অর্গানন অব মেডিসিন: সূত্র-১৪৩ থেকে ১৭১ পর্যন্ত।
ডি.এইচ.এম.এস (ডিপ্লোমা) কোর্সঃ ২য় বর্ষের সিলেবাসঃ ২য় পর্ব।
(২১) মেটেরিয়া মেডিকা (সূত্র-১৪৩-১৪৫)
#সূত্রঃ ১৪৩। এইরূপে সুস্থ মানব দেহে অনেকগুলি অবিমিশ্র ঔষধ পরীক্ষা করিয়া কৃত্তিম উৎপাদনকারী রূপে তাহারা যেসকল উৎপাদন ও লক্ষণ সৃষ্টি করিতে সমর্থ সেগুলি যদি যত্ন সহকারে ও বিশ্বস্ততার সহিত আমরা লিখি তবে আমরা প্রকৃত মেটেরিয়া মেডিকা (ভৈষজ্ বিজ্ঞান) পাই । সেটি হইল অবিমিশ্র ও ঔষধসমূহের যথার্থ, বিশুদ্ধ ও বিশ্বাসযোগ্য ক্রিয়া প্রণালীর সংগ্রহ, প্রকৃতি দেবীর একখানি গ্রন্থ, যাহাতে শক্তিশালী ঔষধ সমুহ দ্বারা উদ্ভূত স্বাস্থ্যের বিশেষ পরিবর্তন ও লক্ষণসমূহ যেভাবে পর্যবেক্ষকের কাছে ধরা পড়িয়াছে সেইভাবে লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে এবং যাতে পরে সেই সকল ঔষধ দ্বারা আরোগ্যযোগ্য অনেক প্রাকৃতিক সদৃশ চিত্র সন্নিবেশিত আছে। এককথায় তাহার মধ্যে আছে কৃত্তিম পীড়ার অবস্থা সমূহ যাহা তাহাদের সদৃশ প্রাকৃতিক পীড়ার সুনিশ্চিত ও স্থায়ী আরোগ্যের জন্য একমাত্র প্রকৃত, হোমিওপ্যাথিক অর্থাৎ অমোঘ নিরাময়ের উপায় প্রদান করে।
#সূত্রঃ ১৪৪। এই মেটেরিয়া মেডিকা হইতে যাহা কিছু অনুমান নির্ভর, কেবল কথার কথা কিংবা কল্পনাপ্রসূত নিষ্ঠার সহিত বর্জন করিতে হইবে। তাহার প্রত্যেকটি হইবে যত্ন ও সরলতার সহিত জিজ্ঞাসিত প্রকৃতির ভাষা।
#সূত্রঃ ১৪৫। বাস্তবিকই কেবলমাত্র মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন আনয়নকারী বহুসংখ্যক ভেষজের বিশুদ্ধ ক্রিয়া প্রণালীর সহিত সঠিক পরিচয়ের ভিতর দিয়া অগণিত প্রাকৃতিক পীড়ার প্রত্যেকটির জন্য এবং জগতের প্রতিটি ব্যাধির জন্য আমরা একটি উপযুক্ত কৃত্রিম (আরোগ্যদানকারী) পীড়ার সাদৃশ্যযুক্ত একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ আবিষ্কার করিবার যোগ্যতা লাভ করিতে পারি। লক্ষণসমূহের যথার্থতা এবং শক্তিশালী ভেষজসমূহের প্রত্যেকটির ক্রিয়ার দ্বারা সুস্থ দেহের উপরে যে সকল প্রচুর রোগ উপাদানের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে তাহাকে ধন্যবাদ; ইতোমধ্যে এখনই অতি অল্পসংখ্যক রোগ আছে যাহার জন্য বিশুদ্ধ ক্রিয়া সম্বন্ধে অধুনা পরীক্ষিত ঔষধ সমূহের মধ্য হইতে একটিকে পাওয়া যায় না । তাহা বিশেষ কোন গোলযোগ সৃষ্টি না করিয়া মৃদু, সুনিশ্চিত ও স্থায়ীভাবে, মিশ্রিত ও অজ্ঞাত ওষুধসমূহ সম্মানিত পুরাতন এলোপ্যাথিক চিকিৎসাকলার সাধারণ ও বিশেষ ভেষজ বিজ্ঞান দ্বারা সাধিত চিকিৎসা অপেক্ষা বহুগুণে নিশ্চিত ও নিরাপদে স্বাস্থ্য পুনঃপ্রদান করিতে পারে । এই প্রকার মিশ্রিত ঔষধ প্রয়োগে কেবল রোগের বৃদ্ধি ছাড়া রোগসমূহ তো নিরাময় হয়ই না, অচিরপীড়াতেও আরোগ্যদানের সহায়ক না হইয়া বাধা সৃষ্টি করে ও প্রায়ই জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে ।
