অর্গানন অব মেডিসিন: সূত্র-৮৩ থেকে ১৪২ পর্যন্ত।

ডি.এইচ.এম.এস (ডিপ্লোমা) কোর্সঃ ২য় বর্ষের সিলেবাসঃ ১ম পর্ব।
(১৪) রোগীলিপি প্রণয়ন ও রোগলক্ষণ নির্বাচন (সূত্র-৮৩-১০২)
#সূত্রঃ ৮৩। প্রত্যেকটি রোগীকে ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে এখানে আমি সাধারণ নির্দেশ দেব এবং তাহার প্রত্যেকটির সম্বন্ধে যাহা প্রাসঙ্গিক তাহাই মাত্র চিকিৎসকের স্বরণ রাখিতে হইবে। এইরূপ পরীক্ষাকার্যে চিকিৎসকের পক্ষে যাহা প্রয়োজন তাহা হইল পূর্বসংস্কার হইতে মুক্তি, ইন্দ্রিয় শক্তির অটুট কর্মপটুতা, মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষন এবং রোগচিত্র অংকনে বিশ্বস্ততা।
#সূত্রঃ ৮৪। রোগী তাহার পীড়ার ইতিহাস বর্ণনা করিবে, রোগীর কষ্ট সম্বন্ধে যাহা কিছু শুনিয়াছে তাহা রোগীর পরিচর্যাকারীগণ বলিবে, রোগী কিরূপ আচরণ করে এবং তাহারাই বা কি লক্ষ্য করিয়াছে তাহারা তাহাও বলিবে। চিকিৎসক নিজে দেখিবেন, শুনিবেন এবং অন্যান্য ইন্দ্রিয় সাহায্যে রোগীর ভিতরে কোন পরিবর্তন বা অস্বাভাবিক যাহা কিছু আছে তাহা লক্ষ্য করিবেন। রোগী এবং তাহার বন্ধুগণ যেভাবে বলেন ঠিক সেইভাবে চিকিৎসক সেসকল লিখিয়া লইবেন। তিনি নিজে চুপ করিয়া থাকিয়া তাহাদের যাহা কিছু বলিবার আছে বলিতে দিবেন এবং বক্তব্য অন্য প্রসঙ্গে চলিয়া না গেলে কোনোরূপ বাঁধাই দেবেন না। যাহাতে বক্তাগনের বক্তব্যের প্রয়োজনীয় অংশগুলির লিখিয়া লইতে পারেন সেজন্য রোগীলিপি প্রস্তুত করিবার প্রারম্ভে ধীরে ধীরে বলিবার জন্য তিনি তাঁহাদিগকে উপদেশ দিবেন।
#সূত্রঃ ৮৫। রোগী কিংবা তাঁহার বন্ধুগণ কথিত প্রত্যেকটি নতুন নতুন অনুচ্ছেদ লিখিতে আরম্ভ করিবেন-
রোগী কিংবা তাঁহার বন্ধুগণ কথিত প্রত্যেকটি নূতন ঘটনা নূতন অনুচ্ছেদে লিখিতে আরম্ভ করিবেন। ইহাতে লক্ষণগুলি শ্রেণীবদ্ধভাবে একটির নিচে আর একটি আলাদা আলাদাভাবে সাজানো হইবে এবং প্রথমে অস্পষ্ট রূপে কিছু বলা হইয়া থাকিলে ও পরে তাহা আরও পূর্ণাঙ্গ করিয়া বলা হইলে তিনি সেইটির সহিত যোগ করিয়া লইবার সুবিধা পাইবেন।
#সূত্রঃ ৮৬। বর্ণনাকারীর স্বতঃস্ফূর্ত বক্তব্য শেষ হওবার পর চিকিৎসক প্রত্যেকটি বিশেষ লক্ষণের দিকে নজর দিবেন এবং সেই সম্বন্ধে আরও সঠিক বিবরণ জানিবার জন্য তাহাকে যেভাবে বলা হইয়াছে সেই ভাবে একটির পর একটি লক্ষণ পড়িয়া শুনাইবেন এবং প্রত্যেকটি সম্বন্ধে আরও বিশেষ তথ্য জানিবার জন্য প্রশ্ন করবেন; যেমন কোন সময়ে এই লক্ষণটি দেখা গিয়েছিল? রোগী এখন যে ঔষধ খাইতেছে তাহার পূর্বে কি এই লক্ষণ ছিল না? ঔষধ ব্যাবহারকালীন ইহা দেখা দিয়েছিল? অথবা ঔষধ বন্ধ করিবার কয়েকদিন পর দেখা দিয়েছে? কি ধরনের বেদনা, ঠিক কেমন বোধ হয়, তাহা কি এই স্থানেই হইয়াছিল? ঠিক কোন জায়গায় হইয়াছিল? যন্ত্রণায় কি আপনা আপনি যখন তখন হইত, না বিভিন্ন সময়ে? যন্ত্রণা কি সদা সর্বদা লাগিয়ে থাকিত? কতক্ষণ তাহা থাকিত?দিবারাত্রির কোন সময়ে এবং দেহের কি প্রকার অবস্থানে তাহা বাড়িত কিংবা সম্পূর্ণ কমিয়া যাইত? সাদা কথায় বলিতে গেলে বর্ণিত বিষয়ের সঠিক প্রকৃতি কিরূপ ছিল?
#সূত্রঃ ৮৭। এইরূপে চিকিৎসক প্রতিটি বৃত্তান্ত সঠিক জানতে পারেন কিন্তু তিনি মনে এমন কোন প্রশ্ন করিবেন না যাহা হইতে রোগী হ্যাঁ কিংবা না বলিয়া উত্তর দিবার কোন ইঙ্গিত পায়। তাহা হইলে রোগী আলস্য বা বিভ্রান্তিবশত কিংবা প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য হাঁ কিংবা না বলিয়া অসত্য অর্ধসত্য কিংবা ঠিক সত্য নহে এমন কিছু বলিতে প্রবৃত্ত হইবেন। ইহাতে রোগের একটা মিথ্যা চিত্র অঙ্কিত ও অনুপযোগী চিকিৎসা হইবে ।
#সূত্রঃ ৮৮। এই সকল স্বেচ্ছাকৃত বর্ণনায় যদি দেহের ক্রিয়াগত কিংবা মানসিক কোন তথ্য বাদ পড়িয়া যায় তাহা হইলে সেই অংশ ও তাহার ক্রিয়া কিংবা মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে আর কি বলার আছে তাহা চিকিৎসক জানিয়ে লইবেন। কিন্তু ইহা জানিয়া লইবার সময়ে তাহার প্রশ্ন হইবে সাধারণ ধরনের যাহাতে বর্ণনাকারী সে সম্বন্ধে বিশেষ বিবরণ দিতে বাধ্য হয়।
#সূত্রঃ ৮৯। যখন রোগী (ভান করা রোগের ক্ষেত্র ছাড়া অনুভূতির বিবরণের জন্য প্রধানত তাহারই উপর বিশ্বাস স্থাপন করিতে হয়) স্বতঃস্ফূর্ত বিবরণের মাধ্যমে এবং প্রশ্নের উত্তরে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করিয়া রোগের প্রায় যথাযথ একটা চিত্র অঙ্কিত করিয়াছে তখন চিকিৎসক ইচ্ছা করিলে এবং প্রয়োজন বোধ করলে (যদি তিনি মনে করেন যে তাহার প্রয়োজনীয় সকল তথ্য তখন ও পাওয়া যায় নাই ) আরও সঠিক, আর ও বিশেষ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারেন।
#সূত্রঃ ৯০। এই সকল বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে চিকিৎসকের লেখা শেষ হইলে তিনি তখন নিজে রোগী সম্বন্ধে কি পর্যবেক্ষণ করেন তাহা লিপিবদ্ধ করিবেন এবং তাহার কতখানি রোগীর সুস্থ অবস্থায় ছিল তাহা নিরূপণ করবেন ।
#সূত্রঃ ৯১। পূর্বের ঔষধ ব্যবহারের সময় যে সকল লক্ষণ ও অনুভূতি প্রকাশ পাইয়াছিল তাহা হইতে রোগের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। অপরপক্ষে যে সকল লক্ষণ ও যন্ত্রণা ঔষধ ব্যাবহারের পূর্বে বা কিছুদিন ঔষধ ব্যবহার বন্ধ করিবার পরে দেখা গিয়েছিল তাহা হইতে রোগের আসল প্রকৃতি সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। এইগুলি চিকিৎসক বিশেষ করিয়া লিখিয়া লইবেন। রোগটি যদি চিররোগ জাতীয় হয় এবং চিকিৎসকের কাছে আসা পর্যন্ত রোগী যদি ঔষধ নয় এমন কিছু দিয়া কিছুদিন রাখিয়া তাহার পরে আরো সঠিকভাবে রোগ লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার সুবিধা জনক। তাহা হইলে, পুরাতন রোগের অবিমিশ্র স্থায়ী লক্ষণগুলি বিশুদ্ধ ভাবে বুঝা যাইবে এবং তদ্বারা রোগের যথার্থ চিত্র পাওয়া সম্ভব হইবে।
