ডাঃ নরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যয় ও তার বই ” ঔষধ পরিচয় “

-ডা. রবিন বর্মন
আমি উত্তর কলকাতার শহরতলী বেলঘরিয়াতে বসবাস করি।
আনন্দের কথা- ডাঃ নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেলঘরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি বেলঘরিয়াতে বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কলকাতায় যান এবং তখনকার দিনের হোমিওপ্যাথি কোর্স সম্পন্ন করেন।
এরপর তিনি তার পিতার নামে একটি হোমিওপ্যাথিক কলেজ স্থাপন করেছিলেন এবং ডাঃ নীলমনি ঘটককে ঐ কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেছিলেন।
তিনি নিজেও ঐ কলেজে মেটিরিয়া মেডিকা অধ্যাপনা করতেন।
তিনি কঠোরভাবে হ্যানিম্যানিয়ান পদ্ধতিতে হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস করতেন, এবং সেইজন্য বলা যেতে পারে তিনি একজন ক্লাসিকাল হোমিওপ্যাথ ছিলেন।
কিন্তু তিনি যে খুব নাম করা বড় প্রাকটিসনার্স ছিলেন, সে পরিচয় বা লিখন কোথাও সেভাবে উল্লেখ পাই নি,
তিনি পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন, এবং নিরামিষাশী হয়েছিলেন।
তখন থেকে তিনি জুতা বা পাদুকা বর্জন করেছিলেন, এবং খালি পায়ে হাঁটতেন।
তাঁর বই—- ঔষধ পরিচয়,
বঙ্কিমচন্দ্র সাহিত্যিক ছিলেন,
সাহিত্য সম্রাট উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার কঠিন বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করে পরবর্তীতে সহজ সরল বাংলা ভাষায় উপন্যাস তৈরি করে যেমন নাম করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,
নরেন বাবু তেমনি তার আগেকার দিনের বাংলায় লেখা হোমিওপ্যাথিক লেখকদের কঠিন সাধু এবং সংস্কৃত ভাষা ঘেঁষা বাংলা ভাষাকে বিদায় দিয়ে সহজ সরল বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম লিখলেন এই মেটিরিয়া মেডিকা বইটি– ঔষধ পরিচয়।
বইটির জনপ্রিয়তা আগে নিঃসন্দেহে ছিলো, কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি,
আমি ব্যক্তিগতভাবে বইটির জনপ্রিয়তা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি। কারণ দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে আমি আমার অগণিত ছাত্র ছাত্রী এবং শুভানুধ্যায়ীদের নরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই কেনার জন্য অনুপ্রাণিত করেই চলেছি।
কারণ—- প্রথম স্টেজের বই হিসাবে এবং একটি ঔষধের চরিত্রগত লক্ষনগুলিকে মনের মধ্যে গাঁথার জন্য ডাঃ নরেন ব্যানার্জীর বইটি অতি উত্তম।
বাংলাদেশের ডাঃ আব্দুস সামাদ বইটির জনপ্রিয়তা দেখে ঠিক এই ধাঁচেই লিখেছেন, তার হোমিও পারাবার নামের মেটিরিয়া মেডিকা বইটি।
কিন্তু নরেন বাবুর বইটির কয়েকটি জায়গা পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করছে। কয়েকটি জায়গায় নরেনবাবু কয়েকটি ঔষধের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ লক্ষণ না থাকলে সেই ঔষধটি ব্যবহার না করার পক্ষে খুব বেশী জোর দিয়েছেন বা সওয়াল করেছেন,
যা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
লাইনগুলি হয়তো একটু বেশী ইমোশনালি তিনি লিখে ফেলেছেন, যা অনভিপ্রেত , লাইনগুলি অনেক চিকিৎসকদেরকে বিভ্রান্তিও করছে।
