অর্গানন অব মেডিসিন: সূত্র-০১ থেকে ৪৬ পর্যন্ত।

ডি.এইচ.এম.এস (ডিপ্লোমা) কোর্সঃ ১ম বর্ষের সিলেবাসঃ ১ম পর্ব।
(১) চিকিৎসকের উদ্দেশ্য (সূত্র-১-৪)
#সূত্রঃ ১। চিকিৎসকের একমাত্র মহৎ উদ্দেশ্য-
চিকিৎসকের মহৎ ও একমাত্র উদ্দেশ্য হলো রোগীকে স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনা, যাহাকে বলা হয় আরোগ্য বিধান করা।
#সূত্রঃ ২। আদর্শ আরোগ্যের শর্তসমূহ-
আরোগ্যবিধানের উচ্চতম আদর্শ হলো দ্রুত, বিনাকষ্টে ও স্হায়িভাবে স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার, কিংবা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে, সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও নির্দোষ উপায়ে, সহজবোধ্য নীতির সাহায্যে সমগ্রভাবে রোগের দূরীকরণ ও বিনাশ।
#সূত্রঃ ৩। চিকিৎসকের গুণাবলী-
যদি চিকিৎসকের স্পষ্ট বোধ থাকে পীড়ায় অর্থাৎ প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে কি সারতে হবে ( ব্যাধি সম্বন্ধে জ্ঞান), যদি তিনি জানেন ভেষজগুলোতে অর্থাৎ প্রত্যেকটি ভেষজের ভিতরে কি আরোগ্যশক্তি নিহিত আছে ( ভেষজশক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান), যদি তিনি জ্ঞাত থাকেন- রোগীর ভিতরে যা পীড়া বলে নিঃসন্দেহে জানা গেছে তার উপর কেমন করে স্পষ্ট ধারণাযুক্ত নীতি অনুসারে ভেষজের আরোগ্যশক্তিকে প্রয়োগ করতে হয়- যার ফলে আরোগ্যকার্য শুরু হবে এবং ভেষজটির ক্রিয়াপ্রণালী অনুসারে রোগীর উপর প্রয়োগের যোগ্যতা সম্বন্ধে তা সুনির্বাচিত কিনা (ওষুধ নির্বাচন); এবং তা ছাড়া ইহা প্রস্তুত করার ঠিক পদ্ধতি কি পরিমাণে প্রয়োজন (মাত্রা) এবং পুনঃপ্রয়োগ করার উপযুক্ত সময় এবং পরিশেষে প্রত্যেকটি আরোগ্যের ক্ষেত্রে কি বাধা ও তা কি উপায়ে দূরীভূত করা হয় তাতে আরোগ্যবিধান স্থায়ী হতে পারে- চিকিৎসকের এ সব যদি জানা থাকে তা হলে সুবিজ্ঞতা ও বিচারবুদ্ধিসম্মতভাবে কি প্রকারে চিকিৎসা করা যায় তখন তাঁর বোধগম্য হবে এবং তিনি তখন আরোগ্য-নৈপুণ্যে প্রকৃত চিকিৎসক।
#সূত্রঃ ৪। প্রকৃত স্বাস্থ্য সংরক্ষক চিকিৎসক-
যে সকল কারণ স্বাস্থ্যের বিশৃঙ্খলা আনয়ন করে এবং পীড়ার উৎপত্তি ঘটায়, স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিগণের নিকট হইতে সেগুলিকে কেমন করিয়া দূরে রাখা যায়, এ সব তথ্য তাঁহার ( চিকিৎসকের) জানা থাকিলে তিনি স্বাস্থ্যসংরক্ষকও বটে।