#সূত্রঃ ৯২। কিন্তু রোগ যদি দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে চলে এবং তাহার গুরুতর অবস্থার জন্য বিলম্ব করা নাচলে তাহা হইলে ঔষধ ব্যাবহারের পূর্বে কি লক্ষণ ছিল জানা সম্ভব না হইলেও ঔষধ জনিত রোগের বিকৃতি চিত্র লইয়াই চিকিৎসককে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে। ইহা হইতে তিনি অত্যন্ত তখনকার মত রুপ চিত্র সম্বন্ধে একটা সমগ্র ধারণা করিয়া লইতে পারবেন অর্থাৎ ওষুধজ ও মূল রোগের মিশ্রিত একটি চিত্র, যাহা অনুপোযোগী ঔষধ ব্যবহারের ফলে উদ্ভূত এবং মূলরোগ হইতে অধিকতর গুরুত্ব ও সাংঘাতিক এবং সেইজন্য যাহার দ্রুত ও কার্যকরী সাহায্যের প্রয়োজন। এইরূপে তিনি সম্পূর্ণ চিত্র অংকন করিয়া সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দ্বারা ইহার প্রতিকার সাধনে সামর্থ্য হল। তাহার ফলে রোগী যে সকল ক্ষতিকর ঔষধ গলাধঃকরণ করিয়াছে তাহার কবলে তাহাকে আত্মসমর্পণ করতে হয় না।
#সূত্রঃ ৯৩। যদি অল্প দিনে কিংবা চিররোগের ক্ষেত্রে বহুকাল পূর্ব হইতে কোন সুনিশ্চিত কারণে রোগের আবির্ভাব ঘটিয়া থাকে তাহা হইলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিংবা সাবধানে প্রশ্ন করা হইলে তাহার উত্তরে তাহারা সে কথা উল্লেখ করিবে ।
#সূত্রঃ ৯৪। চিররোগসমূহের অবস্থাবিষয়ে অনুসন্ধান করার সময়ে রোগীর সাধারণ কাজকর্ম, তাহার স্বাভাবিক বসবাস ও খাদ্য , পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে বিশেষ তথ্য ভালরূপে বিবেচনা করা ও তন্ন তন্ন করিয়া দেখা কর্তব্য। তদ্দ্বারা সেগুলির মধ্যে রোগের কি উৎপাদক বা পরিপোষক কারণ আছে জানা যাইবে এবং তাহা হইলে সেগুলির দূরীকরণ দ্বারা আরোগ্যের পথ সুগম হইবে।
#সূত্রঃ ৯৫। চিররোগ সম্বন্ধে উল্লেখিত লক্ষণসমূহ ও অন্যান্য বিষয় যতদূর সম্ভব যত্নসহকারে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে অনুধাবন করিতে হইবে এবং সূক্ষ্মতম বৈশিষ্ট্য গুলি লক্ষ্য করিতে হইবে। কেননা, সেইগুলো অচিররোগে না মিলিলেও সেই সকল পীড়ায় সর্বাধিক পরিচয় বহন করে এবং রোগনিরাময়ের পক্ষে সেগুলির আর প্রয়োজন নাই বলিয়া ছাড়িয়া দেওয়া কর্তব্য নহে। আরো কারণ হইল, দীর্ঘকাল ভুগিতে ভুগিতে রোগী এইরূপ অভ্যস্ত হইয়া পড়ে যে ছোটখাট আনুষঙ্গিক লক্ষণ তাহার গাসহ্য হইয়া যায়, অথচ সেগুলি অত্যন্ত মূল্যবান এবং ঔষধ নির্বাচনের পক্ষে প্রায়ই অত্যাবশ্যক। স্বাস্থ্যের মতো সেগুলিকেও রোগী তাহার অবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়া ধরিয়া লয়, সেগুলির প্রকৃত অনুভূতি রোগী পনের কিংবা কুড়ি বছর ব্যাপী রোগ ভোগে ভুলিয়া যায়। রোগী বিশ্বাস করিতে পারেনা যে মূল ব্যাধির সহিত এই সকল আনুষঙ্গিক লক্ষণের এই সকল অধিক বা অল্প স্বাস্থ্যবিচ্যুতির কোন যোগ থাকিতে পারে।
#সূত্রঃ ৯৬। ইহা ছাড়া, রোগীদের প্রকৃতিতে এত পার্থক্য থাকে যে, কেহ কেহ বিশেষত তথাকথিত বিষাদগ্রস্ত, অত্যন্ত অসহিষ্ণুত এবং অধিক যন্ত্রণাকাতর রোগীরা নিজেদের লক্ষণাবলী অতিরঞ্জিত করিয়া বলে যাহাতে চিকিৎসক সেইসকল কষ্টের আরোগ্যবিধানে সচেষ্ট হন।
#সূত্রঃ ৯৭। অন্যেরা আবার ইহার বিপরীত চরিত্রের ।তাহারা হয়তো খানিকটা আলস্য, খানিকটা মিথ্যা বিনয় আর কিছুটা মৃদ প্রকৃতি বা মানসিক দুর্বলতার জন্য তাহাদের অনেক লক্ষণ ব্যক্ত করে না, অনির্দিষ্টভাবে বর্ণনা করে কিংবা কতকগুলিকে অনাবশ্যক বলিয়া নির্দেশ করে।
#সূত্রঃ ৯৮। একদিকে রোগী তাহার রোগচিত্র তুলিয়া ধরিবার জন্য যে সকল যন্ত্রণা ও অনুভূতির কথা বর্ণনা করে তাহা মনোযোগের সহিত আমাদের যেমন শোনা উচিত ও তাহার বক্তব্যে বিশ্বাস করা উচিত– কেননা তাহার বন্ধু ও পরিচর্যাকারীরা সাধারণত তাহার পরিবর্তিতরূপে ও ভুলভাবে বর্ণনা করিয়া থাকে— তেমনি অপরদিকে সকল পীড়া, বিশেষত চিররোগের প্রকৃত ও সম্পূর্ণ চিত্র ও তাহার বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজন বিশেষ পর্যবেক্ষণ, কৌশল, মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান, অনুসন্ধান করার সময়ে সাবধানতা ও প্রচুর ধৈর্য।
#সূত্রঃ ৯৯। মোটের উপর অচিররোগ কিংবা যে রোগ অল্পদিন হইয়াছে তাহার সম্বন্ধে অনুসন্ধান চিকিৎসকের কাছে সর্বাপেক্ষা সহজ কারণ, স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ও তাহার বিচ্যুতিসম্বন্ধীয় সকল ব্যাপার অল্পদিনের বলিয়া তখন ও রোগীর ও তাহার বন্ধুদের মনে তাহা টাটকা থাকে এবং তখনও তাহা কৌতূহল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলিয়া বোধ হয়। এই সকল ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের সবকিছু জানা অপরিহার্য হইলেও জিজ্ঞাসা করিতে হয় অনেক কম। স্বতঃপ্রবৃত্তভাবেই সব কথা তাহাকে বলা হয়।
#সূত্রঃ ১০০। মহামারী ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রোগসমূহের লক্ষণ অনুসন্ধানকার্যে পৃথিবীতে সেই নামে কিংবা অন্য নামে আর কখনো সেইরূপ কিছু আসিয়াছে কিনা জানা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। সেই জাতীয় রোগের নতুনত্ব বা বৈশিষ্ট্য রোগপরীক্ষায় কিংবা চিকিৎসায় কোন পার্থক্য আনে না।
