এ্যালকোহল কি? হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরীতে এ্যালকোহলের ভূমিকা

-ডা. রবিন বর্মন
অ্যালকোহল জিনিসটা কি তা আমরা মোটামুটি সবাই নিশ্চয় জানি, কারন—হোমিওপ্যাথিক কোর্সের ফার্মেসী বিষয়ে পড়ানো হয়েছিল অ্যালকোহল মানে ৪টি শব্দ–
১) Liquid— তরল পদার্থ,
২) Colorless— রঙীন নয়, সাদা, স্বচছ,
৩) Volatile—–উবে যায় তাড়াতাড়ি,
৪) Inflammable — দাহ্য, চট করে জ্বলে যায়,
অ্যালকোহল দুই প্রকার– ক) ইথাইল অ্যালকোহল, (ইথানল)। খ) মিথাইল অ্যালকোহল, (মিথানল)।
ক) ইথাইল এ্যালকোহল— এই এ্যালকোহল বিষাক্ত নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এবং মদ তৈরী করতে এই অ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়।
খ) মিথাইল অ্যালকোহল — এই এ্যালকোহল বিষাক্ত, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য তৈরী করতে, কাঠ পালিশ করতে, ইত্যাদি কাজে এই অ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়।
তাহলে আমাদের দরকার ইথাইল এ্যালকোহল,
কিভাবে আবিষ্কার হয়েছিলো এই ইথাইল এ্যালকোহল?
” ছোটদের জ্ঞান বিজ্ঞান ” –
বইয়ে ছোটবেলায় পড়েছিলাম- ইরানের সম্রাট বাঈজীদের নাচ গান দেখার সময় একটা পাত্রে রাখা আঙুর খেতেন, তুলার গদিতে অর্ধ শায়িত অবস্থায় হেলান দিয়ে একটার পর একটা আঙ্গুল না খেলে কি করে সে বাঈজীদের নাচের ছন্দে ছন্দে হাতের অাঙুলে তুড়ি মারবে?
কিন্তু একদিন আঙুর খেতে খেতে আঙুর শেষ হয়ে যায়, সম্রাট দেখলেন পাত্রটির তলায় কিছু আঙ্গুরের রস জমে অাছে, তিনি সেই রস খেলেন। কিন্ত সেই রস খাওয়ার পরে একটা অদ্ভুত উন্মাদনা, আমেজ ভাব তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন। তিনি অনুচরদের ঘটনাটা বললেন এবং পরীক্ষা করার জন্য আঙুরের রস করে কিছুদিন রেখে তারপরে খেতে দিতে বললেন, দেখা গেল ঐ রেখে দেওয়া আঙ্গুরের রস পানে তার শরীরে আবার রোমান্স বা এক ধরনের আমেজ বা মাদকতার সৃষ্টি হচ্ছে। সেই থেকে আঙ্গুর পচিয়ে তার নির্যাস থেকে আরম্ভ হল নেশার পানীয় তৈরী করা । কিন্তু সব জায়গায় বা সব ঋতুতে এত আঙ্গুর পাওয়া যায় না, সেইজন্য এরপর থেকে বিভিন্ন খাদ্যশস্য, যেমন–গম, যব, ভুট্টা, এসব পরিচয়ে ঐ রকম পানীয় (ইথাইল অ্যালকোহল) তৈরি হতে থাকলো।
যাই হোক ঐ ফর্মুলা থেকেই বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ফারমেন্টেশন করিয়ে, অর্থাৎ পচিয়ে তৈরী হতে থাকলো নেশার পানীয় বা মাদক রস। আদিবাসী এলাকায় আজও মহুয়ার ফুল থেকে তৈরী হয় তাদের স্পেশাল মাদক বা পানীয়, ঐ পানীয় কয়েক কলসী না থাকলে বিয়ের অনুষ্ঠানই হবে না তাদের। সাঁওতালদের মধ্যে বহু জায়গায় দেখেছি ভাত পচিয়ে এক ধরনের মাদক তৈরি