(২) রোগের মূল কারণ ও উত্তেজক কারণ (সূত্র-৫)
#সূত্রঃ ৫। রোগারোগ্যের জন্য চিকিৎসকের রোগের কারণ সম্পর্কিত জ্ঞান-
রোগ আরোগ্য করিবার সহায়তার জন্য চিকিৎসকের জানা প্রয়োজন- অচির রোগোৎপত্তির পক্ষে অতি সম্ভাব্য উদ্দীপক কারণ ( exciting cause) এবং চিররোগের সমগ্র ইতিহাসে বিশেষ বিশেষ জ্ঞাতব্য বিষয়গুলি বাহির করিতে হইবে। ঐ সমস্ত প্রধান কারণগুলি চিররোগের উৎপাদিকা শক্তি। এইসব বিষয়ে অনুসন্ধান করিবার জন্য রোগীর শারিরীক গঠন, তাহার মানসিক ও চরিত্রগত বিশেষত্বসমূহ, রোগীর জীবিকা, তাহার বাসস্থান, বেশভূষ্য, সামাজিক ও গার্হস্থ্য তথ্য, দাম্পত্য ক্রিয়া প্রভৃতি সমস্ত বিষয় বিবেচনা করিতে হইবে।
(৩) রোগ লক্ষণ (সূত্র-৬-৮)
#সূত্রঃ ৬। রোগের প্রকৃত পরিচয় ও উহার পর্যবেক্ষণ-
যেইসব মতবাদ অতীন্দ্রিয় সেইসব মতবাদ চাক্ষুষ প্রমাণ করা যায় না বলিয়া কুসংস্কারবিহীন দর্শক তাঁহার সূক্ষদর্শিতা যত প্রখর হোক না কেন, প্রত্যেক রোগে রোগীর মনে ও দেহের কি বাহ্যিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে তাহা ছাড়া আর কিছুই লক্ষ্য করেন না,অর্থাৎ সুস্থাবস্থায় লোকটির কি প্রকার অবস্হা ছিল, এখন রোগ হওয়ার পর কি কি অস্বাভাবিক অবস্হা রোগী অনুভব করিতেছে এবং সেবা শূশ্রুষাকারীরা কি কি উপলব্ধি করিতেছেন ও চিকিৎসক কি কি উপলব্ধি করিতেছেন তাহাই তিনি লক্ষ্য করেন। তাই দেখা যাইতেছে যে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য লক্ষণগুলিই সম্পূর্ণ রোগ প্রকাশ করিয়া থাকে। এই লক্ষণগুলি দ্বারাই রোগের আকৃতি অংকন করা যায়।
#সূত্রঃ ৭। লক্ষণসমষ্টিই উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশিকা-
কোন রোগের ক্ষেত্র হইতে উদ্দীপক বা পরিপোষক কারণ যখন দূরীভূত করিতে হইবে না তখন পীড়ার লক্ষণ ছাড়া আর কিছু আমরা ধারণা করিতে পারি না। রোগনিরাময় করিবার জন্য যে ঔষধ প্রয়োজন তাহাকে নির্দেশ করিবে একমাত্র সেইসব লক্ষণাবলী (কোন রোগবীজ বা মায়াজম আছে কিনা এবং তার আনুষঙ্গিক অবস্হা সম্বন্ধে অবহিত হইয়া- ৫ম সূত্র)। বিশেষ করিয়া এইসব লক্ষণের সমষ্টিই হইল আভ্যন্তরীণ মূল রোগের অর্থাৎ পীড়িত জীবনীশক্তির বাহিরের প্রতিচ্ছবি এবং এইগুলিই হইবে একমাত্র অবলম্বন যাহার দ্বারা সুনির্বাচিত ঔষধ নির্ণীত হইবে। মোটকথা লক্ষণসমষ্টিই হইবে প্রধান, বস্তুত ইহাই একমাত্র জ্ঞাতব্য বিষয় যাহার সাহায্য চিকিৎসক তাঁহার চিকিৎসানৈপুণ্যে রোগীকে নিরাময় করিয়া স্বাস্হ্যে ফিরাইয়া আনিতে পারেন।