(২২) সর্বাপেক্ষা উপযোগী ও সুনির্বাচিত ঔষধ (১৪৬-১৪৯)
#সূত্রঃ ১৪৬। প্রকৃত চিকিৎসকের তৃতীয় কর্তব্য হইল হোমিওপ্যাথিক মতে প্রাকৃতিক পীড়ার আরোগ্যপ্রদানকল্পে সেই সকল কৃত্রিম পীড়া উৎপাদক পদার্থের (ঔষধ) বিবেচনাপূর্বক প্রয়োগ যেগুলির বিশুদ্ধ ক্রিয়া নির্ণয়ের জন্য সুস্থ দেহে পরীক্ষণ করা হইয়াছে ।
#সূত্রঃ ১৪৭। মানুষের স্বাস্হ্যে পরিবর্তন আনয়ন করিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে যে সকল ঔষধের পরীক্ষা করা হইয়াছে তাহাদের মধ্যে যেটিরই লক্ষণসমূহে কোন প্রাকৃতিক পীড়ার লক্ষণসমষ্টির সর্বাপেক্ষা সাদৃশ্য আমরা দেখিব তাহাই সর্বাপেক্ষা উপযোগী, সেই রোগের সর্বাপেক্ষা সুনিশ্চিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ এবং তাহাই হইবে সেই রোগের ক্ষেত্রে অব্যর্থ ওষুধ ।
#সূত্রঃ ১৪৮। প্রাকৃতিক ব্যাধিকে দেহের ভিতরে কিংবা বাহিরে অবস্থিত অনিষ্টকারী একটি স্হূল বস্তু বলিয়া মনে করা কখনই উচিত নহে ( সূত্র ১১-১৩) । তাহা এক বিরুদ্ধ ধর্মী সূক্ষ্ম শক্তির দ্বারা (ধারণযোগ্য) উৎপন্ন বলিয়া ধরিতে হইবে। এই শক্তি একপ্রকার সংক্রমনের ন্যায় দেহাভ্যন্তরস্থিত অতীন্দ্রিয় মূল জীবনীশক্তির স্বতঃস্ফূরিত সত্তাকে পিশাচের মত উৎপীড়ন দ্বারা কতগুলি পীড়া ও বিশৃঙ্খলা উৎপাদন করতে বাধ্য করিয়া দেহ ধর্মের নিয়মিত ধারাকে বিপর্যস্ত করে। এই গুলিকে বলা হয় লক্ষণ (রোগ) । এখন যদি এই বিরুদ্ধ শক্তির প্রভাবকে, যাহা শুধু এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হেতু নহে তাহা বজায় রাখিবার ও হেতু, অপসারিত করা যায় যাহা চিকিৎসক যখন একটি কৃত্রিম শক্তি প্রয়োগ করেন, যে কৃত্রিম শক্তি জীবনী শক্তিকে সর্বাপেক্ষা সদৃশ উপায় (হোমিওপ্যাথিক ঔষধ) পরিবর্তিত করতে পারে এবং যাহা ক্ষুদ্রতম মাত্রায় শক্তিতে প্রাকৃতিক পীড়া অপেক্ষা অধিকতর, তাহা হইলে জীবনীশক্তির উপর মূল অনিষ্টকারী শক্তির প্রভাব বলবত্তর সদৃশ কৃত্রিম রোগের কার্যকালে নষ্ট হইয়া যায়। তখন আর জীবনীশক্তির উপর কোন দুষ্ট প্রভাব থাকে না—তাহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যেমন বলা হইয়াছে সেই ভাবে যদি নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ঠিকমতো প্রয়োগ করা হয়, তাহা হইলে সদ্যোবূদ্ধিপ্রাপ্ত অচির প্রাকৃতিক পীড়া—যাহাকে দমন করিতে