ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির ইতিহাস

Homeopathic BD  > Homeo, হোমিওপ্যাথিক বিডি >  ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির ইতিহাস

ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির ইতিহাস

0 Comments

-ডা. এ কে এম রুহুল আমিন
ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির সূচনাপর্ব জার্মানীর স্যাক্সিনি প্রদেশের মাইসেন শহরের চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিমান (১৭৫৫-১৮৪৩ খ্র্রীঃ) কালেন সাহেব লিখিত অ্যালোপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকার দ্বিতীয় খন্ডের ‘সিঙ্কোনা’ (Cinchona) অধ্যায় অনুবাদ করার সময় আরোগ্যের এক নতুন নিয়মের সন্ধান পেয়েছিলেন। হ্যানিম্যানের এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি পরবর্তীকালে ‘হোমিওপ্যাথি’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
জার্মানীর পর ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে হোমিওপ্যাথি প্রসারের সাথে সাথে আমেরিকার কয়েকটি দেশেও হোমিওপ্যাথির দ্রুত প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষেও হোমিওপ্যাথি এসে পৌঁছায় হ্যানিম্যানের জীবদ্দশাতেই। ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথি কবে থেকে আরম্ভ হয় তার কোন সঠিক সন-তারিখ পাওয়া যায় না। এস. সি. ঘোষ লিখিত ও ১৯৩৫ সনে কলকাতা থেকে প্রকাশিত Life of Dr. Mahendra Lal Sircar গ্রন্থের ৩২ পৃষ্ঠায় লিখিত আছে-
“পুরনো পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায় যে ১৮১০ সালে জনৈক জার্মান ভূতত্ত্ববিদ-চিকিৎসক কলতাকাতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন। সেদিক থেকে বলা যায় ভারতে হোমিওপ্যাথির প্রথম পরিচয় ঘটে বাংলার বুকে, যে বছর হ্যানিম্যানের ‘অর্গানন অব মেডিসিন’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।”
এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে জার্মান মিশনারি, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, জমিদার, উচ্চশিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি ব্যক্তিবর্গের দ্বারা বিনামূল্যে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সূত্রপাত হয়। তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষে যিনি হোমিওপ্যাথির বিজয় পতাকা প্রথম প্রোথিত করেছিলেন, তার নাম জন মার্টিন হোনিগবার্গার (John Martin Honigberger, M. D.)। চিকিৎসা বিদ্যায় এম. ডি. ডিগ্রী লাভের পর ভ্রমণের নেশা তাকে পেয়ে বসে। ১৭৯৫ সালে ট্রানসিলভ্যানিয়ার ক্রোনস্টাড শহরে জন্মগ্রহণকারী এই চিকিৎসক বিশ বছর বয়সে ক্রোনস্টাড ত্যাগ করে প্রথমে ইতিহাসখ্যাত কনস্তান্তিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল, তুরস্ক) আসেন এবং সেখান থেকে সিরিয়া, মিশর ও মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশ ভ্রমণ করে বৃটিশ শাসিত ভারতে আসেন।
ভারত থেকে তিনি রাশিয়াতে যান এবং রাশিয়াতে ভ্রমণকালেই তিনি হ্যানিম্যান ও হোমিওপ্যাথির নাম প্রথম শোনেন। ১৮৩৫ সালের দিকে হ্যানিম্যান জার্মানীর কোথেন ত্যাগ করে ফ্রান্সের প্যারিসে আসেন। হোনিগবার্গার হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের জন্য ফ্রান্সের প্যারিসে আসেন। হ্যানিম্যানের সাথে আলাপের পর হোনিগবার্গার হ্যানিম্যানের নিকট হোমিওপ্যাথির দীক্ষা গ্রহণ করেন ও কিছুদিন হ্যানিম্যানের সাথে থেকে হোমিওপ্যাথির শিক্ষা গ্রহণ করেন। ওষুধ সংগ্রহের জন্য হ্যানিম্যানের পরামর্শে কোথেনের ‘লেহমান কোম্পানী’ হতে প্রচুর ওষুধ ক্রয় করেন ও ভ্রমণকালে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রদান করতে থাকেন। ভ্রমণ পিয়াসী হোনিগবার্গার লন্ডনসহ আরও বহুদেশ ভ্রমণ করে পুনরায় কনস্তান্তিনোপল হয়ে লাহোরের মহারাজার দরবারে আসেন এবং স্ট্রোক আক্রান্ত মহারাজার চিকিৎসা করে আরোগ্য করতে সক্ষম হন।
John Martin Honigberger