#সূত্রঃ ৮। লক্ষণসমষ্টির অবসানই আরোগ্য প্রাপ্তি-
ইহা ধারণাতীত কিংবা পৃথিবীর কোন অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে ব্যাধির সমস্ত লক্ষণ এবং বোধগম্য সমগ্র বিষয় তিরোহিত হইলে স্বাস্থ্য ছাড়া আর কিছু থাকিতে পারে বা থাকা উচিত, অথবা পীড়ার আভ্যন্তরীণ বিকৃতি নির্মূল না হইয়া থাকিতে পারে।
(৪) জীবনীশক্তি (সূত্র-৯-১৬)
সূত্র- ৯। জীবনশক্তির প্রভাবে মানবদেহ সজীব থাকে-
মানুষের সুস্হাবস্হায় অতীন্দ্রিয় জীবনীশক্তি ( অট্যোক্র্যাসি)- যাহাকে ডাইনামিস বলা হয় এবং যাহা এই জড়দেহকে সঞ্জীবিত রাখে- অসীম ক্ষমতায় নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশ করে এবং বোধশক্তি ও কার্যকারিতার দিক দিয়া দেহের সকল অবয়বকে অত্যুত্তমরূপে ও সুসামঞ্জস্যভাবে বজায় রাখে, যাহার ফলে আমাদের অন্তঃস্থিত বিবেকসম্পন্ন মন এই জীবন্ত সুস্হ দেহকে জীবনের উচ্চতর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য স্বাধীনভাবে নিয়োগ করিতে পারে।
#সূত্রঃ ১০। জীবনীশক্তি একটি অভৌতিক সত্ত্বা-
জীবনীশক্তিকে বাদ দিয়া জড়দেহের অনুভব করিবার, কার্য সম্পাদন করিবার, আত্মরক্ষা করিবার কোন সামর্থ্য নাই। সমস্ত অনুভবশক্তি দেহ পায় এবং জীবনধারণ ব্যাপার সম্বন্ধীয় সমস্ত কার্য দেহ নিষ্পন্ন করে, কেবল এই অশরীরী সত্তার (প্রাণধারণনীতি) সাহায্যে, এবং ইহা স্বাস্হ্য ও ব্যাধিতে এই জড়দেহকে সঞ্জীবিত রাখে।
#সূত্রঃ ১১। রোগ বা জীবনীশক্তির আক্রান্ত অবস্হা-
যখন কোন ব্যক্তি পীড়িত হয় তখন কেবলমাত্র অশরীরী স্বয়ংক্রিয় জীবনীশক্তিই কোন প্রাণবিরোধী পীড়াদায়ক উপাদানের সূক্ষ্ম প্রভাবদ্বারা বিশৃঙ্খলাপ্রাপ্ত হয়। এই প্রাণধারণনীতিই এইরূপ অস্বাভাবিকভাবে বিশৃঙ্খলিতা হইলে দেহের ভিতরে অপ্রীতিকর অনুভূতিসমূহ আসিয়া উপস্হিত হয় এবং দেহকে অস্বাভাবিক গতিপথে পরিচালিত করে ইহাকেই আমরা বলি ব্যাধি। যেহেতু এই শক্তিকে দেখা যায় না এবং কেবল দেহের উপর ক্রিয়া প্রকাশ দ্বারা ইহাকে চিনিতে পারা যায়, সেইজন্য ইহার পীড়াদায়ক বিশৃঙ্খলা ব্যাধিরূপে জানিতে পারা যায় কেবলমাত্র সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনুভূতি ও ক্রিয়ার ভিতর দিয়া যেগুলি পর্যবেক্ষক ও চিকিৎসকের ইন্দ্রিয়গোচরে আসে অর্থাৎ তাহা গোচারীভূত হয় রোগের লক্ষণ দ্বারা অন্য কোন প্রকারেই নহে ।