হইবে—-কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অজ্ঞাতসারেই অন্তর্হিত হইবে। আরও পুরাতন, অধিকতর চিররোগ সমস্ত অস্বাচ্ছন্দ্য সহ তদপেক্ষা কিছু বিলম্বে একই ঔষধের উচ্চতর শক্তির কয়েকমাত্রা ব্যবহারে কিংবা অপর কোন সদৃশতর হোমিওপ্যাথিক ওষুধে প্রশমিত হইবে। অজ্ঞাতসারে সর্বদা দ্রুত পরিবর্তন ভিতর দিয়া স্বাস্থ্য ও আরোগ্য ফিরে আসে। জীবনীশক্তি আবার ব্যাধিমুক্ত হইয়া পূর্বের ন্যায় দেহের সুস্থ প্রাণ প্রিয়া পরিচালনা করিতে সমর্থ হয়, বল ফিরিয়া আসে।
#সূত্রঃ১৪৯। দীর্ঘদিনের ব্যাধির (বিশেষত যেগুলি জটিল প্রকৃতির) আরোগ্যের জন্য অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় লাগে। বিশেষ করিয়া এলোপ্যাথির আনাড়ি চিকিৎসার সহিত আরোগ্যবিহীন প্রাকৃতিক পীড়ার সংমিশ্রণে যে সকল চিররোগের সৃষ্টি হয় তাহাদের আরোগ্যের জন্য আরও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। নির্লজ্জভাবে রোগীর বলশক্তি ও রসরক্তাদি অপহরণের (শিরাকর্তন, জোলাপ প্রভৃতি), দীর্ঘকালব্যাপী বেশি মাত্রায় প্রচন্ড ঔষধসমূহ ব্যবহারে—যাহা অনুরূপ ব্যাধিতে কার্যকরী হইয়াছে বলিয়া অসার মিথ্যা কল্পনার উপর ভিত্তি করিয়া প্রদত্ত হইয়া থাকে—এবং অনুপযুক্ত ধাতব জলে স্নান প্রভৃতির ন্যায় যে সকল প্রধান ব্যবস্থা এলোপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করিয়া থাকেন তাহলে সেই সকল ব্যাধি আরোগ্যের বাহিরে চলিয়া যায়।
(২৩) অচির রোগের চিকিৎসা (সূত্র-১৫০-১৫৬)
সূত্রঃ ১৫০। কেবল স্বল্পকালে পূর্বে দেখা গিয়েছে এই রূপ এক বা একাধিক লক্ষণের কথা রোগী যদি বলে তাহা হইলে চিকিৎসার যোগ্য পূর্ণাঙ্গ ব্যাধি বলিয়া চিকিৎসকের তাহার উপর কোন গুরুত্ব আরোপ করিবার প্রয়োজন নাই । খাদ্যবস্হায় সামান্য কিছু পরিবর্তন করাই এরূপ অসুস্থতাকে দূরীভূত করিবার পক্ষে সাধারণত যথেষ্ট ।
সূত্রঃ ১৫১। কিন্তু রোগী যখন কোন প্রচণ্ড যন্ত্রণার অভিযোগ করে তখন চিকিৎসক অনুসন্ধান করিলে তাহা ছাড়া অপেক্ষাকৃত সামান্য ধরনের হইলেও আরও কতকগুলি লক্ষণ দেখিতে পাইবেন । সেগুলিকে লইয়া রোগের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাইবে।
সূত্রঃ ১৫২। অচিররোগ যত বেশি গুরুতর হইবে তত বেশি সংখ্যক ও বিশেষ ধরনের লক্ষণ তাহাতে সাধারণত থাকিবে এবং তাহার জন্য তত সুনিশ্চিতভাবে একটি উপযুক্ত ঔষধ পাওয়া যাইবে যদি যথেষ্ট সংখ্যক ঔষধ– যাহাদের মধ্য হইতে তাহা বাছিয়া লইতে হইবে—-এবং তাহাদের সঠিক ক্রিয়া সম্বন্ধে জানা থাকে। বহুসংখ্যক ঔষধের লক্ষণ তালিকা হইতে এমন একটি ঔষধ পাওয়া কঠিন হইবে না যাহার আরোগ্যদায়ক কৃত্তিম বিশেষ রোগ উপাদানসমূহ হইতে প্রাকৃতিক পীড়ার লক্ষণ সমষ্টির সদৃশ একটি চিত্র অংকন করা যায় । এই ঔষধই ঈপ্সিত আরোগ্যদায়ক ঔষধ ।
