণ লক্ষণের পাঁচটি অংশ। এই পাঁচটি অংশ সবসময় পাওয়া যায় না। এই পাঁচটি অংশ হল (১)কারণ (Causation) (২) স্থান (Location) (৩) অনুভূতি বা যে কোন পরিবর্তন (Sensation) (৪) হ্রাস বা বৃদ্ধি (Modalities) (৫) সহগামী লক্ষণ (Concomitant).
এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় ত্রুটি হল স্থানের লক্ষণ কম থাকার জন্য কোন বিশেষ ওষুধ আমাদের চিন্তার বাইরে চলে যায়। এর বিন্যাস PARTICULAR TO GENERAL হবার জন্য রোগ চাপা পড়ার সম্ভবনা আছে। আরোগ্যের নীতি Centre to periphery. এখানে সাজান হচ্ছে Periphery to Centre. তাই এই পদ্ধতির ত্রুটি সংশোধন করে ডাঃ কেন্ট General to Particular রুপে সাজান।
(৬) প্রতিটি রেপার্টরির ছকের মধ্যে পার্থক্য আছে। যেমন মনের লক্ষণ ডাঃ কেন্টের রেপার্টরিতে আছে, Mind, fear লক্ষণ শিরোনামের প্রথমেই সময়ের হ্রাস- বৃদ্ধি দেওয়া আছে। কিন্ত ডাঃ বোনিংহাউসেনের রেপার্টরিতে, Mind in general এ হ্রাস – বৃদ্ধি আলাদা ভাবে দেওয়া আছে।
(৭) রোগীর প্রদত্ত লক্ষণের ভাষা, মেটিরিয়া মেডিকার ভাষা এবং লক্ষণ শিরোনামের (Rubric) অন্তর্নিহীত ভাষা এক না হলে আরোগ্যকর ওষুধ নির্বাচন সম্ভব নয়। অনেকদিন আগের একটি ঘটনা বলি।
একটি রোগীকে কি ভালবাসেন জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন, বেড়াতে খুব ভালবাসি। এমন স্বতঃস্ফুর্তঃ লক্ষণ পেলে আত্মহারা হয়ে আমরা Travel, desire to লক্ষণ শিরোনামটি গ্রহণ করি। প্রত্যেক রোগী আলাদা। রোগী লিপি গ্রহণ করার সময় রোগীর অন্তর্নিহীত ভাবটি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। একই ভাষার ভিন্ন ভিন্ন অন্তর্নিহীত ভাব থাকতে পারে। তাই রোগীলিপি গ্রহণ করার সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কি রকমের ভুল হতে পারে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।
( ক ) অনেক রোগী বেড়াতে ভালবাসে। তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে হবে কোথায় বেড়াতে ভালবাসেন ? যদি বলেন তীর্থস্থানে বা মন্দির,মসজিদ বা গির্জা দেখতে ভালবাসি তবে এটা কখনোই Travelling desire হবে না। এটা হবে Religious affections. আবার যদি নিজের ধর্মের প্রতি খুব গোঁড়া আর অন্য ধর্মের তীব্র ঘৃণা থাকে সেটা হবে Fanaticism.
( খ ) অনেকে সমুদ্রে বেড়াতে ভালবাসেন কারণ শরীরের কষ্টের উপশম হয়। এটা হবে Seashore >
আবার কিছু রোগী সমুদ্র এত ভালবাসেন যে সেখানে গেলে কষ্ট বাড়ে তবুও যাওয়া চাই। এক্ষেত্রে Travel desire + Seashore < নিতে হবে।
আমি একটি অদ্ভুত রোগীর কথা বলছি। ছোট বেলা থেকেই বেড়ানোর সখ কিন্তু সাংসারিক কারণে তা সম্ভব হয় নি। তার বর্তমানে নেশা টিভিতে শুধু Travelling channel দেখা। এর জন্য তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঝামেলা লাগে মাঝেমাঝে। জিজ্ঞাসা করে আরও জানতে পারলাম তিনি প্রায়ই স্বপ্ন দেখেন ঐ স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অথবা গাড়ীতে যাচ্ছেন। এখানে নিতে হবে Travelling desire + Dreams of journey.