#সূত্রঃ ১০১ । এইরূপ হওয়া স্বাভাবিক যে মহামারীর সময়ে প্রথম যে রোগীটি চিকিৎসকের নজরে আসে তাহাতে রোগের সমগ্র রূপ তখনই ধরা পড়ে না । কতকগুলি রোগীকে মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষণ করলে তবেই সমষ্টিগত সমগ্র লক্ষণের সহিত পরিচিত হওয়া যায়। অবশ্য গভীর মনোযোগী চিকিৎসক দুই একটি ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করিয়াও অনেক সময়ে প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে এরূপ জ্ঞান লাভ করিতে পারেন যে তাহার মনে একটা বিশিষ্ট চিত্র মুদ্রিত হইয়া যায় এবং তিনি সদৃশ লক্ষণযুক্ত একটি ঔষধ ও নির্বাচন করতে সমর্থ হন।
#সূত্রঃ ১০২। এই প্রকার রোগে বিভিন্ন রোগীর লক্ষণগুলি লিখিয়া লইতে লইতে রোগচিত্র সম্পূর্ণ হয়। তাহা শুধু সুদীর্ঘ কথাসর্বস্ব নহে, প্রকৃত পরিচয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং তাহাতে থাকে সমষ্টিগত রোগের অসাধারণ লক্ষণসমূহ। একদিকে যেমন তাতে সাধারণ লক্ষণ গুলি (যেমন, ক্ষুধাহীনতা, অনিদ্রা প্রভৃতি ) সম্বন্ধে বিশেষত্বপূর্ণ সঠিক বর্ণনা থাকে অপর দিকে তেমনি কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ ও, যাহা সচরাচর দেখা যায় না এবং অল্প কয়েকটি রোগেই বিশেষভাবে পরিচিত (অন্তত একই সঙ্গে), পরিস্ফুট হইয়া উঠে এবং সেই রোগের চরিত্রগত লক্ষণ রূপে পরিগণিত হয়। কোন সময়ে কোন একটি মহামারী দ্বারা যাহারা আক্রান্ত হন তাহারা নিশ্চয়ই একই সূত্র হইতে সংক্রমিত হওয়ার ফলে একই পীড়ায় ভুগিয়া থাকেন । কিন্তু এইরূপ একটি মহামারীর সমগ্র প্রসার এবং তাহার লক্ষণসমষ্টি (যে পরিচয়লব্ধ জ্ঞান হইতে লক্ষণাবলীর জন্য সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করা সম্ভব, সেই জ্ঞান রোগচিত্রের সমগ্র রূপ পর্যবেক্ষন দ্বারা পাওয়া যায়) একটি রোগীকে দেখিয়া জানা যায় না; তাহা বিভিন্ন ধাতু প্রকৃতিতে কতগুলি রোগীরা সমগ্রভাবে লক্ষ্য করিয়া জানা যায়।
(১৫) উপবিষ স্থায়ী রোগ (সূত্র-১০৩-১০৪)
#সূত্রঃ ১০৩। সাধারণত অস্থায়ী প্রকৃতির মহামারী সম্বন্ধে যে কথা এখানে বলা হইল আদি রোগবীজজনিত রোগ সম্বন্ধে— যেগুলি (বিশেষত সোরা) মূলে একই থাকে বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে -তাহাদের লক্ষণসমূহ আরও বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে হইবে। কারণ তাদের ক্ষেত্রেও একটি রোগীর মধ্যে আংশিক লক্ষণ পাওয়া যায়; দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং আরও অন্যান্য রোগীতে অন্য কতকগুলি লক্ষণ দেখা যায় এবং সেগুলি ও (বিশিষ্টভাবে) সমগ্র রোগের লক্ষণ সমষ্টির অংশ মাত্র। অতএব এইরূপ একটি চিররোগের বিশেষত সোরার লক্ষণবৈচিত্র পাওয়া সম্ভব কেবল ব্যক্তিগতভাবে অনেকগুলি চিররোগীকে পর্যবেক্ষণ করিয়া। এই প্রকার রোগ সমূহ কে সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও তাদের সমষ্ঠিগত চিত্র ব্যতীত হোমিওপ্যাথি মতে সমগ্র ব্যাধিকে নিরাময় করিবার জন্য ঔষধ (যথা সোরাবিষঘ্ন) আবিষ্কার করা সম্ভব নহে । এইরূপ চিররোগাক্রান্ত অনেক রোগীর আবার এই সকল ওষুধই প্রকৃত মহৌষধ।
#সূত্রঃ ১০৪। রোগের বিশিষ্ট পরিচালক লক্ষণাবলী অথবা অন্য কথায় যে প্রকার রোগই হউক না তাহার সঠিকভাবে চিত্রাঙ্কন একবার হইয়া গেলে কার্যের সর্বাপেক্ষা কঠিন অংশ শেষ হয়। চিকিৎসা পরিচালনার জন্য রোগের চিত্রটি, বিশেষত চিররোগ হইলে তাহা চিকিৎসকের সম্মুখে সর্বদা থাকে। তিনি তখন রোগের সকল দিক অনুসন্ধান করিয়া বিশেষ লক্ষণগুলি বাছিয়া লইতে পারেন এবং সমগ্র রোগকে প্রতিরোধ করিবার জন্য বিশুদ্ধভাবে পরীক্ষিত ভেষজভান্ডার হইতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধরূপ একটি সদৃশ কৃত্রিম রোগশক্তিকে নির্বাচিত করিয়া প্রয়োগ করিতে পারেন। চিকিৎসা চলিতে থাকা কালে ঔষধ কতটা কাজ করিল এবং ঔষধ দ্বারা রোগীর অবস্থার কতটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে যখন তিনি নির্ধারণ করিতে চাহেন তখন আবার প্রথম রোগী দেখিবার সময় যে সকল লক্ষণ লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল তাহার মধ্যে হইতে যেগুলির উপশম হইয়াছে সেগুলিকে কাটিয়ে দিতে পারেন। তখন কি বাকি রহিল তাহা দেখা যাইবে এবং কোন নতুন লক্ষণ দেখা গেলে তাহা যোগ করিয়া লইতে হইবে।
(১৬) ভেষজ পরিচয় (সূত্র-১০৫-১১৪)
#সূত্রঃ ১০৫। প্রকৃত চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় দ্বিতীয় বিষয় হইল প্রাকৃতিক ব্যাধির আরোগ্যসাধনের উপায়সমূহ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ ; ঔষধসমূহের রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে অনুসন্ধান। তদ্দ্বারা চিকিৎসাক্ষেত্রে তাহার মধ্য হইতে এমন একটি ঔষধ নির্বাচন করা সম্ভব হইবে যাহার লক্ষণসমষ্টির তালিকা হইতে যে প্রাকৃতিক ব্যাধিকে নিরাময় করিতে হইবে তাহার যতদূরসম্ভব সদৃশ একটি কৃত্রিম ব্যাধি সৃষ্টি করা যায়।
#সূত্রঃ ১০৬। নানা ওষুধের রোগ উৎপাদন করিবার ক্রিয়া সমগ্রভাবে অবশ্যই জানিতে হইবে । অর্থাৎ অধিকাংশ প্রাকৃতিক ব্যাধির জন্য তাহার মধ্য হইতে উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন করিয়া বাহির করিবার পূর্বে যতদূর সম্ভব তাহাদের প্রত্যেকটির কি ব্যাধিলক্ষণ প্রকাশ করিবার, বিশেষত সুস্থদেহে স্বাস্থ্যের কি পরিবর্তন সৃষ্টি করিবার শক্তি আছে, তাহা সমস্তই জানিয়া লইতে হইবে।