করে তার স্থানীয় নাম হাঁড়িয়া, প্রাচীন বৈদিক সভ্যতায় আমরা পড়েছি সোমরস নামের এক ধরনের মাদক পানীয় পান করতে। আবার শোনা যায় ভিরেট্রাম এলবাম নামক বিষাক্ত গাছের নির্যাস থেকে তৈরী হওয়া এক ধরনের মদ খেয়েই আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত থেকে গ্রীসে ফেরার পথে যুদ্ধতরীর মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল।
যাইহোক, এগুলি সবই টাকার এ পিঠ আর ও পিঠের মতন বিভিন্ন পারসেন্টেজের ইথাইল এ্যালকোহল, যা মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসকে সাময়িক নিস্তেজ রেখে একধরনের আমেজ ও আনব্যালেনসিং তৈরী করায়।
বর্তমানে অতিরিক্ত প্রয়োজন অনুযায়ী ইথাইল এ্যালকোহল বেশী উৎপন্ন করা হয় আখের রস থেকে। তবে, তা হোমিওপ্যাথির জন্য নয়, মদ বানানোর জন্যই মূলত ব্যাপক আখ চাষের প্রদেশ গুলিতে গড়ে উঠেছে ইথাইল এ্যালকোহল তৈরী করার জন্য বড় বড় ফ্যাক্টরী। তারই ছিঁটেফোঁটা আসে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ বানানোর শিল্পে। কারণ হোমিওপ্যাথিক শিল্প তো মদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করার মতন প্রচুর পরিমানে রেভিনিউ দিতে পারবে না সরকারকে, যাই হোক —মদের বিভিন্ন ক্যাটিগরীতে থাকে বিভিন্ন পারসেন্টেজে ইথাইল অ্যালকোহল, বাকীটা পরিশ্রুত জল। যেমন—-
★ ভডকা—( Vodka), সব থেকে বেশী পারসেন্টেজে ইথাইল এ্যালকোহল থাকে যে মদে তার নাম ভডকা, 96 পারসেন্ট ইথাইল অ্যালকোহল, এবং 4 পার্সেন্ট পরিশ্রুত জল মেশানো হয়।
★ হুইস্কি—-( Whiskey), হুইস্কি নামক মদে মেশানো হয় 40 পারসেন্ট ইথাইল এ্যালকোহল, বাকীটা থাকে জল।
★ রাম—-( Rum), রাম নামক মদে থাকে 40 পার্সেন্ট ইথাইল এ্যালকোহল, বাকীটা জল।
★ ওয়াইন —( Wine), ওয়াইন নামক মদে থাকে 11 পারসেন্ট ইথাইল এ্যালকোহল, বাকীটা জল।
★ বিয়ার —-( Beer), বিয়ার নামক মদে সব থেকে কম পারসেন্টেজে থাকে ইথাইল এ্যালকোহল, মাত্র 5 পার্সেন্ট, বাকীটা জল।
মদের এত রকম প্রিপারেশনের মধ্যে সেইজন্য বলা যেতে পারে বিয়ার পানে ক্ষতি তূলনামূলক কিছুটা কম, বরং বিয়ার পানে কিছুটা উপকারও হয়। বলা হয় — দৈনিক 300 থেকে 500 মিলি বিয়ার পান নাকি হার্টের রোগীদের পক্ষে কিছুটা ভালো।
★★ যাই হোক, এখন আসা যাক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ তৈরীতে ইথাইল অ্যালকোহলের কোথায় কেমন ব্যবহার হয়,
★ মাদার টিংচার তৈরি করতে –
মাদার টিংচার তৈরী করতে একটু কড়া বা শক্তিশালী ইথাইল এ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়, তাই প্রায় 95% ইথাইল এ্যালকোহল মাদার তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। এত কড়া বা বেশী পার্সেন্ট কেন?
