Miasm (মায়াজম) এর পরিচয় – ডাঃ হাসান মীর্জা

মায়াজম হল হোমিওপ্যাথির গোড়ার কথা এবং এই গোড়ার কথাটি গোড়া থেকে বুঝে না নিলে এবং তদ্রুপ ব্যবস্থাপত্র অজানা থাকলে চিকিৎসকের সকল শ্রম যে পন্ডশ্রমে পরিণত হবে তাতে সন্দেহ নেই।

সোরা যা পীড়া নামক অন্তর্নিহিত ধ্বংসের মূল- এই সোরা যখন সিফিলিস বা সাইকোসিসের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধাতুগত দোষে পরিণত হয় তখন তা বংশগতভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে। ঠিক এইরূপ অবস্থায় সুনির্বাচিত ঔষধ ব্যর্থ হলে তার উপায় হল, রোগের মূলে কুঠারাঘাত হেনে ঔষধের তুল্য প্রতিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য এবং রোগটি আরোগ্যের জন্য নোসোড ঔষধ ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বংশগত কারণে কোন রোগ চিররোগে রূপান্তরিত হলে ঐ রোগের মুলোচ্ছেদ করতে আপনাকে বিচার করে দেখতে হবে যে, উক্ত রোগের মূলে সোরা সিফিলিস সাইকোসিস- কোন দোষটি বিদ্যমান। বস্তুতঃ সোরা-সিফিলিস-সাইকোসিস এই ত্রয়ী একপুরুষে রোগচরিত্রের যে পরিচয় দেয় বংশগতভাবে বা পুরুষানুক্রমে অবস্থার জটিলতায় কিংবা কুচিকিৎসার চাপে পড়ে রোগটি আরো সহস্র গুণ জটিল অবস্থায় উপনীত হয়। ঠিক এরকমই জটিল ও দুর্বোধ্য অবস্থায় রোগচরিত্র ও তদসদৃশ ঔষধ নির্বাচন করা একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরীক্ষা যে তিনি বংশগত বা চিররোগের পাঠ কতটা নিতে পেরেছেন।

যেকোন পুরাতন রোগের চিকিৎসায় বা যেকোন প্রাচীন পীড়ার ক্ষেত্রে সোরা-সিফিলিস-সাইকোসিসের পরিচয় পেলে আমি অগ্রে লক্ষণ বিচারে ব্যাসিলিনাম, মেডোরিনাম সিফিলিনাম- এই নোসোডগুলির একটিকে বেছে নিই এবং ঔষধটির সিএম শক্তির দুটি মাত্রা ব্যবহার করে তারপর সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ করি। গুরুমশাই মতিলাল মুখার্জীকে এইভাবে চিকিৎসা করতে দেখেছি। মনে রাখা দরকার রোগীদেহে প্রতিক্রিয়া সম্পাদনের জন্য রোগীর মনস্তত্ত্ব কোন স্তরে কাজ করছে তা চিকিৎসকের নিখুঁতভাবে নির্ণয় করতে হবে। চিকিৎসাশাস্ত্রে ভুলের কোন অবকাশ নেই। অন্যান্য ভুলের ক্ষমা থাকলেও চিকিৎসকের ভুলের কোন ক্ষমা নেই। কারণ প্রাণ নিয়ে খেলা চলে না।

বিজ্ঞান অর্থ যদি পরীক্ষালব্ধ প্রমাণিত সত্য হয় তাহলে রোগীদেহে রোগ আরোগ্যের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাসিলিনাম, মেডোরিনাম সিফিলিনাম ইত্যাদি ঔষদাদি যে তারই চূড়ান্ত পরিণতি সে কথা আমি চিৎকার করে বলতে পারি। মেকিয়ানা আমাদের মজ্জায় জায়গা করে নিয়েছে বলেই সত্যের অমৃতসুধা পানে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