#সূত্রঃ ১০৭। ইহা নির্ধারণ করিতে যাইয়া ওষুধসমূহ যদি কেবল রুগ্ন ব্যক্তিদের উপর পৃথকভাবে একটি করিয়া ও প্রয়োগ করা হয় তাহা হইলে ও তাহাদের প্রকৃত ক্রিয়া সম্বন্ধে সঠিকভাবে কিছুই জানা যাইবে না। কারণ, ঔষধ প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্যের যে বিশেষ পরিবর্তন আশা করা যায় তাহা রোগ লক্ষণের সঙ্গে মিশিয়া যায় এবং সেই জন্য সুস্পষ্টভাবে সেইগুলি লক্ষ্য করা সম্ভব হয় না।
#সূত্রঃ ১০৮। অতএব, সুস্থ মানুষের উপর ছাড়া আর কোন উপায় ঔষধ সমূহের বিশেষ ক্রিয়া সঠিকভাবে জানা যাইতে পারে না । এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কতকগুলি ঔষধ পরিমিত মাত্রায় সুস্থ মানব দেহের উপর প্রয়োগ ও পরীক্ষা ছাড়া আর কোন নিশ্চিত স্বাভাবিক পন্থা নাই। তাহা হইলে, উহাদের প্রভাবে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কি পরিবর্তন, কি লক্ষণ ও নিদর্শন প্রত্যেকটি দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হইল অর্থাৎ কি প্রকারের পীড়া উৎপন্ন করিবার ক্ষমতা ও প্রবণতা আছে তাহা জানা যাইবে। যেহেতু ইহা প্রমাণিত হইয়াছে (২৪-২৭) যে, ঔষধ সমূহের রোগ আরোগ্যকারী ক্ষমতা তাহাদের মানবদেহের সুস্থ অবস্থাকে পরিবর্তিত করিবার ক্ষমতা মধ্যেই নিহিত আছে এবং তাহার পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়াই আরোগ্যকারী ঔষধের ক্ষমতার প্রকাশ জানা যায়।
#সূত্রঃ ১০৯। আমিই সর্বপ্রথমে এই পথ উন্মুক্ত করিয়াছি এবং তাহা এইরূপ অধ্যাবসায়ের সহিত অনুসরণ করিয়াছি যাহা মানুষের কল্যাণময় সেই মহান সত্যের উপর সুদৃঢ় প্রত্যয় হইতে উথিতএবং তাহার পরিপুষ্ট। সেই প্রত্যয় হইল, একমাত্র হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ দ্বারাই মানুষের ব্যাধিসমূহের সুনিশ্চিত আরোগ্য সম্ভব।
#সূত্রঃ ১১০ । আমি আর ও দেখিয়াছি যে ভুলবশত অধিকমাত্রায়, আত্মহত্যা বা অপরকে হত্যা করিবার জন্য কিংবা অন্য কোন অবস্থায় ভেষজদ্রব্যসমূহ সুস্থ মানুষের পাকস্থলীতে যাওয়ার ফলে যে সকল লক্ষণ পূর্ববর্তী গ্রন্থকারগণ পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন তাহা, সেই একই ভেষজ দ্রব্য আমার এবং অন্যান্য সুস্থ ব্যক্তিদের উপর পরীক্ষার ফলে যাহা পর্যবেক্ষণ করা গিয়াছে, বেশ মিলিয়া যায়।যাহাতে অন্য কেহ ব্যবহার না করে প্রধানত সেই কারণে ঐ সকল গ্রন্থকার শক্তিশালী ভেষজসমূহের বিষক্রিয়া যেরূপ ঘটিয়াছিল তাহার ইতিবৃত্ত এবং তাহাদের ক্ষতিকর ক্রিয়া প্রামাণ্যভাবে বিকৃত করিয়াছেন।
#সূত্রঃ ১১১। ভেষজের বিশুদ্ধ ক্রিয়া সম্বন্ধে আমার পর্যবেক্ষণের সহিত প্রাচীন অভিজ্ঞতার— যদিও তাহা আরোগ্য বিজ্ঞান উপলক্ষ্যে লিপিবদ্ধ করা হয় নাই— যে মিল এবং এই সকল বিবরণের সহিত অন্যান্য লেখকদের একই প্রকারের যে মিল তাহা আমাদের কাছে সহজেই প্রতিপন্ন করে যে ভেষজ পদার্থসমূহ সুস্থ দেহে যে বিকৃতি সাধন করে প্রকৃতির ধ্রুব ও চিরন্তন নিয়ম অনুসারে এবং সেই নিয়মের বশবর্তিহইয়া নিজ নিজ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে সুনিশ্চিত, নির্ভরযোগ্য ব্যাধিলক্ষণসমূহ উৎপন্ন করতে সমর্থ হয়।
#সূত্রঃ ১১২। পুরাতন ব্যবস্থাপত্র সমূহে ঔষধ সমূহের অত্যন্ত অধিক মাত্রার প্রায়ই ভয়ঙ্কর কুফলগুলির মধ্যে আমরা এমন কতকগুলি অবস্থা দেখিতে পায় যেগুলি প্রথম দিকে আবির্ভূত হয় নাই, কিন্তু বিষাদময় পরিণামের শেষের দিকে আসিয়াছে এবং ইহা প্রথমে আসা অবস্থা ঠিক বিপরীত। এই সকল লক্ষণ হইল প্রাথমিক ক্রিয়া (৬০ সূত্র) বা জীবনীশক্তির উপর ঔষধের এর যথার্থ ক্রিয়ার ঠিক বিপরীত অর্থাৎ দেহস্হিত জীবনেশক্তির প্রতিক্রিয়া (৬২-৬৭) । সুস্থ দেহের উপর পরিমিত মাত্রায় পরীক্ষণ হইলে কিন্তু ইহা দেখা যায় না বললেই হয়, অল্প মাত্রায় একেবারেই দেখা যায় না। হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিধানে জীবন্ত শরীরে ঔষধ দ্বারা সেইটুকু মাত্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যে টুকু তৎকালীন স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থায় উন্নীত করিবার জন্য প্রয়োজন হয়।
#সূত্রঃ ১১৩। ইহার একমাত্র ব্যতিক্রম হইল অবসাদ ঔষধসমুহ । কারণ, তাহারা প্রাথমিক ক্রিয়ার কখনও কখনও চেতনা ও অনুভূতি, কখন ও উত্তেজনা হরণ করিয়া লয়। এমনকি, সুস্থদেহে পরীক্ষণহেতু পরিমিত মাত্রা প্রয়োগেও তাহাদের গৌণ ক্রিয়ার ঘটে অধিকতার অনুভূতিপ্রবণতা (এবং অধিকতর উত্তেজনা) ।
#সূত্রঃ ১১৪। এই সকল অবসাদ দ্রব্য ব্যতীত সুস্থ শরীরে পরিমিত মাত্রায় ঔষধের পরীক্ষণে আমরা কেবল দেখিতে পাই তাহাদের প্রাথমিক ক্রিয়া, অর্থাৎ সেই সকল লক্ষণ যাহার ঔষধ মানুষের স্বাস্থ্যের বিশৃঙ্খলা সূচনা করে এবং দেহে দীর্ঘ বা অল্পকালস্থায়ী এক পীড়াবস্তা প্রবর্তন করে।
(১৭) ঔষধের পর্যায়ক্রমিক ক্রিয়া (সূত্র-১১৫)
#সূত্রঃ ১১৫। কতকগুলি ঔষধের ক্ষেত্রে এই সকল লক্ষণের মধ্যে এমন অনেকগুলি দেখা যায় যেগুলি আংশিকভাবে বা কোনো বিশেষ অবস্থায় যে সকল লক্ষণ পূর্বে বা পরে আবির্ভূত হইয়াছে ঠিক তাহার বিপরীত, কিন্তু সেইজন্য সেগুলিকে প্রকৃত গৌণ ক্রিয়া বা জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া মাত্র বলিয়া গণ্য করা উচিত নহে । সেইগুলি হইল প্রাথমিক ক্রিয়ারই অন্তর্গত বিভিন্ন প্রকোল্পের পর্যায়ক্রমিক অবস্থা । তাহাদিগকে পরিবর্তী ক্রিয়া (alternating action) বলা হয় ।
(১৮) লক্ষণ বিকাশে বিভিন্নতা ও ধাতুবৈশিষ্ট্যতা (সূত্র-১১৬-১১৯)