কারণ– উদ্ভিদের শিকড়, ছাল, বা নির্যাস, যাকে পাল্প বা মন্ড বলা হয়, কোন প্রাণীর দেহের নির্যাস, ইত্যাদি যাতে নষ্ট না হয়, বহুদিন যেন ভালভাবে সংরক্ষণ করা যায়, সেইজন্য মাদার টিংচার করার জন্য বেশী কড়া মাত্রায় ইথাইল এ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়।
তাই যেহেতু মাদার তৈরী করার ক্ষেত্রে এ্যালকোহলকে বেশী পরিমান পরিশ্রুত জল মিশিয়ে লঘুকরণ করা হয় না, সেইজন্য মাদার তৈরি করার জন্য 95 পার্সেন্ট ইথাইল অ্যালকোহল ব্যবহৃত হয়। সেইজন্য এই এ্যালকোহলকে স্ট্রং অ্যালকোহল (Strong Alcohol), বলা হয়,
অনেকে অ্যালকোহল ফর্টিসও বলে থাকে ( Alcohol Fortis)।
★ লিকুইড পোটেনসি তৈরী করতে—
এবারে জানা যাক — লিকুইড পোটেন্সি তৈরি করার জন্য কি ধরণের, অর্থাৎ কত পারসেন্টেজের ইথাইল এ্যালকোহল লাগে বা ব্যবহার করা হয়, এই ক্ষেত্রে যেহেতু কোন গাছের মন্ড,বা প্রাণীদেহের কোন অংশ বহুদিন ধরে প্রিজার্ভ বা সংরক্ষন করার প্রয়োজন হচ্ছে না, তাই এখানে ইথাইল এ্যালকোহল থাকে 88 পারসেন্ট, আর 12 পার্সেন্ট পরিশ্রুত জল মেশানো হয়।
এখানে ঔষধ তৈরী করা হচ্ছে প্রিজার্ভ বা বহুদিন সংরক্ষণ করার জন্য নয়, ডিসপেনস করা বা চটপট সরবরাহ করা, বা ব্যবহার করার জন্য, তাই একে বলা হয় ডিস্পেন্সিং এ্যালকোহল, (Dispensing Alcohol), অনেকে আবার অফিশিয়াল অ্যালকোহল বলে থাকে, (Official Alcohol)।
তবে ইন্ডিয়াতে এই ডিস্পেন্সিং অ্যালকোহলকে আরও বেশী পরিশ্রুত করা হয়, অর্থাৎ রি- ডিসটিলড করা হয়, এই আরো পরিশ্রুত বা ফাইন, বা রি-ডিসটিলড ইথাইল এ্যালকোহলের নাম দেওয়া হয়েছে –রেকটিফায়েড স্পিরিট, বলা হয় 60 O P Rectified Spirit।
60 O P Rectified Spirit বলা হয় কেন?
কারন—-60 over 100 of proof Spirit, রেকটিফাইড স্পিরিটে প্রায় 91 পার্সেন্টের উপরে ইথাইল এ্যালকোহল থাকে, এই রেকটিফাইড স্পিরিট নর্মাল ডিসপেনসিং এ্যালকোহলের থেকে প্রায় 3% বেশী শক্তিশালী হয়।

এবারে মিথাইল অ্যালকোহল সম্মন্ধে দু-চার লাইন বলা যাক—
এই এ্যালকোহল কিন্তু তৈরী হয় প্রাকৃতিক ভারী গ্যাস থেকে, যেমন- রান্নার গ্যাস LPG— (Liquid Petrolium Gas), তেমনি এটা একটা বিষাক্ত গ্যাস, এই এ্যালকোহল থেকে তৈরী বিষাক্ত মদ খেয়ে অনেক জায়গায়, বিশেষ করে গ্রামের অশিক্ষিত শ্রমিক, মজুররা মাঝে মাঝে মারা যায়, তবে সব দামী কোম্পানীর তৈরী মদের মধ্যেও অল্প পরিমানে মেথানোল অর্থাৎ মেথিলেটেড এ্যালকোহল মেশানো হয়।
একবার গুজরাটে মনীষা রানা এবং তার কন্যা নিমিশা রানা মিথাইল এ্যালকোহল দিয়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ পোটেনটাইজেসন করায় ধরা পড়েছিল ও জেল হয়েছিল, অবশ্য তাদের কোন দোষ ছিল না, তাদের সাপ্লায়ার্সরা ইথাইল এ্যালকোহলের বদলে মিথাইল এ্যালকোহল দিয়েছিল।
তাহলে কোথায় ব্যবহার হয় এই মিথাইল অ্যালকোহল?