#সূত্রঃ ১২। আক্রান্ত জীবনীশক্তি এক সাথেই বিশৃঙ্খল হয় আবার রোগ-লক্ষণ বিদূরিত হইলে এককালেই স্বাস্থ্য পুনঃস্থাপিত হয়-
কেবলমাত্র অসুস্থ জীবনীশক্তি ব্যাধি উৎপন্ন করতে পারে যাহার ফলে আমার দৃষ্টির বিষয়ীভূত রোগচিত্রে তৎক্ষণাৎ প্রতিফলিত হয় অন্তর্নিহিত সমগ্র পরিবর্তন অর্থাৎ সেই প্রকাশ হইল আভ্যন্তরীণ জীবনীশক্তির সমগ্র ব্যাধিবিশৃঙ্খলা; এক কথায় তাহাই হইল সমগ্র ব্যাধির অভিব্যক্তি। আর, চিকিৎসার ফলে দৃষ্টিগম্য রোগচিত্রের এবং সূস্হ প্রাণক্রিয়া হইতে পৃথক সকল অসুস্হকর পরিবর্তনের অন্তর্ধান নিশ্চয়ই সূচিত করে জীবনীশক্তির অখন্ড সত্তার পুনরুদ্ধার, অতএব সমগ্র দেহের ফিরিয়া পাওয়া স্বাস্হ্য।
#সূত্রঃ ১৩। কোন রোগই দেহ হইতে পৃথক বস্তু নহে-
অতএব ব্যাধি সম্বন্ধে (যাহা সার্জারির অন্তর্ভুক্ত নহে) অ্যালোপ্যাথগণের এই যে ধারণা অর্থাৎ সমগ্র জীবনসত্তা এবং দেহ ও তার সঞ্জীবনী প্রাণশক্তি হইতে ব্যাধি পৃথক এবং তাহা যতই তীব্র প্রকৃতির হউক না কেন দেহাভ্যন্তরে লুক্কায়িত থাকা- তাহা সম্পূর্ণ অসঙ্গত এবং কেবল জড়ধর্মী মনই তাহা কল্পনা করিতে পারে। এই ধারণা হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া প্রচলিত চিকিৎসা- পদ্ধতিকে এই সকল ক্ষতিকর প্রেরণা যোগাইয়া আসিতেছে যাহার ফলে এই চিকিৎসা একটি যথার্থ অনিষ্টসাধক (অনারোগ্যকারী) বৃত্তিতে পরিণত হইয়াছে।
#সূত্রঃ ১৪। দেহাভ্যন্তরে রোগের অবস্থিতি চিকিৎসকের নিকট ধরা পড়িবেই-
মানুষের দেহাভ্যন্তরে আরোগ্যযোগ্য এমন কোনো অসুস্থতা এবং অদৃশ্য বিশৃঙ্খলা থাকিতে পারে না যাহা যথার্থ পর্যবেক্ষণশীল চিকিৎসকের নিকটে পীড়াসূচক লক্ষণাদির দ্বারা ধরা না পড়ে। এইযে ব্যবস্থা তাহা সর্বজ্ঞানাধার লোকপালক পরমেশ্বরের অসীম করুণারই সম্পূর্ণ অভিপ্রেত ।
#সূত্রঃ ১৫ । জীবনীশক্তির অসুস্থতা এবং প্রকাশিত লক্ষণসমষ্টি অভিন্ন-
যে অতীন্দ্রিয় জীবনীশক্তি অদৃশ্য দেহাভ্যন্তরে অবস্থিত থাকিয়া আমাদের দেহকে সঞ্জীবিত রাখে তাহার বিশৃঙ্খলা অবস্থাহেতু পীড়া এবং তাহার দ্বারা সৃষ্ট বাহিরে বোধগম্য লক্ষণসমষ্টি যাহাকে বর্তমান অসুস্থতার প্রতিরূপ বলা যায় তাহাদের উভয়ের সত্তা অখন্ড এবং তাহারা সেই একই বস্তু। বস্তুত প্রাণ প্রিয়া প্রকাশের যন্ত্র হইল এই জড় দেহ, কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতিশীল ও নিয়ামত জীবনীশক্তি ধারায় ইহাতে সজীবতার ব্যতিরেকে ইহার কোন সার্থকতা নাই, ঠিক যেমন দেহযন্ত্র ব্যতীত জীবনীশক্তিকে কল্পনা করা যায় না । অতএব একত্র মিলিয়া এক অখণ্ড সত্তা, যদিও সহজে বুঝিবার জন্য আমাদের মন কল্পনার সাহায্যে এই একাত্মতাকে দুইটি ধারণায় পৃথক করিয়া দেখে ।