#সূত্রঃ ১১৬। ঔষধ দ্বারা কতকগুলি লক্ষণ ঘন ঘন অর্থাৎ বহু লোকের মধ্যে প্রকাশিত হয়, অন্য কতকগুলি লক্ষণ অপেক্ষাকৃত বিরলভাবে কিংবা অল্প কয়টি লোকের মধ্যে, আবার কয়েকটি লক্ষণ কেবলমাত্র খুব অল্প কয়টি সুস্থ দেহে দেখা যায়।
#সূত্রঃ ১১৭। তথাকথিত ধাতু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য (idiosyncracies) শেষোক্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। ইহার অর্থ হইল, দেহের কতকগুলি বিশেষ ধাতু যাহা অন্যভাবে সুস্থ হইলে ও কতগুলি দ্রব্য দ্বারা তাহাদের অল্পাধিক পীড়িত হইবার প্রবণতা তাহাতে দেখা যায়।অথচ সেই সকল দ্রব্য ওপর অনেক লোকের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব বিস্তার করে না বা কোন পরিবর্তন আনে না । কিন্তু প্রত্যেককে প্রভাবিত করিবার এই যে অক্ষমতা তাহা কেবল আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান ।যেহেতু মানুষের সুস্থ দেহে এই সকল ও অন্যান্য পীড়ার লক্ষণ উৎপাদন করিতে দুইটি বিষয়ের প্রয়োজন, প্রভাবক পদার্থের সহজাত ক্ষমতা এবং দেহের চৈতন্যদায়িনী জীবনীশক্তির ইহার দ্বারা প্রভাবিত হইবার প্রবণতা সেইহেতু, তথাকথিত ধাতুপ্রকৃতিবিশিষ্ট লোকের স্বাস্থ্যের সুস্পষ্ট শৃংখলার কারণকে শুধুমাত্র তাহাদের গঠন বৈশিষ্ট্যের উপর ন্যস্ত করা যায় না; সেই সকল পীড়া উৎপাদনকারী পদার্থসমূহও— তাহাদের মধ্যে সমস্ত মানবদেহেই একই প্রকার প্রভাব বিস্তার করিবার ক্ষমতা নিহিত আছে, অথচ তাহা এইরূপ যে অতি অল্প কয়েকটি সুস্থ দেহের তাহাদের দ্বারা পীড়িত হইবার প্রবণতা দেখা যায়—সে জন্য দায়ী। এই সকল পদার্থ যে প্রকৃতই প্রত্যেকটি সুস্থ ব্যক্তির উপর ক্রিয়াশীল তাহা ইহা হইতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে,ঔষধ রূপে তাহা যখন ব্যবহৃত হয় তখন তাহারা হোমিওপ্যাথি মতে সকল অসুস্থ ব্যক্তিরই সেই সকল পীড়ালক্ষণ বিষয়ে উপকার সাধন করে যেগুলি তথাকথিত ধাতুপ্রকৃতি গ্রস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতীয়মান লক্ষণসমূহের সদৃশ।
#সূত্রঃ ১১৮। ঔষধ ভেদে লক্ষণের বিভিন্নতা দৃষ্ট হয়-
প্রত্যেকটি ঔষধ মনুষ্যদেহের উপর বিশেষ ক্রিয়া প্রদর্শন করে—অন্যজাতীয় ভেষজপদার্থ দ্বারা ঠিক একই প্রকারে প্রকাশিত হয় না।
#সূত্রঃ ১১৯। দুইটি ভিন্ন ভেষজ একজাতীয় লক্ষণ প্রকাশ করিতে পারেনা-
প্রত্যেক শ্রেণীর উদ্ভিদ যেমন বাহ্যিক আকারে জীবনধারণ পদ্ধতিতে বৃদ্ধির দিক হইতে স্বাদে-গন্ধে অন্য শ্রেণীর প্রত্যেকটি উদ্ভিদ হইতে স্বতন্ত্র, প্রত্যেকটি খনিজ ও লবণ জাতীয় পদার্থ যেমন বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীক প্রকৃতিতে ও রাসায়নিক গুণাবলীতে অন্য জাতীয় খনিজ ও লবণ জাতীয় পদার্থ হইতে নিশ্চিত ভাবেই পৃথক, ঠিক তেমনভাবে তাহারা রোগ সৃষ্টিকারী শক্তি এবং আরোগ্যকারী শক্তিতেও নিশ্চিতভাবেই পরস্পর সম্পূর্ণ পৃথক ও বিপরীত। এই সমস্ত দ্রব্য অদ্ভূত, পৃথক এবং সুনির্দিষ্ট ধারায় মানবস্বাস্থ্য পরিবর্তন করিতে সমর্থ। কাজেই ইহাদের একটিকে অন্যটির সহিত ভুল করিবার বা মিশ্রিত করিবার কোনো সম্ভাবনা থাকেনা।
(১৯) ভেষজ পরীক্ষা (সূত্র-১২০-১২৫)
#সূত্রঃ ১২০। ভেষজের অভ্রান্ত গুনাগুন নির্ণয় করিতে হইলে সুস্থদেহে ইহার পরীক্ষা প্রয়োজন-
অতএব, যে ঔষধের উপর মানুষের জীবন, মৃত্যু, পীড়া ও স্বাস্থ্য নির্ভর করে তাহা সম্পূর্ণভাবে ও সর্বাধিক সাবধানের সহিত চিনিয়া লইতে হইবে এবং এই উদ্দেশ্যে সুস্থ দেহের উপর সযত্ন ও বিশুদ্ধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা তাহাদের ক্ষমতা ও প্রকৃত ক্রিয়া নির্ধারণ করিতে হইবে যাহাতে তাহাদের সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞান লাভ করা যায় এবং পীড়ায় তাহাদের প্রয়োগ সম্বন্ধে কোন ভুল না হয়। কারণ, কেবল তাহাদের সঠিক নির্বাচন দ্বারাই সর্বোত্তম পার্থিব সূখস্বরূপ দেহ ও মনের স্বাস্থ্য দ্রুত ও স্থায়ীভাবে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
#১২১। ঔষধের তীব্রতাভেদে ইহাদের বিভাগ ও প্রূভারের বিভিন্নতা-
স্বাস্থ্য বিপর্যয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করিয়া ঔষধকে প্রধানতঃ তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- উগ্রবীর্য পদার্থ, মৃদুবীর্য পদার্থ এবং অতি লঘুবীর্য পদার্থ। সুস্থ মানবদেহের উপর ঔষধ এর ফলাফল পরীক্ষা করিবার সময় মনে রাখিতে হইবে যে, উগ্রবীর্য পদার্থগুলি অতি অল্প মাত্রায় প্রয়োগ করলেও বলিষ্ঠ গঠন ব্যক্তির স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটাতে পারে। মৃদুবীর্য পদার্থগুলি স্থল মাত্রায় প্রয়োগ করা দরকার, নতুবা হয়তোবা লক্ষণসমূহ প্রকাশ করিতে অসমর্থ হইতে পারে। অতি লঘুবীর্য পদার্থগুলি নীরোগ অথচ দুর্বল, উত্তেজনাপ্রবণ ও অনুভূতিশীল ব্যক্তির উপর প্রয়োগ করিতে হইবে। নতুবা স্থুল মাত্রায় হয়তোবা ইহার নিজস্ব লক্ষণ প্রকাশ করিতে অপারগ হইতে পারে।
#সূত্রঃ ১২২। সুপরিচিত, বিশুদ্ধ, অকৃত্রিম ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে নিশ্চিত ভেষজ পদার্থ সুস্থদেহে প্রয়োগ করা উচিত-
এই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষায়—যাহার উপর সমগ্র চিকিৎসা কলার যথার্থ এবং ভাবী মানুশ্য সমাজের কল্যাণ নির্ভর করে—-সম্পূর্ণ সুপরিচিতএবং যাদের বিশুদ্ধতা, ও কৃত্তিমতা ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে আমরা সম্পূর্ণভাবে সুনিশ্চিত এইরূপ ঔষধ ব্যতিরেকে অন্য কোন ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত নহে।