Travelling desire এর জন্য যে দূরেই বা অন্য দেশে যেতেই হবে এমন কোন অর্থ নাই। আমি একজন শয্যাশায়ী রোগিণীকে দেখতে গিয়েছিলাম। তার স্বামী প্রাক্তন অধ্যক্ষ। অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। প্রথমে আমাকে যে ঘরে বসতে দেওয়া হয়েছিল সেটা হল ঘরের মতো। ঘরটির বিভিন্ন আলমারীতে শুধু বই আর বই। জিজ্ঞাসা করাতে জানতে পারলাম তিনি এই ঘরেই বেশি সময় কাটান। এই সবের সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক কি ?
রোগিণী একা উঠে বসতে পারেন না। বসিয়ে দিতে হয়। অধ্যাপক পড়াশোনার ঘরে সময় কাটান বলে রোগিণীর কোন ক্ষোভ আছে কিনা জানার জন্য আমি রোগিণীকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার স্বামী বই নিয়ে থাকেন এই নিয়ে আপনার মনে কি ভাবেন ? রোগীকে সরাসরি প্রশ্ন করা উচিৎ নয়। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে হবে যাতে ভেবে উত্তর দেন।
আমরা সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে ( গত কয়েক মাস উঠে বসার ক্ষমতা ছিল না। ) তর্জনী তুলে বললেন, ” ঐ লোকটা কোথায় কোনদিন ঘুরতে নিয়ে যায় না “। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এই অবস্থায় বাইরে যাবেন কি করে ? এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ” কেন ভ্যানে শুয়ে ঘুরবো। এতেই শান্তি। আমি বেশি দূরে যেতে চাইনা তবুও আমাকে নিয়ে যায় না।”। মনের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
এবার একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। অনেকেই মিষ্টি বা নুন খান না আর আমরা লিখে নিলাম Av to sweet or salt. খুব সাবধান। প্রশ্ন করতে হবে কেন খান না ? অনেকেই আজকাল স্বাস্থ্যের জন্য এগুলি বর্জন করেন। তাহলে বন্ধু রোগীর ভাষার অন্তর্নিহীত ভাব বোঝা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি না বুঝলে রেপার্টরির লক্ষণ শিরোণাম ভুল হবে।
(৮) রোগীর রোগ লক্ষণের মূল্যমান ও রেপার্টরিতে প্রদত্ত লক্ষণের মূল্যমান এক না হলে আরোগ্যকর ওষুধ নির্বাচন সম্ভব নয়।
আমার জীবনে এই উপদেশটির গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে। চিকিৎসক জীবনের দশ বছর কাটিয়ে ফেলেছি তখন। ডাঃ জে এন কাঞ্জিলালের, Writings on homoeopathy বইটির কিছু পাতা আমার হাতে আসে। পরে অবশ্য বইটি লিখে নিয়েছি। ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল, Personality of drugs প্রবন্ধটিতে সালফার সম্পর্কে বলছেন, ” Sulphur can never be indicated without the manifestation — in the first degree or grade of congestion, burning and redness. তাঁর এই লেখাটি আমাকে খুব ভাবিয়ে তুললো। আমি First degree burning বলতে ঠিক কি বোঝায় তা জানতাম না। তাছাড়া এগুলি মানসিক লক্ষণ নয় তবুও এত গুরুত্ব সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। আসলে এটি Personality and genius of the drug এর অন্তর্গত। এই বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করলে বিষয়ের বাইরে যেতে হবে। তাই এখানে করছি না।
তাঁর এই উপদেশে প্রভাবিত হয়ে আমার সালফারের সব রোগীলিপি আবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। দেখলাম জ্বালা অনেক রকম লেখা আছে কিন্তু প্রথম শ্রেণির জ্বালা কোনটা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। এই রকম একটা দোদুল্যমান অবস্থায় ডাঃ তপন কাঞ্জিলালের সান্নিধ্যে আসি। তাঁর কাছে জানতে পারলাম প্রথম শ্রেণির জ্বালা বলতে বোঝায়, সারাবছর ধরে তীব্র জ্বালা । তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন, How to use repertory প্রবন্ধটি ভাল করে পড়। সেটি আবার পড়তে গিয়ে আমার অন্ধত্ব ঘুচলো। ডাঃ জে এন কাঞ্জিলাল বললেন, ” For example, BURNING IN THE PALMS AND SOLES has Sulphur in the Repertory in bold type. Now the patient, if he is to correspond with Sulphur in the highest grade, must have “BURNING OF PALMS AND SOLE ” in great intensity and persistence. If he has only occasional , “Burning of palms and Soles” of slight degree, he may correspond with a score of other remedies and not necessarily with Sulphur. ”
( ৯) Nosode — Medicine, prepared from disease product. যথা, Medorrhinum,Tuberculinum, Bacillinum ইত্যাদি।
Sarcode — Medicine, prepared from healthy gland and normal secretion of living animal. যথা,Thyroidinum, Adrenaline ইত্যাদি।
Imponderabilia — Medicine, prepared from natural and artificial energies. যথা,X- Ray, Luna ইত্যাদি।
Tautopathic — Medicine, prepared from other drugs and vaccine ইত্যাদি। নিত্য নতুন অ্যালোপ্যাথি ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে। সেই সব ওষুধের কুফল দূর করার জন্য। এই সব ওষুধ অনেক সময় নির্বাচিত ওষুধের ক্রিয়ায় বাধা দেয়। এই সব ওষুধ থেকে আজকাল হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রায় তৈরী হচ্ছে না।
Indigenous — Medicine prepared from country source. যথা, Acalypha Indica (মুক্তঝুড়ি), Egalpholia ( বেলপাতা) ইত্যাদি।
ওপরের ওষুধগুলি রেপার্টরিতে কম পাওয়া যায় বা প্রায় পাওয়া যায় না। এই জন্য এই ওষুধগুলি নির্বাচনে রেপার্টরির সাহায্য যথাযত পাওয়া যায় না।
(ডাঃ কেন্টের রেপার্টরির ওপর ভিত্তি করে লেখা)
(১০) মেটিরিয়ায় এমন বহু ওষুধের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ আছে যা রেপার্টরিতে স্থান পায়নি। যেমন, FIXED IDEA. এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। এটি রেপার্টরিতে স্থান পায়নি। এটি থাকলে খুব নিশ্চিন্ত হয়ে থুজা দিতে পারি।
আবার Mur – acid এর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ, PATIENT BECOMES SO WEAK,SHE SLIDES DOWN THE BED. এটিও রেপার্টরিতে নাই। আমি তখন D.M.S. প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমার ঠাকুরমা তখন শয্যাশায়ী। সব চিকিৎসা ব্যর্থ। সবাই জবাব দিয়ে দিয়েছেন। বাবাকে হোমিওপ্যাথির কথা বলতে তিনি বলেছিলেন, ” হাতি, ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল?”। এক হোমিওপ্যাথকে বাড়ীতে ডেকে আনি। ঠাকুরমা বিছানার নীচের দিকে চলে আসতেন। তিনি ঘন্টাখানেক দেখে দুই পুরিয়া Mur — acid. 2C দিয়েছিলেন। ওষুধটি ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল। একমাসের মধ্যে নিজে উঠে খেতে পারতেন। দেওয়াল ধরে হাঁটতে পারতেন। এর পরেও একবছর মোটামুটি সুস্থ ছিলেন। ১০৮ বছর বয়সে মারা যান।
আবার ডাঃ কেন্টের মেটিরিয়াতে< Meat (নাক্স) আছে কিন্তু রেপার্টরিতে নাই। আমরা যদি রেপার্টরিকে পাশে রেখে মেটিরিয়া পড়ি তবে রেপার্টরির অনেক ত্রুটি আমাদের নজরে পড়বে যা আমাদের অনেক উপকারে আসবে। যেমন , রেপার্টরিতে দেখবেন পেটেব্যথা বা কোঁথানি > পায়খানার পরে। Nux – v প্রথম গ্রেডের ওষুধ। এই লক্ষণটির সঙ্গে মেটিরিয়া থেকে যোগ করতে হবে,” অল্প পায়খানার পরে। তবেই লক্ষণটি নাক্সের হবে। এই ভাবে লক্ষণ সম্পূর্ণ করতে হবে তবেই সাফল্য আসবে। সম্ভবত ডাঃ ন্যাস অল্প পায়খানায় উপশম লক্ষণটিকে PURE GOLD বলেছেন। নতুনদের বলছি নাক্সের এই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখ। আমার ঝুলিতে আরও অনেক উদাহরণ আছে যা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়।