সূত্রঃ ১৫৩। নির্দিষ্ট আরাগ্যদায়ক হোমিওপ্যাথিক ওষুধের এই অনুসন্ধানে অর্থাৎ প্রাকৃতিক রোগের লক্ষণ সমষ্টির সহিত পরিচিত ঔষধ সমূহের তালিকা মিলাইয়াএকটি কৃত্রিম রোগ শক্তি বাহির করিতে রোগীর অধিকার উল্লেখযোগ্য, অনন্য, অসাধারণ, এবং বিচিত্র (পরিচায়ক) চিহ্ন ও লক্ষণাবলী দিকে কেবলমাত্র লক্ষ রাখিতে হইবে। কারণ আরোগ্য কল্পে সর্বাধিক উপযুক্ত হইতে হইলে বিশেষ করিয়া এইগুলির সহিত নির্বাচিত ঔষধের লক্ষণসমূহের খুব বেশি সাদৃশ্য থাকা চাই। অধিকতর সাধারণ ও অস্পষ্ট লক্ষণসমূহ যেমন, অক্ষুধা, মাথাধরা, দুর্বলতা, নিদ্রায় অস্থিরতা, অস্বস্তি প্রভৃতি যতক্ষণ অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট থাকে এবং ঠিকমতো বর্ণনা করা না হয় ততক্ষণ সে গুলির দিকে লক্ষ্য দিবার প্রয়োজন অতি অল্প। কারণ এই প্রকার সাধারণ ধরনের লক্ষণ প্রায় প্রত্যেকটি রোগেই দেখা যায় এবং প্রায় প্রত্যেকটি ঔষধেই পাওয়া যায়।
সূত্রঃ ১৫৪। যোগ্যতম ঔষধের লক্ষণ তালিকা হইতে যে প্রতিরূপ প্রস্তুত করা হয় তাহার মধ্যে যদি সে সকল বিচিত্র, অসাধারণ, অনন্য এবং বিশিষ্ট (পরিচালক) লক্ষণসমূহ বিদ্যমান থাকে যেগুলি অধিকতম সংখ্যায় ও অধিকতম সাদৃশ্যসহ যে রোগ চিকিৎসা করিতে হইবে তাহার মধ্যে দেখা যায়, তাহা হইলে সেই ঔষধই হইবে সেই রোগে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত আরোগ্যদায়ক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। রোগ যদি খুব বেশি পুরাতন না হয় তাহা হইলে সাধারণত প্রথম মাত্রাতেই বেশি কিছু ভুল যোগ ব্যতীত দূরীভূত ও বিনষ্ট হইবে ।
সূত্রঃ ১৫৫। আমি বলিতেছি, বেশি কিছু গোলযোগ ব্যতীত। কারণ এই যোগ্যতম ওষুধের প্রয়োগ ক্ষেত্রে ওষুধের সেই সকল লক্ষণই ক্রিয়াশীল হয় যেগুলির সহিত ও রোগলক্ষণের মিল আছে। দেহাভ্যন্তরে অর্থাৎ জীবনীশক্তির অনুভূতির ক্ষেত্রে প্রথমোক্ত লক্ষণসমূহ শেষোক্তগুলির (দুর্বলতার) স্থান অধিকার করিয়া ধ্বংস করিয়া ফেলে। কিন্তু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের অন্যান্ন লক্ষন, যেগুলি সংখ্যায় প্রায় খুব বেশি, সেই রোগের সহিত কোন প্রকার সম্পর্ক থাকে না বলিয়া আদৌ কার্যকরী হয় না । রোগী প্রতি ঘন্টায় ক্রমশ বোধ করিতে থাকে, সেইজন্য সেগুলি সম্বন্ধে সে প্রায়ই আর কিছু অনুভব করে না কারণ, হোমিওপ্যাথি মতে ব্যবহৃত ঔষধের অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাত্রা এত মৃদু যে রোগের সদৃশ নহে এরূপ অন্যান্য লক্ষণ দেহের রোগ মুক্ত স্থানসমূহে উৎপাদন করিতে পারে না এবং সেইজন্য দেহের যে সকল স্হান রোগের সদৃশ লক্ষণ দ্বারা সর্বাধিক আক্রান্ত ও উত্তেজনাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে সেই সকল স্থানেই হোমিওপ্যাথিক লক্ষণসমূহ ক্রিয়া প্রকাশ করিতে সমর্থ হয়। তাহার ফলে রুগ্ন জীবনীশক্তি সদৃশ অথচ বলবত্তর ঔষধ জনিত পীড়ার বিরুদ্ধেই মাত্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করিতে সমর্থ হয় এবং তদ্বারা মুলব্যাধি বিনষ্ট হয় ।
সূত্রঃ ১৫৬। এমন কোন হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নাই বলিলেই হয় যাহা সুনির্বাচিত হইলেও বিশেষভাবে উপযুক্ত সূক্ষ্ম মাত্রায় প্রযুক্ত না হইলে অত্যন্ত উত্তেজনা ও অনুভূতিপ্রবণ রোগীর ক্ষেত্রে, যতক্ষণ তাহার ক্রিয়া বর্তমান থাকে, অনন্ত একটি সামান্য অস্বভাবিক বিশৃংখলা, কিছু নগণ্য নুন্যতন লক্ষণ উৎপাদন না করে। কারণ ইহা এক প্রকার অসম্ভব যে সমবাহু ও সমকোণ বিশিষ্ট দুইটি ত্রিভুজের মত ঔষধ ও রোগ, লক্ষণের দিক দিয়া, ঠিক একইভাবে পরস্পর মিলিয়া যাইবে। সাধারণ ক্ষেত্রে এই যে তুচ্ছ প্রভেদ তাহা জীবন্ত দেহের প্রচ্ছন্ন ক্রিয়া (শক্তি) দ্বারা সহজেই দূরীভূত হইবে এবং অত্যন্ত দুর্বল না হইলে রোগী তাহা অনুভবই করে না। দেহের উপর বিভিন্ন প্রকার ঔষধের ক্রিয়া, আহারাদির ভুল কিংবা মানসিক উত্তেজনা দ্বারা যদি বাঁধা না পায় তাহা হইলে স্বাস্থ্য উন্নতির পথে চলিতে চলিতে সম্পূর্ণ আরোগ্য পৌঁছায়।
(২৪) সদৃশ বৃদ্ধি বা ঔষধজ রোগ (সূত্র-১৫৭-১৭১)
সূত্রঃ ১৫৭। কিন্তু যদিও ইহা নিশ্চিত যে হোমিওপ্যাথি মতে নির্বাচিত ঔষধ উপযুক্ততা এবং মাত্রায় সূক্ষ্মতার জন্য তাহার সদৃশ অচিররোগকে শান্তভাবে এবং অন্য কোন বিসদৃশ লক্ষণ প্রকাশ না করিয়া অর্থাৎ নতুন কোনো গুরুতর বিশৃঙ্খলা না আনিয়া দূরীভূত ও বিনষ্ট করে, তথাপি মাত্রা যথোচিত ক্ষুদ্র না হইলে এবং যেখানে কয়েক ঘন্টা ধরিয়া মাত্রা কিছু অধিক পরিমাণে দেওয়া হইয়াছে সেখানে প্রায়ই ঔষধ সেবনের অব্যবহিত পরেই প্রথম ঘন্টা কিংবা কয়েক ঘণ্টার জন্য রোগের সামান্য একটা বুদ্ধি দেখা যায় এবং তাহা মূল রোগের এত সদৃশ যে রোগীর কাছে মনে হয় তাহার নিজস্ব রোগেরই বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু তাহা প্রকৃতপক্ষে রোগ অপেক্ষা কিছু বেশি শক্তিশালী অত্যন্ত সদৃশ ওষুধ জনিত রোগ ছাড়া আর কিছুই নহে।