#সূত্রঃ ১২৩। পরীক্ষার জন্য ঔষধ প্রস্তুত পদ্ধতি-
এই সকল ঔষধের প্রত্যেকটিকে সম্পূর্ণ ও অবিমিশ্র ও অবিকৃত অবস্থায় গ্রহণ করিতে হইবে, দেশীয় গাছ গাছরা হইতে রস টাটকা নিংড়াইয়া লইয়া ও নষ্ট হইয়া যায় সেজন্য তাহার সহিত একটু সুরাসার মিশাইয়া, বিদেশি উদ্ভিজ্জাদি চূর্ণ আকারে বা তাহাদের টাটকা অবস্থায় থাকাকালে সুরাসার সহযোগে নির্যাস টিংচার প্রস্তুত করিয়া এবং পরে নির্দিষ্ট অনুপাতে জল মিশাইয়া এবং লবণ ও আঠাজাতীয় ভেষজকে ব্যবহার করিবার ঠিক পূর্বে জলে গুলিতে হইবে। উদ্ভিদকে যদি কেবল শুষ্ক আবহাওয়ায় সংগ্রহ করা সম্ভব হয় এবং তাহার কার্যকরী শক্তি স্বভাবতই যদি কম হয় তাহা হইলে তাহা ছোট ছোট টুকরা করিয়া কাটিয়া লইয়া ভেষজ অংশ বাহির করিয়া লইবার জন্য তাহার উপর গরম জল ঢালিয়া নির্যাস প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে এবং প্রস্তুত হইবামাত্র গরম থাকিতে থাকিতে খাইতে হইবে, যেহেত নিংড়ানো সকল উদ্ভিজ্জরস এবং সকল জলীয় নির্যাস সুরাসার মিশ্রিত না থাকিলে দ্রুত গুজিয়া উঠে ও পচিয়া যায় এবং তার ফলে তাহাদের সকল ভৈষজ্য গুণ নষ্ট হইয়া যায়।
#সূত্রঃ ১২৪। প্রয়োগকৃত ভেষজ বিশুদ্ধ ও একক হইতে হইবে-
এই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রত্যেকটি ভেষজ পদার্থ সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে এবং বিশুদ্ধ অবস্থায় বাহিরের আর কিছু না মিশাইয়া প্রয়োগ করিতে হইবে।সেই দিন, কিংবা পরবর্তী কিছুদিন বরং ওষুধের গুনাগুন পর্যবেক্ষণের সময়ের মধ্যে ঔষধ জাতীয় আর কিছু গ্রহণ করার চলিবে না।
#সূত্রঃ ১২৫। পরীক্ষাকারী বা প্রুভারের খাদ্য ও পানীয় নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত নিয়মাবলী-
যতদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিবে ততদিন পথ্যকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করিতে হইবে। উহা যথাসম্ভব মসলা বর্জিত, কেবল পুষ্টিকর ও সাদা-সিদা ধরনের হওয়া উচিত । কাঁচা তরিতরকারি, মূল, সবরকম স্যালাড ও শাকাদির ঝোল ( যাহা খুব সাবধানতার সহিত তৈয়ারি হইলেও তাহাতে গোলযোগকারি কিছু ভেষজগুণ বর্তমান থাকে) বর্জন করা উচিত । যে সকল পানীয় সর্বদা ব্যবহার করা হয় তাহা যতদূর সম্ভব কম উত্তেজক হওয়া উচিত।
(২০) ঔষধ পরীক্ষার নিয়ম-পদ্ধতী (সূত্র-১২৬-১৪২)
#সূত্রঃ ১২৬। ভেষজ পরীক্ষক বা প্রুভারকে বিশ্বস্ত বুদ্ধিমান ও অনুভূতি প্রবণ হইতে হইবে-
যাহার উপর ওষুধের পরীক্ষণ হইবে তাহা কে অবশ্যই বিশ্বাস ভাজন ও বিবেকবান হইতে হইবে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে ও দেহের সকল প্রকার অতিরিক্ত পরিশ্রম, সকল প্রকার অমিতাচার ও বিরক্তিকর কামুকতা তাহাকে পরিহার করিয়া চলিতে হইবে । চিত্তচঞ্চলকারী জরুরি কাজের কোন আকর্ষণ তাহার থাকিবে না, সযত্ন আত্মসমীক্ষায় নিজেকে নিবিষ্ট রাখিতে হইবে এবং এইরূপ থাকাকালে কোনমতেই অস্থির হওয়া চলিবে না । তাহার পক্ষে যাহা সুব্যবস্থা সেই অবস্থায় তাহার দেহকে রাখিতে হইবে এবং সঠিকভাবে তাহার অনুভূতি সকল প্রকাশ ও বর্ণনা করিতে পারার মতো তাহার যথেষ্ট পরিমাণে বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন।
#সূত্রঃ ১২৭। স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের উপরই ভেষজ প্রয়োগ করিতে হইবে-
ঔষধ সমুহ পুরুষ ও স্ত্রী উভয় ক্ষেত্রেই পরীক্ষা করিতে হইবে যাহাতে জননেন্দ্রিয় সংক্রান্ত স্বাস্থ্যের পরিবর্তনসমূহ পরিজ্ঞাত হওয়া যায় ।
#সূত্রঃ ১২৮। খুব সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণের ফলে লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, গুনাগুন পরীক্ষার জন্য ভেষজ পদার্থকে অবস্থায় পরীক্ষণ করা হইলে, তাহাদের অন্তনির্হিত পূর্ণশক্তির বিকাশ প্রায় দেখা যায় না । সেই শক্তি পূর্ণভাবে পরিস্ফুট হয় যখন সেগুলিকে যথাযথভাবে চূর্ণ করিয়া ও ঝাকি দিয়ে উচ্চ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। স্হূল অবস্থায় যে শক্তি তাহাদের মধ্যে সুপ্তপ্রায় থাকে এই রূপ সহজ উপায় দ্বারা তাহা অবিশ্বাস্য পরিমাণে বর্ধিত হয় এবং ক্রিয়াশীল হইয়া উঠে। যে সকল দ্রব্য অত্যন্ত মৃদু প্রকৃতির বলিয়া ধারণা আছে সেগুলির ও ভেষজ শক্তি এখন নির্ধারণ করার পক্ষে এইটি সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা বলিয়া আমরা মনে করি। যে প্রণালী আমরা অবলম্বন করি তাহাতে খালি পেটে পরীক্ষণ কারীকে প্রত্যহ পশুদের ত্রিশক্তির চারিটি হইতে ছয়টি ছোট বড়ি জলে ভিজাইয়া অল্পাধিক জলে উত্তমরূপে মিশাইয়া দেওয়া হয় এবং কয়েক দিন ধরিয়া এইরূপ ব্যবস্থা চালানো হয় ।
#সূত্রঃ ১২৯ । এই মাত্রায় ফল যদি কম হইতে দেখা যায় তাহা হইলে প্রত্যহ আরও কয়েকটি বড়ি ব্যবহার করা যাইতে পারে যে পর্যন্ত না তারা আরো পরিস্ফুট ও জোরালো হয় এবং স্বাস্থ্যের পরিবর্তন আর ও সুস্পষ্ট হয়; কারণ সকল লোক একটি ঔষধ দ্বারা সমান ভাবে প্রভাবিত হয় না, বরং এই বিষয়ে অনেক বিভিন্নতা দেখা যায়। সেই জন্য শক্তিশালী বলিয়া পরিচিত ঔষধের মাত্রা দুর্বল বলিয়া প্রতীয়মান ব্যক্তির উপর কখনও কখনও আদৌ প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় না; অথচ অপেক্ষাকৃত মৃদু ধরনের ঔষধ দ্বারা সেই ব্যক্তি অত্যন্ত প্রবল ভাবে আক্রান্ত হয়। অপরপক্ষে আবার বেশ বলিষ্ঠ লোকেরা মৃদু বলিয়া প্রতীয়মান ঔষধ দ্বারা অত্যাধিক প্রভাবিত হইয়া পড়ে এবং কড়া প্রকৃতির ঔষধে সামান্য লক্ষণ মাত্র প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে যখন পূর্ব হইতে কিছু জানা যায় না তখন প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ঔষধের অল্পমাত্রায় লইয়া আরম্ভ করা সঙ্গত এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দিনে দিনে মাত্রা বাড়ানো যাইতে পারে।