এই এ্যালকোহল সাধারণত বিভিন্ন কল-কারখানার কাজে, জিনিসপত্র পরিষ্কার করাতে, এবং কাঠের আসবাবপত্র পালিশ করতে ব্যবহৃত হয়, কাঠের পালিশের জন্য অবশ্য মিথাইল অ্যালকোহলের সাথে কিছু পরিমাণ ইথাইল এ্যালকোহল মেশানো হয়, সেই মিশ্রণকে মেথিলেটেড স্পিরিট বলে।
এই আলোচনা প্রসঙ্গে তিনটি শব্দ বা টার্ম মনে রাখা ভালো,
★ এ্যালকোহলিকস—- যারা অফিসিয়াল বা হ্যাবিচুয়াল মদ্যপ, রোজ মদ্যপান করে, তাদেরকে এ্যালকোহলিকস বলে।
★ এ্যালকোহলিজম—- মদ্যপায়ীদের যখন রাত-দিন মদ খাওয়ায়, মদের কুফলের জন্য কিছু নির্দিষ্ট লক্ষন প্রকাশ পায়, যেমন– অনিদ্রা, অক্ষুধা , হাত-পা কাঁপা, শরীরে অস্থিরতা, ইত্যাদি, তখন সব সিমপটমসগুলিকে একসাথে ধরে ঐ রোগকে বলা হয়—এ্যালকোহিলিজম।
★ ডিপসোম্যানিয়া— এই শব্দটি বাইরে কোথাও খুব দেখা যায় না, কিন্তু কেন্ট সাহেব তার রেপার্টরীর মাইন্ড চ্যাপটারে দিয়েছেন, মানে– মদ্যপানের অদম্য ইচ্ছা, যেন রক্তের মধ্যে সেই ইচ্ছা প্রবহমান, বংশানুক্রমিক ভাবে ইচ্ছা, বাবা, কাকারাও খেতেন।

এ্যালকোহল ও রেবিস,
ভালো কোয়ালিটির অ্যালকোহল বা R S কিন্তু একটা ভালো ডিসএনফেক্টান্ট — অর্থাৎ জীবানু নাশক,
তাই R S দিয়ে যে কোনো কাটা, ছেঁড়া, পোকা মাকড় বা ইঁদুর, বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি, জন্তু কামড়ানোর জায়গা পরিষ্কার করা যায়, এবং সেখানে তাৎক্ষণিক কিছু ব্যাসিলাস, বা ভাইরাস, অর্থাৎ কোন জীবানু থাকলে, বা সেই কীট পতঙ্গের, বা প্রাণীদের লালার বিষ লেগে থাকলে তা বিনষ্ট করা যায়, কিন্তু
এক্সেপ্ট রেবিস, বা, জলাতঙ্ক আক্রান্ত কুকুরের কামড়ের জায়গা —–
জলাতঙ্ক হওয়া অর্থাৎ পাগলা কুকুরের কামড়ের জায়গা কিন্তু অ্যালকোহল দিয়ে ওয়াশ করলে রেবিস ভাইরাস মরে না, তাই কোন উপকার হয় না, রেবিস ভাইরাস কুকুরের মুখের লালা যদি কাটা জায়গায় লেগে থাকে, এবং সঙ্গে সঙ্গে যদি মারা সম্ভব হয়, তাহলে একমাত্র কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে ওয়াশ করতে হবে।
তবে জলাতঙ্ক রোগ একবার হয়ে গেলে তারপরে যেহেতু আর কোন চিকিৎসা চলে না, এবং কষ্টকর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সব কিছুর যবনিকা হয়, তাই—কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে ওয়াশ করলেও রোগীকে A R S (এ্যন্টি রেবিস সিরাম ) নেওয়ার জন্য গভর্মেন্ট অথরাইজড সেন্টারে, বা হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
হয়তো প্রয়োজন হতো না,
হয়তো কামড়ানো কুকুরটার জলাতঙ্ক রোগ ছিল না,
হয়তো হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিয়ে রোগীকে সুস্থ করা যেতো,
তা হলেও —- আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, এইসব রোগীদেরকে A R S নিতে অবশ্যই উপদেশ দেবে, কারণ—- রেবিস বা জলাতঙ্ক রোগ একবার আরম্ভ হলে কিন্তু চিকিৎসা নেই, তাই তুমি যদি রোগীকে A R S নিতে না পাঠাও–
পরবর্তীকালে সেই রোগীর জলাতঙ্ক হওয়ার জন্য তোমাকে দোষী সাব্যস্ত হতে হবে, বা দায়ী থাকতে হবে,
তাছাড়া আরও একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে— জলাতঙ্ক রোগের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ভ্যারি করে, সাধারণত দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, মাসের মধ্যেই রোগ আরমভ হয়, তবে দেখা গেছে পাগলা কুকুর কামড়ানোর তিন বছর পরে, বা চার বছর পরে, বা পাঁচ বছর পরে , বা ছয় বছর পরে, বা সাত বছর পরেও জলাতঙ্ক রোগ হয়েছে।