ভারতবর্ষের কয়েকটি এলাকায় ভ্রমণের সাথে সাথে চিকিৎসা পেশাও তিনি চালিয়ে যান এবং ১৮৫৫ সালে কলকাতায় আসেন ও পাঁচ বছর কলকাতায় ছিলেন। হোমিওপ্যাথি দ্বারা কলেরায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় তিনি সাফল্য দেখাতে সমর্থ হন। কলকাতায় তিনি ‘কলেরা ডাক্তার’ নামে খ্যাতি লাভ করেন।
তার এই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে কলকাতায় হোমিওপ্যাথির ব্যাপক প্রসার ঘটে। ১৮৬৯ সালে তিনি চুয়াত্তর বছর বয়সে নিজ জন্মস্থানে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনী, হ্যানিম্যানের সাথে সাক্ষাতের বিবরণ ও হোমিওপ্যাথিতে দীক্ষা গ্রহণের কথা, মহারাজের চিকিৎসার বর্ণনা, ভারতবর্ষে তাঁর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কথা, হোমিওপ্যাথি দ্বারা কলেরা রোগের চিকিৎসায় সফলতার কথা তাঁর রচিত “থার্টি ফাইভ ইয়ার্স ইন দ্যা ইস্ট” গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। এই অমূল্য গ্রন্থটি লন্ডন থেকে ১৮৫২ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি অর্গানন অনুসারী আদর্শ হোমিওপ্যাথ ছিলেন না, তবে হ্যানিম্যানের কাছ থেকে হোমিওপ্যাথির তত্ত্ব আয়ত্ত করে তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে এসেছিলেন, হোমিওপ্যাথির পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন।
১৯৮৯ সালে সমগ্র ভারতে ‘হোমিওপ্যাথির দেড়শ বছর’ পূর্তি উৎসব পালিত হয়, বলা বাহুল্য সেই আসরের প্রথম অর্ঘ্য জন মার্টিন হোনিগবার্গারকে প্রদান করে সম্মান জানানো হয়। অতীতে একটা সময়ে ভারতের এবং বিদেশের বহু অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হোমিওপ্যাথির গুণাগুণ দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন হোমিওপ্যাথির প্রতি; তাঁরা প্রত্যেকে হোমিওপ্যাথিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। অতীতে কয়েকজন বিদেশী চিকিৎসকও ভারতে এসেছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করার জন্য। তাঁদের প্রায় সবাই হোমিওপ্যাথিতে সফলও হয়েছিলেন। এভাবেই সেকালে ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির অগ্রগতি ঘটে; এগিয়ে চলে হোমিওপ্যাথির বিজয় রথ।
ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিরা সেকালে হোমিওপ্যাথি করতেন। এছাড়াও হোমিওপ্যাথির গুণগ্রাহী ছিলেন মতিলাল নেহেরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি, সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণাণ প্রমুখ রাষ্ট্রনায়ক ও শিক্ষাবিদগণ। হোমিওপ্যাথি জনপ্রিয় হতে থাকায় অনেক অপেশাদার শিক্ষিত ব্যক্তিও এই শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আগে শুধুমাত্র ইংরেজী জানা ব্যক্তিরাই হোমিওপ্যাথির চর্চা করতেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় হোমিওপ্যাথিক ভেষজবিদ্যার বই প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে হোমিওপ্যাথির প্রসার আরও বৃদ্ধি পায়।
অবিভক্ত ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথি বিস্তারে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁর নাম বাবু রাজেন্দ্রলাল দত্ত (১৮১৮-১৮৮৯), তিনি ছিলেন কলকাতার বউবাজারের প্রসিদ্ধ জমিদার, তিনি ‘রাজাবাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। হোমিওপ্যাথির প্রচার, প্রসার ও বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য সে আমলে তিনি সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। তিনি উচ্চ শিক্ষিত ও বহু ভাষায় পন্ডিত ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রখ্যাত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক ডাঃ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহকারী ছিলেন। কলেজের পাশ করা ডাক্তার না হয়েও তিনি অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রথম জীবনে অ্যালোপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন ও পরে কিছুদিন কবিরাজীও করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হোমিওপ্যাথির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং আপন অধ্যবসায়গুণে অল্পদিনের মধ্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাশাস্ত্র আয়ত্ত করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসাবে খ্যাতিমান হয়ে উঠেন।