#সূত্রঃ ১৩০। শুরুতেই প্রথম মাত্রার পরিমাণ যদি অনেক বেশী হইয়া যায় তাহা হইলে এই সুবিধা হয় যে, পরীক্ষণকারী লক্ষণগুলির ক্রম বুঝিতে পারে এবং কোন সময়ে প্রত্যেকটির আবির্ভাব ঘটিয়াছে তাহা ঠিক ঠিক লিখিয়া রাখিতে পারে।ঔষধ এর স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান লাভের পক্ষে অত্যাবশ্যক কারণ, তাহা হইলে প্রাথমিক ক্রিয়ার ও পর্যায়গত ক্রিয়ার ক্রম একেবারে নিঃসংশয়ভাবে লক্ষ্য করা যায়। অত্যন্ত পরিমিত মাত্রা দ্বারা ও এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলিতে পারে যদি পরীক্ষাকারীর যথেষ্ট পরিমাণে সূক্ষ্ম অনুভবশক্তি থাকে এবং সে যদি তাহার অনুভূতিসমূহের প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী হয়। ঔষধের ক্রিয়ার ভোগকাল কেবলমাত্র কতকগুলি পরীক্ষার ফল তুলনা করিয়া নির্ধারণ করা সম্ভব
#সূত্রঃ ১৩১। কিন্তু যদি কোন কিছু নির্ধারণের জন্য একে ঔষধ ক্রমবর্ধমান মাত্রায় পরপর কয়েকদিন একই লক্ষ্যে দেওয়া হয় তাহা হইলে তদ্দ্বারা সাধারণভাবে ওষুধজনিত পীড়ার বিভিন্ন অবস্থা নিঃসন্দেহে জানিতে পারি, কিন্তু সেগুলি পর পর কিভাবে আসিল তাহা জানিতে পারি না। আর পরবর্তী মাত্রা আরোগ্যকারী রূপে প্রায়ই পূর্ব মাত্রাজনিত একটি না একটি লক্ষণকে দূরীভূত করে কিংবা তাহার পরিবর্তে একটি বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি করে। এই রূপ উৎপন্ন লক্ষণ সংশয়মূলক বলিয়া সেগুলিকে বন্ধনীর মধ্যে লেখা উচিত—যে পর্যন্ত না পরবর্তী আর ও বিশুদ্ধ পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয় যে সেগুলি দেহের প্রতিক্রিয়ার (গৌণক্রিয়া) লক্ষণ বা ওষুধজনিত পরিবর্তী ক্রিয়ালক্ষণ ।
#সূত্রঃ ১৩২। কিন্তু যখন লক্ষণের পর্যায়ক্রমিক সম্বন্ধে এবং ঔষধের ভোগকালবিষয় লক্ষ নারাখিয়া কেবলমাত্র লক্ষণগুলি নির্ধারণ করা উদ্দেশ্য হয় ( বিশেষ করে মৃদু প্রকৃতির ঔষধের), তখন শ্রেয় পন্থা হইল পরপর কয়েকদিন ধরিয়া মাত্রা বৃদ্ধি করিয়া ঔষধ দেওয়া । এইভাবে অপরিচিত অথচ মৃদুতম ঔষধ এর ক্রিয়া ও প্রকাশিত হইয়া পড়িবে বিশেষতঃ যদি তারা অনুভূতিশীল ব্যক্তির উপর পরীক্ষিত হয়।
#সূত্রঃ ১৩৩। ঔষধ জনিত কোন বিশেষ অনুভূতি বা লক্ষণ উপস্থিত হইলে উহার সঠিক পরিচয় পাইবার জন্য বিভিন্ন অবস্থায় অবস্থান করিয়া, আক্রান্ত অঙ্গ সঞ্চালন করিয়া, ঘরের মধ্যে বা মুক্ত বাতাসে হাঁটিয়া, দাঁড়াইয়া, শুইয়া উহা বাড়ে, কমে বা দূরীভূত হয় তাহা পর্যবেক্ষণ করা শুধু উচিত নয় প্রয়োজন ও বটে। যে অবস্থায় লক্ষণটি প্রথম দেখা গিয়েছিল সেই অবস্থা পুনরায় গ্রহণ করিলে লক্ষণ আবার ফিরিয়া আসে কিনা, পানভোজনে, অন্য কোন অবস্থায়, কথা বলায়, কাশিবার হাঁচিবার সময়ে বা দেহের অন্য কোন ক্রিয়ায় লক্ষণটির কোন পরিবর্তন দেখা যায় কিনা তাহা লক্ষ্য করিতে হইবে, আর সেইসঙ্গে ইহা ও জানিতে হইবে যে দিন বা রাত্রির কোন সময়ে তাহা সর্বাপেক্ষা প্রকাশমান হয় । এতদ্বারা প্রত্যেকটি লক্ষণের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যাইবে ।
#সূত্রঃ ১৩৪। বাহ্য প্রভাবসমূহের, বিশেষ করিয়া ভেষজের এরূপ শক্তি আছে, যদ্দারা জীবদেহের স্বাস্থ্যেএকপ্রকার বিশেষ পরিবর্তন উৎপন্ন হইতে পারে এবং তাহা তাহাদেরই নিজস্ব প্রকৃতি অনুসারে । কিন্তু কোন ভেষজের নিজস্ব প্রকৃতিগিত সকল লক্ষণ একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, একই সঙ্গে, কিংবা একই পরীক্ষাকালে আবির্ভূত হয় না। পরন্তু, কতকগুলি লক্ষণ কাহারো ক্ষেত্রে প্রধানত একবারে আবার কারো ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পরীক্ষা কালে আসিয়া উপস্থিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ওপর এমন কতকগুলি লক্ষণ দেখা যায়, যাহার মধ্যে কিছু হয়তো, চতুর্থ, অষ্টম বা ব্যক্তির মধ্যে প্রকাশ পাইয়াছে যাহা আবার পূর্বেই দ্বিতীয়, ষষ্ঠ বা নবম ব্যক্তির মধ্যে দেখা গিয়েছে এবং একইভাবে চলিতে থাকে। উপরন্ত সেইগুলির একই সময়ে আবির্ভাব নাও ঘটতে পারে।
#সূত্রঃ ১৩৫। কেবল বিভিন্ন ধাতুবিশিষ্ট স্ত্রী-পুরুষের উপযুক্ত ক্ষেত্রে বহু পর্যবেক্ষণ দ্বারা কোন ভেষজসৃষ্ট ব্যাধির সমগ্র প্রকাশকে সম্পূর্ণ করিয়া তোলা যায়। রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা অর্থাৎ স্বাস্থ্যকে পরিবর্তন করিবার যথার্থ শক্তি সম্বন্ধে কোন ভেষজ সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষিত হইয়াছে বলিয়া আমরা তখনই নিশ্চিত হইতে পারি যখন পরবর্তী পরীক্ষাকগণ তাহার ক্রিয়া হইতে আর বিশেষ নূতন কিছুই না এবং প্রায় সকল লক্ষণ এ দেখিতে পান যেগুলি পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন।
#সূত্রঃ ১৩৬। যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে, একটি ভেষজকে সুস্থ দেহে পরীক্ষণ করা হইলে কোন একটি ক্ষেত্রে যে সকল পরিবর্তন আনয়ন করিতে সমর্থ যদিও তাহার সকল গুলি উৎপাদন করিতে পারে না এবং দৈহিক ও মানসিক ধাতু প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইহা প্রয়োগ করা হয়লেই কেবল ইহা সম্ভব হয়, তথাপি প্রকৃতির এক শাশ্বত ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম অনুসারে প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষেত্রে সকল লক্ষণ উৎপন্ন করিবার প্রবণতা সেই ভেষজের মধ্যে বিদ্যমান থাকে (সূত্র১১৭) । সেই প্রবনতার জন্য তাহার সকল গুণ—-এমন কি, যেগুলি সুস্থ শরীরে কদাচিৎ প্রকাশ পায়—তাহা সদৃশ লক্ষণ অনুসারে প্রয়োগ করা হইলে প্রত্যেকটি পীড়িত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। তাহা তখন হোমিওপ্যাথি মতে নির্বাচিত বলিয়া ক্ষুদ্রতম মাত্রাতে ও রোগীর রোগীর ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক পীড়ার খুব সদৃশ একটি কৃত্রিম অবস্থার সৃষ্টি করে—যাহা দ্রুত ও স্থায়ীভাবে রোগমুক্ত করিয়া তাহাকে আরোগ্য প্রদান করে।
#সূত্রঃ ১৩৭। পর্যবেক্ষণের সুবিধার জন্য যদি আমরা এমন একজনকে নির্বাচিত করি যে সত্যপ্রিয়, সর্বপ্রকারে সংযমী, সুক্ষ্ম বোধশক্তিসম্পন্ন এবং যিনি তাঁহার অনুভূতি সম্পর্কে একান্ত মনোযোগী তাহা হইলে কতকটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ঔষধের মাত্রা যত বেশি পড়িবে ততই তাহার প্রাথমিক লক্ষণ গুলি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠিবে এবং জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া বা গৌনক্রিয়ার সহিত মিশ্রিত না হইয়া সর্বাপেক্ষা জ্ঞাতব্য কেবলমাত্র সেই সকল লক্ষণই আবির্ভূত হইতে থাকিবে। কিন্তু যখন অপরিমিত বৃহৎ মাত্রা ব্যবহার করা হয়, তখন লক্ষণ গুলির মধ্যে কতকগুলি গৌণ ক্রিয়ার ফল ও যে শুধু থাকিবে তাহাই নহে, প্রাথমিক ক্রিয়া ও এত তাড়াহুড়ো ও ব্যস্ত ভাবে আসিয়া উপস্থিত হইবে যে, কিছুই সঠিকভাবে তখন লক্ষ্য করা সম্ভব হইবে না। ইহার সঙ্গে বিপদের সম্ভাবনা জড়িত আছে তাহা ছাড়িয়ে দিলেও যাহার কিছুমাত্র মানবতাবোধ আছে এবং যে মানুষকে ও ভ্রাতৃজ্ঞানে দেখিয়ে থাকে, সে কখনো তাহা অপেক্ষার বিষয় বলিয়া মনে করিবে না।
#সূত্রঃ ১৩৮। ঔষধের ক্রিয়াকালে পরীক্ষণকারীর সকল অসুস্থ, আকস্মিক ঘটনা ও স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ( অবশ্য যদি উত্তম ও বিশুদ্ধ পরীক্ষণ এর জন্য ১২৪-১২৭) সূত্রে উদ্বৃত শর্তগুলি মানিয়ে চলা হয়) কেবলমাত্র ঔষধ হইতে উদ্ভূত এবং তাহা ওষুধেরই বিশেষত্ব বলিয়া গণ্য করিতে ও লিপিবদ্ধ করিতে হইবে। যদি পরীক্ষণ কারীর একই প্রকার ঘটনা বহুকাল পূর্বে ও হইয়া থাকে তাহা হইলে ও সেগুলিকে ঔষধেরই লক্ষণ লক্ষণ বলিয়া ধরিতে হইবে। ঔষধের পরীক্ষণ কালে সেগুলির পুনরাবির্ভাব ইহাই নির্দেশ করে যে, সেই ব্যক্তির বিশেষ ধাতু প্রকৃতির জন্য ওই প্রকার লক্ষণের প্রবণতা হইয়াছে। এই ক্ষেত্রে তাহা ঔষধেরই ক্রিয়া । যতদিন স্বাস্থ্যের উপর ঔষুধের মেয়াদ চলিতে থাকে লক্ষণসমূহ আপনা হইতেই উদ্ভূত হয় না, ঔষধ দ্বারাই উৎপন্ন হয় ।
#সূত্রঃ ১৩৯। চিকিৎসক নিজের উপর ঔষুধের পরীক্ষণ না করিয়া যদি অন্য কাহারও উপর করেন, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি তাহার নিজের অনুভূতি, অসুস্থতাবোধ, আকস্মিক ঘটনা এবং স্বাস্থ্যের পরিবর্তন সম্বন্ধে যেরূপ অভিজ্ঞতা হয় তাহা স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করিবে । ঔষধ সেবনের কত পরে লক্ষণ এর আবির্ভাব ঘটিল এবং তাহা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে তাহার ভোগকালও উল্লেখ করিতে হইবে। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র চিকিৎসক সেই বিবরণ পরীক্ষা কারীর উপস্থিতিতে দেখিয়ে লইবেন বা পরীক্ষণ যদি কয়েকদিন ধরিয়া চলে তবে তিনি প্রত্যেহ এরূপ করিবেন। প্রত্যেকটি বিষয় টাটকা মনে করার সময়েই তাহার ঠিক প্রকৃতি জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে হইবে এবং এই ভাবে প্রাপ্ত খুঁটিনাটি সঠিক বিবরণ লিখিয়া লইতে হইবে অথবা পরীক্ষাকারী যেভাবে চাহে সেইভাবে অদলবদল করিতে লইতে হইবে।
#সূত্রঃ ১৪০। যদি সেই ব্যক্তি লিখিতে না পারে তাহা হইলে প্রত্যহ কি ঘটিয়েছে ও কিভাবে ঘটিয়াছে তাহা চিকিৎসককে জানাইতে হইবে। এই বিষয়ে যাহা বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া লিখিতে হইবে তাহা প্রধানত পরীক্ষণকারীর স্বতঃপ্রবৃত্ত বিবরণ হওয়া উচিত, তাহাতে অনুমাননির্ভর কিছুই থাকিবে না এবং কোন প্রশ্ন সোজাভাবে করা হইলে তাহার উত্তর যত কম সম্ভব তাহাতে স্থান পাইবে। দ্রষ্টব্য বিষয়ের অনুসন্ধান এবং প্রাকৃতিক রোগের চিত্রাঙ্গনের জন্য যে সকল সাবধানতার উপদেশ (সূত্র ৮৪-৯৯) আমি বিবৃত করিয়াছে তাহার সকল কিছুই সেই প্রকার সাবধানতার সহিতই নির্ধারণ করিতে হইবে ।
#সূত্রঃ ১৪১। সাধারণ ওষুধের বিশুদ্ধ ক্রিয়া দ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর কি পরিবর্তন আসতে পারে এবং তদ্বারা সুস্থ দেহে কি প্রকার কৃত্তিম ব্যাধি ও লক্ষণসমূহ উৎপন্ন হইতে পারে তাহার সর্বোত্তম পরীক্ষণ সম্ভব যদি তাহা স্বাস্থ্যবান, সংস্কারমুক্ত এবং অনুভূতিপ্রবণ চিকিৎসক, এখানে যে সকল যত্ন ও সাবধানতা কথা বলা হইয়াছে উহা মানিয়া, নিজের উপর করেন। নিজের দেহে যাহা-কিছু তিনি প্রত্যক্ষ করেন তাহা তিনি অত্যন্ত সুনিশ্চিত ভাবে উপলব্ধি করিয়া থাকেন।
#সূত্রঃ ১৪২। কিন্তু আরোগ্য- প্রদানকল্পে প্রযুক্ত অবিমিশ্র ঔষধের কতকগুলি লক্ষণকে মূল রোগের লক্ষণ সমূহ হইতে এমন কল্যানৈপুণ্যের বিষয়ীভূত এবং যাহারা পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত পারদর্শী তাহাদের উপর তাহা ছাড়িয়া দিতে হইবে ।