আজকাল মানুষ যত জটিল হচ্ছে, রোগের জটিলতা যত বাড়ছে ব্যাসিলিনাম-মেডোরিনাম-সিফিলিনামের মত রোগজবিষজাত নোসোড ঔষধগুলি ততবেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে।

সোরা/ মনঃকণ্ডুয়ন/ বিকৃতযৌনচেতনা ঃ

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা যদি করতেই হয় তাহলে সোরা বা মনঃকণ্ডুয়ন বা বিকৃত যৌনচেতনা, মদ-মত্ততার হিসেব-নিখেশটি খুব ভালো করে বুঝে নেওয়া চাই। মানুষ মরণশীল- এ সত্য জানার পরও সে বাঁচতে চায়, দীর্ঘজীবী হতে চায়। আর এই বাঁচার জন্য তার যে কর্মতৎপরতা, যে ভোগলিপ্সা তার থেকে জন্ম নেয় সোরা। মানুষ ভুলে যায় আজরাইলের কথা। এই ভুলে যাওয়ার ভুলটি থেকেই মানুষকে ভোগী করে তোলে। স্বীয় ভোগলিপ্সার বাসনায় অবৈধ উপায়ে অন্যায়ভাবে যেভাবে বিকৃত যৌনক্ষুধা আমরা মেটাই তারই অনিবার্য পরিণতি মনঃকণ্ডুয়ন। স্বীয় প্রবৃত্তিকে যতদিন আমরা শাসনে রাখি, বিকৃত যৌনাচারের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি ততদিন সোরাদোষের মারাত্মকতার হাত থেকে বাঁচার উপায় থাকে, তাকে প্রতিহত করার শক্তি অক্ষুন্ন থাকে। শক্র দুর্বল হতে তার মোকাবিলা করা সহজ কিন্তু সেই শক্র যদি প্রবলতর হয়ে ওঠে এবং তাকে প্রতিরোধ করার শক্তি না থাকলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। মানুষের জীবনীশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে এবং রোগপ্রতিরোধে তা অক্ষম হলে বাইরের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই বহিরাগত শক্তি যদি দেহধারনের জন্য অনুকুল না হয়ে প্রতিকুল হয়, দেহের জন্য বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে তখন বিতরকার শক্তির মোকাবিলা করা তো দুরের কথা পশ্চাদপসরণ ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা। এই বাহিরের শক্তি তাহল কুচিকিৎসা। এই কুচিকিৎসার কারণে পীড়ানামক ভয়াবহতা তনুমনকে গ্রাস করে পঙ্গুপ্রায় করে ছাড়ে। রোগীও রোগ থেকে রোগান্তরে ভুগে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। উপযুক্ত ঔষধ ব্যর্থ হতে থাকে। মহাত্মা হ্যানিম্যান সোরাদোষকে যেমন যাবতীয় ধ্বংসের বীজ বা উৎস বলে অভিহিত করেছেন তেমনি এই সোরাকেই ক্ষয়দোষ বলে মন্তব্য করেছেন। বংশগত ক্ষয়দোষের একটি বড় কারণ হল কৃত্রিম চিকিৎসা বা কু-চিকিৎসা। এর অনিবার্য পরিণতি আমরা দেখতে পাই নবজাতকের চিররুগ্ন হয়ে জগতের আলো দেখা। সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকে কেন সে জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয বা কেন তার অকালপ্রয়াণ ঘটে সে সম্পর্কে চিকিৎসককে সতর্ক থাকতে হবে এবং তার জন্য বংশগত সোরাদোষের মারাত্মকতা ও তার প্রতিকারের পথটি জেনে নিতে হবে। সোরা বা মানসিক মনঃকণ্ডুয়ন যদি না থাকতো তাহলে পীড়া বা পীড়ানামক মনোদৈহিক যাতনাও থাকতো না। কিন্তু যা আছে তাই নিয়ে চলতে হবে, ভাবতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে।