ডিম আমিষ না নিরামিষ? ডিম কীভাবে খাবেন?

ডিম আমিষ না নিরামিষ?

ডিম আগে না মুরগি আগে! এই বিতর্কের সমাধানই এখনো হয়নি। এর মধ্যেই ডিম নিয়ে নতুন করে আরো একটি বিতর্কের সূচনা হয়েছে। শুধু বিতর্কের খাতিরে যে এই বিতর্ক তাও নয়। বরং এই বিতর্কের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৫০ কোটির বেশি লোকের বিশ্বাসের প্রশ্ন। নতুন এই বিতর্কের বিষয়বস্তু হলো, ডিম আসলে কী ধরনের খাবার আমিষ না নিরামিষ?  অবশেষে বিজ্ঞানীরা জানিয়েই দিলেন, খাদ্যতালিকায় ডিমের আসল অবস্থান।

রোজের খাবারের তালিকায় ডিম থাকে না এমন মানুষ মেলা ভার। তবে আমিষ ভেবে অনেকেই ডিম থেকে দূরে থাকেন। কারণ, ডিম মুরগির শরীর থেকে তৈরি হয়। আর মুরগি জীবন্ত জিনিস। এই যুক্তিতেই একাংশের মত ডিম আমিষ। তবে পালটা যুক্তিও রয়েছে।

তবে বিস্তর গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন ডিম মোটেও আমিষ নয়, বরং নিরামিষ। তাঁদের যুক্তি, ডিমের ৩টি অংশ। ডিমের খোসা, কুসুম এবং সাদা অংশ। গবেষণা বলছে ডিমের সাদা অংশ শুধুমাত্র প্রোটিন দিয়ে তৈরি। আর কুসুমে রয়েছে প্রোটিন ও কোলেস্টেরল। বাজারে খাওয়ার জন্য যে ডিম বিক্রি হয় তা অনিষিক্ত। তার মধ্যে কোনও ভ্রুণ থাকে না। অর্থাৎ,  এই ডিম খেলে জীবহত্যার দায়ে দুষ্ট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।

ডিম কীভাবে খাবেন?

ডিম খুব পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার। বলা হয়, আদর্শ খাবার। প্রোটিনের ভালো উৎস এটি। কেউ কেউ এই ভালো খাবারের পুষ্টি আরো ভালোভাবে পেতে হাফ বয়েল বা আধা সিদ্ধ করে খায়। আবার কেউ কেউ বলকারক মনে করে কাঁচাই খায়।

তবে কাঁচা ডিম শরীরের জন্য কোনো উপকারী বিষয় তো নয়ই, বরং ক্ষতিকর। স্যালমোনেলা বা টাইফয়েডের জীবাণু থাকে কাঁচা ডিমে। সিদ্ধ করলে জীবাণুটি নিষ্ক্রিয় হয়। তবে অর্ধসিদ্ধ করলে বা কাঁচা খেলে এই জীবাণু শরীরে ঢুকে যায় এবং টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

এ ছাড়া ডিমে যে ভিটামিন-বি থাকে, সেটা ডিম সিদ্ধ করলে সক্রিয় হয়। কাঁচা ডিম খেলে ভিটামিন-বি কোনো কাজে আসে না। তাই কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ না খেয়ে চেষ্টা করুন সিদ্ধ ডিম খেতে।

 

ডিম পোচ না সেদ্ধ? কোনটা উপকারী?

ডিম আগে না মুরগি আগে? এ নিয়ে তর্ক থাকলেও, বিতর্ক নেই বাঙ্গালির জীবনে ডিমের আধিপত্য নিয়ে।

সকালের নাশতা থেকে শুরু করে বিকেলের কেক, বিস্কুট কিংবা নুডুলস। সব কিছুতেই রয়েছে ডিমের অংশীদার। এছাড়াও অতিথি আপ্যায়ন, বিয়ে, জন্মদিন এমনকি ঘরে বানানো জামাই পিঠাতেও ডিম যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশের নাম।

কিন্তু তার পরও ডিমকে তার প্রাপ্য মর্যাদা ‘আমিষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে স্বার্থপর বাঙ্গালির কার্পণ্যবোধ গেল না।

বিগত বছরের হিসেব কষলে দেখা যায়, বাঙ্গালির আমিষ-চৈতন্যে ডিম কখনোই একটা ‘সুষম খাদ্য’ বলে পরিগণিত হয়নি। অথচ ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার পর্যন্ত বাঙ্গালীর প্লেটে প্লেটে ডিম গড়াগড়ি খেয়েছে লাটাই সুতোর মতোই।

ডিম যেন তাদের কাছে স্রেফ ভাঙ্গা কুলা। প্রয়োজন হলেই ডিমের কাছে ছুটো। অার প্রয়োজন শেষ তো নাক সিঁটকিয়ে বলো ‘আমি ডিম খাই না’।

তবে অনেকেই আবার রক্তে চর্বির পরিমাণ কম রাখতে, অথবা হৃদরোগকে ভয় পেয়ে ডিম খান না। কিন্তু আসলেই কি ডিম এগুলো বাড়ায়? না। বাড়ায় না। বরং চিকিৎসকেরা বলেন তার উল্টো কথা।

তারা মতে, সকালের নাস্তায় একটি ডিম মাসে প্রায় ৩ পাউণ্ড পর্যন্ত ওজন কমাতে পারে! কী! অবাক হচ্ছেন? আসলে অবাক হওয়ারই কথা। সম্প্রতি ডিমের এইরকম অারো কিছু অবাক হওয়ার মতো কথা তুলে বলছেন পুষ্টিবিদগণ।

তারা বলেন, ছোট্টো একটা ডিমে রয়েছে হাজারো ভিটামিন। এর ভিটামিন বি খাবারকে এনার্জি বা শক্তিতে রূপান্তরিত করতে প্রচুর সাহায্য করে।

ডিমে আছে ভিটামিন এ। যা দৃষ্টিশক্তি করে উন্নত। এছাড়াও ডিমের কেরোটিনয়েড, ল্যুটেন ও জিয়েক্সেনথিন বয়সকালের চোখের অসুখ ম্যাকুলার ডিজেনারেশন হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। এই একই উপাদান চোখের ছানি কমাতেও সাহায্য করে।

মাঝে মধ্যে বার্ড ফ্লু আতংক হিসেবে দেখা দিলে অনেকেই মুরগি থেকে দূরে থাকেন। দূরে থাকেন ডিম থেকেও। যদিও গবেষকরা বলছেন, বার্ড ফ্লু ডিমের ওপর প্রভাব ফেলে না। সুতরাং বার্ড ফ্লুর সময়ও আপনি ডিম খেতে পারেন নিশ্চিন্তে ।

তবে কথা হচ্ছে ডিমতো খাবেন? কিন্তু কীভাবে খাবেন? পোচ, মামলেট না সেদ্ধ? কোনটা অাপনার সাস্থের জন্য উপকারী?

তাহলে আসুন এই দুই খাবারের গুণাগুণ ও অপকারিতা প্রসঙ্গে বাড়ডেম হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ ‘শামসুন্নাহার নাহিদ’ কী বলেন তা জেনে নিই।

তিনি বলেন, তেলে ভাজার কারণে সেদ্ধ ডিমের চেয়ে ডিম পোচে ক্যালরির পরিমাণ বেশি থাকে। যারা ওজন ঠিক রাখতে চায় কিংবা বাড়াতে না চায় তাদের ডিম পোচ না খাওয়াই ভালো।

আর ব্লাডপ্রেশারের সমস্যা থাকলে এটি খাওয়া থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। তবে বাচ্চাদের জন্য ডিম পোচ ভালো। কারণ সেদ্ধ ডিমের চেয়ে ডিম পোচের কুসুমে গুণাগুণ বেশি থাকে।

আর যাদের ব্লাডপ্রেশারের সমস্যা আছে, তাদের জন্য সেদ্ধ ডিমই উত্তম। সেদ্ধ ডিমে আছে ভিটামিন, প্রোটিন ও শরীরের জন্য উপকারী চর্বি উপাদান। ফলে সকাল বেলা একটি সেদ্ধ ডিম খেলে সারাদিন শরীরে শক্তি পাওয়া যায়।

সেদ্ধ ডিমে শরীরের জন্য উপকারী মনোআনস্যাচুরেটেড ও পলিআনস্যাচুরেটেড চর্বি আছে। এগুলো স্যাচুরেটেড ফ্যাটকে সরিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করে এবং রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমিয়ে ফেলে।

ফলে হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। হার্টের জন্য উপকারী এই চর্বিগুলো ইন্সুলিনও নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তের চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

বিশেষ করে টাইপ-২ ডায়বেটিসের জন্য এধরনের ফ্যাটগুলো খুবই উপকারী। সেদ্ধ ডিমের দুই তৃতীয়াংশই এ ধরনের উপকারী ফ্যাট দিয়ে গঠিত।

একটি বড় সেদ্ধ ডিমে প্রায় ৮০% ক্যালোরি আছে। এর মধ্যে ৬০% ক্যালরি আসে চর্বি থেকে। ফলে সকালের নাস্তায় একটি মাত্র সেদ্ধ ডিম খেলে সারাদিন শক্তি পাওয়া যায় এবং দূর্বলতা হ্রাস পায়।

তবে কেউ যদি ক্যালোরি কাট-ছাট করতে চান তাহলে ডিমের কুসুমটা না খেয়ে কেবল মাত্র সাদা অংশটা খান। তাহলে ডিমের ক্যালোরি অর্ধেকেরও বেশি কমে যাবে।

মনে রাখবেন ডিমের সাদা অংশে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। তাই যাদের অ্যালবুমিন কম তারা দিনে একাধিক ডিম খেতে পারেন এবং সেদ্ধ ডিম তাদের জন্য খুবই উপকারী।

আসলে বাইরে আমরা যতোই ডিম বিমুখতার ভান করি না কেন ভেতরে ভেতরে অামরা সবাই যে কম বেশি ডিমনির্ভর তা কিন্তু প্রমাণ হয়ে গেছে ‘বিশ্ব ডিম দিবসে’ই।

তিনটাকা পিছ ডিমের জন্য আমরা যেই দৃশ্য দেখিয়েছি তা অমর হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়। তাই ডিমকে আর অবহেলা নয়। ডিমকে মর্যাদা দিতে শিখুন। তাহলে ডিমও অাপনাকে সু-সাস্থ দিতে কার্পণ্য করবে না।