বিভিন্ন জায়গায় এরকম কিছু লাইন আমি পড়েছি।
সব জায়গাগুলি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, তবে যে কয়েকটি জায়গা বা লাইন মনে পড়ছে
তা ঔষধের নাম এবং পৃষ্ঠা নং সহ তুলে ধরছি,
★ আর্সেনিকাম এ্যালবাম–পৃষ্ঠা — ১১৫,
“যেখানে দুর্গন্ধ নাই সেইখানে আর্সেনিক হইতে পারে না “।
যে কোন রোগের ক্ষেত্রে কোন ডিসচার্জ বা স্রাবে দুর্গন্ধ না থাকলেও অন্য আরও অনেক মূল্যবান সিমপটমসের উপরে আর্সেনিক অবশ্যই প্রয়োগ করা যাবে, যেমন— মানসিক অস্থিরতা, উদ্বেগ, মধ্যরাতে বৃদ্ধি, পিপাসা, জ্বালা, পরিচ্ছন্ন মানসিকতা, ইত্যাদি।
★ অরাম মেট– পৃষ্ঠা -১০৯,
” যেখানে মানসিক বিকৃতি, জীবনে বিতৃষ্ণা, আত্মহত্যার ইচ্ছা, নৈরাশ্য, বিষন্নতা, আত্মগ্লানি ও অনুশোচনার অভাব, সেইখানে অরাম মেট হইতেই পারে না “,
এখানে অবশ্য অরাম মেটের মূল মানসিক লক্ষনগুলি বলা হয়েছে, তাই বহুলাংশে সত্য হলেও—-এই সব মানসিক লক্ষনাবলী ছাড়াও ফিসার, ফিশচুলা, চুল উঠে যাওয়া, আনডিসেন্ডেড টেস্টিস, হাইপারটেনশন, ইত্যাদি কেসে
মানসিক লক্ষন ছাড়াও খর্বাকৃতি চেহারা, স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা, রাত্রে রোগ বৃদ্ধি, এবং সর্বোপরি বংশগত সিফিলিটিক ডিসক্রেশিয়া পেয়ে অরাম মেট প্রয়োগ করা যেতেই পারে ,
★ কেলি কার্ব, পৃষ্ঠা —২৯৯,
” যেখানে ঘর্ম নাই, সেখানে কেলি কার্ব হইতেই পারে না “,
লেখকের লেখা এই লাইনটিও মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।
কেলি কার্বের—-
রাত ২ টা থেকে ৪ টার মধ্যে রোগ বৃদ্ধি, আক্রান্ত জায়গায় সুঁচ ফোটানো ব্যথা, ডানদিকে রোগ বৃদ্ধি, শীতকাতরতা, চোখের উপর পাতা ফোলা ভাব, স্পর্শকাতরতা , ইত্যাদি লক্ষনগুলি ঘামের থেকেও অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য,
★ ফসফরাস, পৃষ্ঠা —৪০৪,
” পুরুষের মধ্যে সঙ্গমের ইচ্ছা এবং লিঙ্গোচছাস, এবং স্ত্রীলোকদের মধ্যে ঋতুস্রাবের আধিক্য অতি প্রবল ভাবে দেখা না দিলে সহজে ফসফরাস প্রয়োগ করিবেন না “৷,
এই কথাটাও জুনিয়র চিকিৎসক দেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে, এবং মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়, তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে —
পুরুষের যৌনইচছা প্রবল না থাকলে, এবং মহিলাদের মাসিক বা ঋতুস্রাব প্রত্যেক মাসে অত্যন্ত বেশী না হলে ফসফরাস প্রয়োগ না করাই ভালো,
কিন্তু তা কেন করবো? পুরুষের সেকস বেশী এবং মেয়েদের মাসিক বেশী না হলে ফসফরাস দেব না?
যদি ফসফরাসের ফিজিকাল মেক আপ–লম্বা, পাতলা সুন্দর চেহারা, এবং অন্যান্য চরিত্রগত লক্ষন, যেমন—তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, চঞ্চলতা, বজ্রপাতে ও অন্ধকারে ভয়, ঠান্ডা পানীয় খেতে চায়, শরীরে বিশেষ করে পিঠের মাঝখানে জ্বালা , বাম দিকে রোগ বৃদ্ধি, রক্তস্রাবের প্রবনতা, পেট বা বুকে শূন্যবোধ, শীতকাতরতা, ইত্যাদি থাকে, তাহলে ফসফরাস প্রেসক্রিপশন না করে শুধু সেকস বেশী কি না, এবং মাসিক স্রাব পরিমানে বেশী হচ্ছে কি না, তা না পেয়ে ফসফরাস প্রয়োগ না করা — মনে হয় মোটেই সমীচীন হবে না,