কলকাতার খ্যাতনামা অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের দীর্ঘদিনের চেষ্টায় পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কঠিন ব্যাধি আরোগ্য না হওয়ায়, বিদ্যাসাগর রাজেন্দ্রলাল দত্তের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণ করে অল্পদিনেই আরোগ্য লাভ করেন। রাজেন্দ্রলাল দত্ত কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়ীর রাজা স্যার রাধাকান্ত দেবের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা করে আরোগ্য করতে সক্ষম হয়েছিলেন, অ্যালোপ্যাথিক চিৎকিসকগণ ইতোপূর্বে রাধাকান্ত দেবের জীবনের আশা ত্যাগ করেছিলেন। এই সব ঘটনায় কলকাতার সুধী মহলে হোমিওপ্যাথি ও রাজেন্দ্রলাল দত্তের সুনাম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজেন্দ্রলাল দত্ত ১৮৫১ সালে স্বদেশবাসীর জন্য কলকাতায় প্রথম হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয় (Native Homoeopathic Hospital and Free Dispensary) স্থাপন করেছিলেন। এই হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে সি. ফেবর টোনিয়ার (C. Fabre Tonneire, M. D.) কে ফ্রান্স থেকে কলকাতায় এনেছিলেন এবং সমস্ত ব্যয়ভার নিজে বহন করেছিলেন। রাজেন্দ্রলাল দত্ত আমেরিকা থেকে হোমিওপ্যাথিতে এম. ডি. ডিগ্রিপ্রাপ্ত ফরাসী চিকিৎসক থিসনেত্তে বেরিনিকে (Thisnette Berigny) কলকাতায় এনেছিলেন।
কলকাতা হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, হোমিওপ্যাথির প্রচার, প্রসার ও বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য সে আমলে রাজেন্দ্রলাল দত্ত সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করেছিলেন। রাজেন্দ্রলাল দত্তের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রচার প্রসারের বিশাল অবদানের জন্য রাজেন্দ্রলাল দত্তকে ‘ভারতীয় হোমিওপ্যাথির জনক’ বলে সম্মান জানানো হয়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের খ্যাতনামা ডাক্তার সূর্যকুমার সর্বাধিকারী রাজেন্দ্রলাল দত্তকে Tower of Learning বা ‘জ্ঞান চুড়ামণি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে সাহিত্যিক শিবনাথ শাস্ত্রী বঙ্গ সমাজ পত্রিকার ১৮৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আমি অনেকবার তাঁহার সহিত গাড়িতে, তাঁহার সাথে রোগী দেখিতে গিয়াছি ও তিনি কিরূপ একাগ্রতার সাথে চিকিৎসা করিতেন তাহা দেখিয়াছি। রোগীকে বাঁচাইবার জন্য যে ব্যগ্রতা, পরিবার পরিজনের সঙ্গে সম দুঃখ-সুখতা আর দেখিব না’। পরবর্তীতে কলকাতায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেছেন জার্মানির লিওপোল্ড সালাজার (Leopold Salazar)।
সে সময় কলকাতার বিখ্যাত অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার এম. ডি. ছিলেন হোমিওপ্যাথির কড়া সমালোচক। অন্যদিকে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার ও অন্যান্য অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকগণ যেসব রোগীদের জীবনের আশা ত্যাগ করে জবাব দিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের অনেকেই রাজেন্দ্রলাল দত্তের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করে রীতিমতো বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। ১৮৬৫ সালের দিকে ডা. রাজেন্দ্রলাল দত্তের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার অ্যালোপ্যাথি ত্যাগ করে হোমিওপ্যাথিতে আত্মনিয়োগ করেন। এশিয়া মহাদেশে সেই প্রথম একজন এম. ডি. চিকিৎসক হলেন হোমিওপ্যাথ, হ্যানিম্যানের অনুসারী।