সূত্রঃ ১৫৮। প্রথম কয়েক ঘণ্টার এই সামান্য হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি (যাহা অচিররোগ প্রথম মাত্রাতেই প্রশমিত হইবার প্রায় নিশ্চিত নিদর্শন) ঠিক যে রূপ হওয়া উচিত কারণ একটি প্রাকৃতিক বেঁধে অধিকতর শক্তিশালী হলে যেমন অপর একটি সদৃশ ব্যাধিকে দূরীভূত অভি নষ্ট করে (সূত্র ৪৩-৪৮) সেইরূপ যে ব্যাধিকে নিরাময় করিতে হইবে তাহাকে পরাভূত ও ধ্বংস করিতে হইলে ঔষধজ ব্যাধিকে স্বভাবতই বেশি শক্তিশালী হইতে হইবে।
সূত্রঃ ১৫৯। অচিররোগের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রা যত ক্ষুদ্র হইবে ব্যাধির প্রথম কয়েক ঘণ্টার এই প্রতীয়মান বৃদ্ধিও ক্ষণস্থায়ী হইবে।
সূত্রঃ ১৬০। কিন্তু যেহেতু হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রা কে এত ক্ষুদ্র করা যায় না যাহা সামান্য পুরাতন, জটিলতা শূন্য, সদৃশ প্রাকৃতিক ব্যাধিকে প্রশমিত, পরাভূত এমনকি সম্পূর্ণরূপে নিরাময় ও বিনষ্ট করিতে পারে না, সেই হেতু আমরা বুঝতে পারি যে ঠিক মতো নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, তাহার মাত্রা যদি একেবারে ক্ষুদ্র না হয় তাহা হইলে তাহা সেবনের পরে কেন প্রথম ঘণ্টায় অনুভব যোগ্য এই প্রকার হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি সর্বদাই আনয়ন করে।
সূত্রঃ ১৬১। প্রথম ঘণ্টায় বা কেবল প্রথম কয়েক ঘণ্টায় তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক ঔষধের প্রাথমিক ক্রিয়াহেতু মূলরোগের কিছু বৃদ্ধির যে কথা আমি বলেছি অচিররোগ যাহা সম্প্রতি হইয়াছে তাহা সম্বন্ধে সত্য। কিন্তু যেখানে দীর্ঘ প্রিয় ঔষধ সমূহকে বহুদিনের পুরাতন যুগের সহিত লড়াই করতে হয় সেখানে চিকিৎসাকালে মূলরোগের এই রোগ বৃদ্ধি ঘটা উচিত নহে এবং তাহা ঘটে না যদি সুনিশ্চিত ঔষধ যথোচিত ক্ষুদ্র মাত্রায় প্রত্যেকবার কিঞ্চিৎ উচ্চতর নূতন শক্তিতে পরিবর্তিত করিয়া দেওয়া হয়। চির রোগের মূল লক্ষণসমূহের এই প্রকার বৃদ্ধি চিকিৎসার শেষ ভাগে, যখন আরোগ্য প্রায় আসন্ন কিংবা তাহা সম্পূর্ণ সাধিত হইয়াছে তখনই কেবল হইতে পারে।
সূত্রঃ ১৬২। পরিমিত সংখ্যক ওষুধেরই যথার্থ বিশুদ্ধ ক্রিয়া এযাবৎ জানা গিয়াছে বলিয়া কখনও কখনও চিকিৎসাধীন পীড়ার লক্ষণসমূহের অংশমাত্র সুনির্বাচিত ঔষধের লক্ষণ তালিকার মধ্যে দেখা যায়। সেই জন্য অধিকতর উপযুক্ত ঔষধের অভাবে এই অসম্পূর্ণভাবে পীড়া উৎপাদক ঔষধকেই প্রয়োগ করা হয়।
সূত্রঃ ১৬৩। এই ক্ষেত্রে ঔষধ হইতে আমরা পূর্ণাঙ্গ উপদ্রবহীন আরোগ্য লাভ বস্তুত আশা করিতে পারি না। কারণ ঔষধের ব্যবহারকালে এমন কতকগুলি লক্ষণ আসিয়া উপস্থিত হয় যেগুলিকে পূর্বে ঐ রোগে দেখা যায় নাই। সেইগুলি হইল ঔষধের অনুপযুক্ততা হেতু অতিরিক্ত লক্ষণ ( accessory symptoms) । ইহা কিন্তু রোগের অনেকখানি অংশ ( রোগলক্ষণের সহিত ঔষুধ লক্ষণের যতখানি মিল আছে) নির্মল করিয়া আরোগ্য সূচনা করিবার কোন বাধা হয়না। তথাপি ঐসকল অতিরিক্ত লক্ষণ বাদ দিয়া তাহা ঘটে না। অবশ্য ওষুধের মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে অল্প থাকিলে ঐসকল লক্ষণ পরিমিত ভাবেই দেখা যায়।
সূত্রঃ ১৬৪। সর্বোত্তম সুনির্বাচিত ঔষধের মধ্যে কয়েকটি মাত্র সাদৃশ্য থাকলেও তাহা আরোগ্যের পথে বাধা হয় না যদি ঔষধের সেই কয়েকটি লক্ষণ প্রধানত রোগের অসাধারণ এবং অদ্ভুত ধরনের বৈশিষ্ট্য নির্দেশক (পরিচয়জ্ঞাপক) লক্ষণ হয় । এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন উপদ্রব ছাড়াই আরোগ্য হয় ।
সূত্রঃ ১৬৫। কিন্তু যদি নির্বাচিত ঔষধের লক্ষণ সমূহের মধ্যে এমন কোন লক্ষণ না থাকে যাহা সঠিকভাবে রোগের বিশেষ, অদ্ভুত ও অসাধারণ লক্ষণ সমূহের সদৃশ, যদি কেবলমাত্র রোগের সাধারণ, অস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত অনিশ্চিত অবস্থাগুলির (বমনভাব, দুর্বলতা, মাথাব্যথা প্রভৃতি) সহিতই ঔষধটি মিল থাকে এবং যদি পরিচিত ঔষধ সমূহের মধ্যে সেটি অপেক্ষা আর কোন সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট উপযুক্ত ঔষধ না পাওয়া যায়, তাহা হইলে চিকিৎসক এই প্রকার অসদৃশ্ ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা কোন আশু সুফল প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন না।
সূত্রঃ ১৬৬। এইরূপ ক্ষেত্র কিন্তু খুবই বিরল। কারণ অধিক সংখ্যক ঔষধের যথার্থ ক্রিয়ার সহিত পরিচয় এখন আমাদের হইয়াছে এবং ঔষধ জনিত কুফল যদি দেখা যায় তাহা হইলে পরবর্তী অধিকতর সদৃশ ঔষধের নির্বাচন দ্বারা তখনই তাহা হ্রাস করা যায়।
সূত্রঃ ১৬৭। এইভাবে অনুপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রথম প্রয়োগ করিয়া যদি ধর্তব্য কিছু অতিরিক্ত লক্ষণ আসিয়া উপস্থিত হয় তাহা হইলে অচিররোগের ক্ষেত্রে প্রথম মাত্রায় ক্রিয়া শেষ করিতে দিই না বা ওষুধের পূর্ণ ক্রিয়া রোগীকে ভোগ করিতে দিই না বরং পরিবর্তিত অবস্থায় নতুনভাবে আমরা রোগ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করি এবং রোগের নতুন চিত্র অঙ্কনের জন্য সাম্প্রতিক লক্ষণগুলির সহিত আদি লক্ষণ সমূহের অবশিষ্টগুলি যোগ করে লই ।
সূত্রঃ ১৬৮। আমরা তখন আরও অধিক ক্ষিপ্রতার সহিত পরিচিত ঔষধ সমূহের মধ্য হইতে আমাদের চিকিৎসাধীন পীড়ার সদৃশ এমন একটি ঔষধ বাহির করিতে পারিব যাহার একমাত্র রোগকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না করিলেও আরোগ্য পথে অনেক আগাইয়া লইয়া যাইবে। এই ঔষধ ও যদি স্বাস্থ্যোদ্ধারের পক্ষে যথেষ্ট না হয় তখন রুগ্নাবস্বায় যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে তাহা বারবার পরীক্ষা করিয়া এবং তজ্জন্য যতসম্ভব উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করিয়া যে পর্যন্ত আমাদের উদ্দেশ্য অর্থাৎ রোগীর সম্পূর্ণ স্বাস্হ্যলাভ সাধিত না হয় সেই পর্যন্ত এই ভাবে আমরা চলিত থাকিব।