রাজেন্দ্র বাবু ও মহেন্দ্রলালের যুগপৎ প্রচেষ্টায় হোমিওপ্যাথিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার হোমিওপ্যাথিকে বৃহত্তর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৮৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করেন ‘The Calcutta Journal of Homoeopathy’, ভারতের প্রথম প্রকাশিত হোমিওপ্যাথিক পত্রিকা। এই পত্রিকায় তিনি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকদের কড়া সমালোচনা করতেন এবং হোমিওপ্যাথির সুফল বর্ণনা করতেন। যে মহেন্দ্রলাল ছিলেন হোমিওপ্যাথির বড় সমালোচক তিনিই হলেন হোমিওপ্যাথির বড় সমর্থক। মহেন্দ্রলাল হোমিওপ্যাথিকে এত গভীরভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে তাঁকে ‘এশিয়ার হ্যানিমান’ বলা হতো।
ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার
১৮৭৬ সালের দিকে হোমিওপ্যাথির আরেক সেবক ডা. বসন্তকুমার বাংলাভাষায় একটি হোমিওপ্যাথিক জার্নাল প্রকাশ করেন- যা অবিভক্ত বাংলায় হোমিওপ্যাথির বিস্তারে বিশাল প্রভাব ফেলে। কলকাতা ছিল সে সময়ে বৃটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী, ফলে কলকাতা থেকে হোমিওপ্যাথি সমগ্র ভারতবর্ষে বিকাশ লাভ করে। সে সময়ে ভারতে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসার প্রসারে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যেমন- সর্ব ডাঃ লোকনাথ মৈত্র, বিহারীলাল ভাদুড়ী, ফাদার ম্যূলার, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, মোহিনীমোহন বসু, দীনবন্ধু মুখোপাধ্যায়, জগৎচন্দ্র রায়, দ্বারকানাথ রায়, বজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, ডবলু ইউনান, নগেন্দ্রনাথ মজুমদার, বিজয়চন্দ্র সিংহ, নীলমণি ঘটক, বারিদবরণ মুখার্জী, অবনীনাথ দাশগুপ্ত, বামাচরণ দাস, জিতেন্দ্রনাথ মজুমদার, দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ সহ আরো অনেকে। হোমিওপ্যাথির গুণমুগ্ধ হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বিশ্বকবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর হোমিওপ্যাথির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য পাওয়া সুদূর পরাহত দেখে ডাঃ প্রতাপ চন্দ্র ও ডাঃ এম. এম. বসু কলকাতার আমহার্ট স্ট্রীটে ভারতের প্রথম হোমিওপ্যাথিক স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ডাঃ দ্বারকানাথ রায়ের সহযোগিতায় ১৮৮১ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ‘ক্যালকাটা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, পৃথিবীর বৃহত্তম হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ রূপে যা আজও বিদ্যমান।
বিংশ শতাব্দির প্রথম কয়েক দশক ভারতীয় হোমিওপ্যাথির গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ক্যালকাটা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও হোমিওপ্যাথি শিক্ষা বিস্তারের জন্য কলকাতা শহরে স্থাপিত হয় আরও কয়েকটি কলেজ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ডানহাম হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’, ‘অ্যালেন হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’, ‘হেরিং হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’, ‘আশুতোষ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’, ‘রেগুলার হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’, ‘সেন্ট্রাল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’, ‘বেঙ্গল হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’ প্রভৃতি। এইসব কলেজগুলি আপন বিধি অনুযায়ী ছাত্র ভর্তি করতেন, শিক্ষা দিতেন। কলেজগুলির পঠন-পাঠন ব্যবস্থা, সিলেবাস, সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রত্যেক কলেজের পৃথক আইন- কানুন ছিল। বেসরকারী কলেজ, বেসরকারী সার্টিফিকেট।
১৯৩৪ সালের ১লা মার্চ চট্রগামে ডাঃ জাকির হোসেন চৌধুরী এবং সমাজ সেবক আব্দুল হক দোভাষের প্রচেষ্টায় ‘প্যারাডাইজ হোমিওপ্যাথি কলেজ” প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৮ সালে এই কলেজের নামকরণ করা হয় “ইষ্ট পাকিস্তান হোমিওপ্যাথিক কলেজ” এবং ১৯৭২ সালে পুনরায় নাম পরিবর্তন করে “ডাঃ জাকির হোসেন হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল” করা হয়। এই কলেজটি বেঙ্গল গভর্মেন্ট স্টেট ফ্যাকাল্টির অন্তর্ভূক্ত ছিল।
জাকির হোসেন হোমিওপ্যাথিক কলেজ
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩৭ সালে বাংলার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের একটি সভা হয় কলকাতায়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের মাননীয় জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী তমিজউদ্দিন ছিলেন উক্ত সভার সভাপতি। সভায় ‘স্টেট ফ্যাকাল্টি অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন’ গঠনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। উক্ত প্রস্তাব যাতে আইন সভায় পাশ হয় এবং সরকারের সমর্থন পায়, মন্ত্রী মহোদয় সে ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দেন। ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে মিয়া ঘিয়াসউদ্দীন এম. এল. এ. দ্বারা ‘হোমিওপ্যাথিক সিস্টেম অব মেডিসিন’ কেন্দ্রীয় আইন সভায় ৪৪-৩৬ ভোটে পাশ হয়। একই সময়ে ‘সেন্ট্রাল বোর্ড অব হোমিওপ্যাথিক এডুকেশন’ গঠিত হয়। ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল হেলথ মিনিস্টার সৈয়দ নওশের আলী কর্তৃক হোমিওপ্যাথিক বিল আইন সভায় পাশ হয়ে হোমিওপ্যাথি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পায়।
১৯৪৩ সাল থেকে হোমিওপ্যাথিক ফ্যাকাল্টির কার্যক্রম আরম্ভ হয় এবং সবগুলো হোমিওপ্যাথিক কলেজকে একই শিক্ষাব্যবস্থা, সিলেবাস, পরীক্ষা-নীতি, সার্টিফিকেট প্রদানের নীতিভূক্ত করা হয় ও চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসনের অবসানের পর ১৯৮৩ সাল হতে সমগ্র ভারতে একই হোমিওপ্যাথিক ডিপ্লোমা কোর্সের প্রবর্তন করা হয়। কোর্সের নামকরণ করা হয় ডি. এইচ. এম. এস. (ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি)। হোমিওপ্যাথি ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হওয়ার নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা জীববিদ্যাসহ উচ্চ মাধ্যমিক (১০+২) পাশ, চার বছরের শিক্ষাক্রম এবং ভারতে সর্বত্র একই ডিপ্লোমা কোর্স- ডি. এইচ. এম. এস. (DHMS)। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ভারতের প্রায় অনুরূপ ডি. এইচ. এম. এস. কোর্সে ভর্তির নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এস. এস. সি. বা সমমান পাশ, যে কোন শাখা- বিজ্ঞান বাধ্যতামূলক নয়।
ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির বিস্তারে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্ণধারের আছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৮৮৭ সালে কলকাতায় স্থাপিত হয় সি. রিঙ্গার অ্যান্ড কোং নামে হোমিও ওষুধের প্রথম ফার্মেসী বা ওষুধের দোকান, ১৮৮৯ সালে স্থাপিত হয় রায় চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানী নামের ওষুধের দোকান, ১৯১৭ সালে স্থাপিত হয় হ্যানিম্যান পাবলিশিং কোম্পানী, যা ওষুধ তৈরী ও পুস্তক প্রকাশনার ক্ষেত্রে সমগ্র ভারতবর্ষে বিখ্যাত। স্বল্প মূল্যে ওষুধ উৎপাদন ও বিতরণের পুরোভাগে ছিলেন মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য নামে হাওড়া জেলার একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী। ১৮৮৯ সালে তিনি ‘এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং’ নামে কলকাতায় হোমিওপ্যাথিক ওষুধের দোকান প্রতিষ্ঠা করেন, পূর্ববঙ্গের কুমিল্লায় ও ঢাকায় ‘এম ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং’ এর শাখা খোলা হয়। তিনি শুধুমাত্র ওষুধ বিক্রেতাই ছিলেন না, হোমিও চিকিৎসা সংক্রান্ত বাংলা, ভারতীয় অন্য ভাষায় ও ইংরেজী ভাষায় বহু গ্রন্থ তিনি প্রকাশ করেছিলেন।
মহেশ চন্দ্র স্বল্প মূল্যে ওষুধ ও বই বিক্রি করার ব্যবস্থা করায় গ্রাম ও শহরের বহু শিক্ষিত অপেশাদার ব্যক্তিও হোমিওপ্যাথিতে আকৃষ্ট হন। এ ছাড়াও আরও বহু নাম জানা অজানা ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, হোমিও অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় হ্যানিম্যান প্রবর্তিত হোমিওপ্যাথি আজ ভারতবর্ষে তথা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ইত্যাদি দেশে জনগণের নিকট সমাদরে গৃহীত হয়েছে এবং কোন কোন দেশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান আমলে হোমিওপ্যাথি ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের মাধ্যমে এই উপমহাদেশে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান আবার দুটি অংশে বিভক্ত, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান, হাজার মাইলের অধিক দূরত্বে যাদের অবস্থান। বর্তমান বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান নাম নিয়ে পাকিস্তানের অংশ হয়। অনেক হিন্দু চিকিৎসক তখন পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যান, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা তখন শিক্ষাদীক্ষায় ছিল হিন্দুদের তুলনায় অনগ্রসর, ফলে সৃষ্টি হয় চিকিৎসক স্বল্পতা, শিক্ষক স্বল্পতা।
মুসলমানদের মধ্যে কলকাতা কেন্দ্রিক কয়েকজন মুসলমান চিকিৎসক তখন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক। পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে হোমিওপ্যাথি জোড়াতালি দিয়ে চলতে থাকে। উল্লেখ্য যে কলকাতা থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষে হোমিওপ্যাথির বিস্তার ঘটেছিল, কলকাতা ছিল সে সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ও ব্যবসার প্রধান কেন্দ্রস্থল। কলকাতায় স্থাপিত হয়েছিল এ দেশের সর্বপ্রথম হোমিওপ্যাথিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ‘ক্যালকাটা হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’। পরে কলকাতায় আরও কয়েকটি হোমিওপ্যাথি কলেজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এসকল হোমিওপ্যাথিক কলেজ থেকে হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রি নিয়ে অথবা কলকাতার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের কাছ থেকে হোমিওপ্যাথি শিখে অনেকেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, তারপর পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে হোমিওপ্যাথিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। তাঁদের অনেকেরই হোমিওপ্যাথির কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তাঁদেরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হোমিওপ্যাথি হয়ে উঠে সাধারণ জনগণের প্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, হাই-স্কুলের শিক্ষক, মাদ্রাসার শিক্ষক, গ্রামের শিক্ষিত ব্যক্তি, কবিরাজ, এল. এম. এ. এফ., অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক অনেকেই তখন অন্য পেশার পাশাপাশি হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করতেন। অধিকাংশই তখন অন্য চিকিৎসকের কাছে হোমিওপ্যাথির তালিম নিয়ে বা হোমিওপ্যাথির বই পাঠ করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রদান করতেন। জমিদার বা বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গও তখন আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা হোমিওপ্যাথির বিকাশ সাধনে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ
পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) তখন চট্টগ্রামের প্যারাডাইজ হোমিওপ্যাথিক কলেজটি ছাড়া আর ছিল না হোমিওপ্যাথির কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা। অনেকেই তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় একটি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করেন। কলকাতার হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক অধ্যক্ষ ডাঃ আবদুল হামিদ নিজের চেম্বারে তখন কিছু আগ্রহী ব্যক্তিকে হোমিওপ্যাথি শিক্ষা দিতে থাকেন। সকলের পরামর্শে ঢাকার সোয়ারীঘাটের ইসলামিয়া হাই স্কুলে কেবলমাত্র নৈশকালীন কলেজ হিসাবে ১৯৪৮ সালের ৫ই জুলাই প্রতিষ্ঠা করা হয় “পাকিস্তান হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ”, যা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপিত দ্বিতীয় হোমিওপ্যাথিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এই কলেজটি ঢাকায় বঙ্গভবনের দক্ষিণ পার্শ্বে টয়নবি সার্কুলার রোডে সুবিশাল ভবনে স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে এই কলেজে বি. এইচ. এম. এস. ও ডি. এইচ. এম. এস. এই দু’টি কোর্সই একই সাথে চালু আছে।
পরবর্তীতে বিভিন্ন খ্যাতনামা হোমিও চিকিৎসকগণ ও শিক্ষা অনুরাগীদের নিজস্ব উদ্যোগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আরও কয়েকটি হোমিওপাথি শিক্ষার কলেজ স্থাপিত হয়। কলেজের পরিচালনা কমিটির প্রণীত সিলেবাস অনুসারে কলেজের শিক্ষা পরিচালিত হতো, যার কোন সরকারী স্বীকৃতি ছিল না। ১৯৫৮ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ বারির সময়ে পাকিস্তান সরকার হোমিওপ্যাথিক বিলকে বেসরকারী বিল হিসাবে গ্রহণ করে। ১৯৬৪ সালে ইস্ট পাকিস্তান হোমিওপ্যাথিক এসোসিয়েশন এর আয়োজনে ঢাকায় একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সে সময়ে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আলহাজ্ব আবদুল্লাহ জহির উদ্দিন উক্ত কনফারেন্সে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে উপস্থিত হয়েছিলেন। সংসদের বিরোধী দলের নেতা মিঃ মশিউর রহমান হোমিওপ্যাথির পক্ষে বক্তব্য ও দাবীনামা পেশ করেন।
১৯৬৪ সালে চৌধুরী আজিজউদ্দিন একটি বিল তৈরী করলেও সংসদে উত্থাপিত করতে পারেননি, পরে ঐ বিলটি সৈয়দ মুরিদ হোসেন এম. এল. এ. সংসদে উত্থাপন করেন। ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ইউনানী, আয়ুর্বেদী এবং হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিশনার এ্যাক্ট – ১৯৬৫ পাশ হয় এবং এরই ফলে “বোর্ড অব হোমিওপ্যাথিক সিস্টেম অব মেডিসিন-পাকিস্তান” গঠন হয়। বোর্ডের সদর দপ্তর স্থাপিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আঞ্চলিক দপ্তর স্থাপিত হয়। বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট হোমিওচিকিৎসক ডাঃ নূরুল ওহাব এবং প্রথম রেজিস্ট্রার পশ্চিম পাকিস্তানের মিঃ সাবজুয়ারী। এই বোর্ড থেকে সর্ব প্রথম ডাঃ নূরুল ওহাবকে রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়, তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছিল ১।
১৯৬৫ সালে বোর্ড হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আবেদনপত্র জমা নিয়ে ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে। এই বোর্ড প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে হোমিওপ্যাথির আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এই বোর্ড হোমিওপ্যাথি শিক্ষার জন্য একটি সিলেবাস প্রণয়ন করে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের হোমিওপ্যাথি কলেজগুলোর অনুমোদন প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করে। বোর্ড ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত ৩০টি কলেজের মধ্যে মান যাচাই করে মাত্র ৫টি কলেজকে অনুমোদন দেয় এবং ৪ বছরের ডি. এইচ. এম. এস. (ডিপ্লোমা ইন হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন এন্ড সার্জারি) কোর্স চালু করে। ১৯৬৮ সালে নতুন হোমিওপ্যাথিক বোর্ড কমিটি গঠিত হয় কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরূদ্ধে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বোর্ডের কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়।