সূত্রঃ ১৬৯। প্রথম রোগ পরীক্ষা এবং প্রথম ঔষধ নির্বাচন করিতে গিয়া যদি আমরা দেখি যে যথেষ্ট সংখ্যক ঔষধের সহিত পরিচয় না থাকাহেতু একটিমাত্র ওষুধের পীড়া উৎপাদনের ভিতরে রোগের সমগ্র লক্ষণ সমষ্টি ধরা পড়িতেছে না, উপযুক্ততার দিক দিয়া দুইটি ঔষধ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেছে, রোগলক্ষণের একাংশের জন্য একটিকে এবং অপরঅংশের জন্য অপরটিকে উপযুক্ত বলিয়া মনে হইতেছে, তখন সেই দুইটির মধ্যে অধিকতর উপযুক্ত ওষুধটিকে প্রয়োগ করিবার পর রোগীকে পুনরায় পরীক্ষা না করিয়া দ্বিতীয়টিকে প্রয়োগ করা কর্তব্য নহে, দুইটিকে একসঙ্গে দেওয়া আরও অনুচিত (টীকা ২৭২ সূত্র) । কারণ যেঔষধ টিকে প্রথমটির পরেই যোগ্যতর বলিয়া মনে হইয়াছিল ইতিমধ্যে অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় তাহা অবশিষ্ট লক্ষণসমূহের জন্য আর দরকার নাও হইতে পারে। অতএব সে ক্ষেত্রে নূতনভাবে পরীক্ষায় যে লক্ষণ সমষ্টি দেখা যাইবে তজ্জন্য দ্বিতীয় ঔষধটির স্থানে একটি যোগ্যতার সদৃশ ওষুধ নির্বাচন করা প্রয়োজন হইবে।
সূত্রঃ ১৭০। অতএব প্রত্যেক ক্ষেত্রে, যেমন এই ক্ষেত্রে, রোগাবস্তার পরিবর্তন ঘটলে তখনকার অবশিষ্ট লক্ষণগুলি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে হইবে এবং যে ঔষধটিকে পরবর্তী উপযুক্ত ঔষধ বলিয়া মনে হইয়াছিল সেটির দিকে ঝোঁক না দিয়া অন্য একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ—যাহা উপস্হিত ক্ষেত্রে যথাসম্ভব উপযোগী তাহা নির্বাচন করিতে হইবে। এইরূপ যদি হয়, যদিও তারা প্রায়ই ঘটে না, যে ওষুধটিকে প্রথমে পরবর্তী উপযুক্ত ঔষধ বলিয়া মনে হইয়াছিল তাহা তখন ও অবশিষ্ট রুগ্নাবস্থায় জন্য উপযোগী, তাহা হইলে তাহা আমাদের কাছে আরও নির্ভরযোগ্য এবং অন্য ঔষধ না দিয়া সেইটিকে তখন প্রয়োগ করাই যুক্তিযুক্ত।
সূত্রঃ ১৭১। অযৌন চিররোগ অর্থাৎ যে সকল রোগ খুব সাধারণভাবে সোরা হইতে উৎপন্ন সেই সকল ক্ষেত্রে আরোগ্যের জন্য প্রায়ই আমাদিগকে পরপর কতকগুলি সোরাদোষঘ্ন ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয়। পূর্ববর্তী ঔষধটির ক্রিয়া শেষ হইবার পর যে সকল লক্ষণ অবশিষ্ট থাকে তাহার সহিত সদৃশ্য মিলাইয়া আবার পরবর্তী ঔষধ নির্বাচন করা হয়।
(সমাপ্ত)