#সূত্রঃ ১৬ । সূক্ষ্ম রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত সূক্ষ্ম জীবনীশক্তি সূক্ষ্ম ঔষধশক্তি দ্বারাই আরোগ্যপ্রাপ্ত হয়-
আমাদের জীবনীশক্তি সুক্ষ্মধর্মী বলিয়া অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্মশক্তির ক্রিয়া ব্যতিরেকে প্রাণক্রিয়ার শৃঙ্খলাভঙ্গকারি বাহিরের বিরুদ্ধশক্তি কর্তৃক আনীত সুস্থ দেহের উপর কোন অনিষ্টকর প্রভাবের দ্বারা তাহা আক্রান্ত বা প্রভাবান্বিত হইতে পারেনা । ঠিক তেমনি ভাবে আমাদের অতিন্দ্রীয় জীবনে শক্তির উপর ক্রিয়াশীল ভেষজের পরিবর্তনকারী অতিন্দ্রীয় শক্তির ( সূক্ষ্ম ফলোৎপাদক শক্তিসম্পন্ন) প্রভাব ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে ইহার সকল বিকৃতি ( ব্যাধি) দূর করা চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব নয়। দেহের সর্বত্র অবস্থিত অনুভূতিমূলক স্নায়ুমণ্ডলীর সাহায্যে জীবনীশক্তি ভেষজের প্রভাবে সারা দেয়। সুতরাং মনোযোগের সহিত পর্যবেক্ষণশীল ও অনুসন্ধিৎসু চিকিৎসকের নিকটে আরোগ্যবিধানের পক্ষে যতখানি প্রয়োজন ততখানি বিশদভাবে রোগীর স্বাস্থ্যের বোধগম্য পরিবর্তনসমূহ (লক্ষণসমষ্টি) ব্যাধিরূপে ধরা দিলে তাঁহার ব্যবস্হিত ঔষধসমূহের সূক্ষ্ম প্রভাব জীবনীশক্তির উপর প্রতিফলিত হইয়া স্বাস্থ্য ও সাবলীল প্রাণক্রিয়াকে পুনরায় আনয়ন করিতে সমর্থ হয় এবং তাহা কার্যত সম্পন্ন করিয়া থাকে।
(৫) রোগ আরোগ্যের সূত্র (সূত্র-১৭-১৮)
#সূত্রঃ ১৭ । রোগলক্ষণ দূরীভূত হইলে সমগ্র পীড়াটিও দূরীভূত হয়-
যেহেতু বোধগোম্য সমগ্র লক্ষণ সমষ্টি দূরীভূত হওয়ার ফলে আরোগ্যলাভের জীবনীশক্তির আভ্যন্তরীণ বিকৃতি – যাহার কারণে এই ব্যাধি- তাহাও যখন একই সময়ে দূরীভূত হয় তখন এই সিদ্ধান্তে আশা যাইতে পারে যে চিকিৎসকের কর্তব্য হইল শুধু সমস্ত লক্ষণ ঠিকভাবে দূরীভূত করা এবং একই সময়ে অন্তর্নিহিত বিশৃঙ্খলাকে অর্থাৎ যাহাকে বলা হয় জীবনীশক্তির অসুস্থতা, অর্থাৎ ব্যাধিই স্বয়ং তাহাকে রদ ও নির্মূল করা । ব্যাধি নির্মূল হয়, স্বাস্থ্য তখন ফিরিয়া আসে- ইহাই হইল চিকিৎসকের উচ্চতম একমাত্র লক্ষ্য অর্থাৎ বিদ্যার বৃথা আস্ফালন কাকুরিয়া রোগীকে সাহায্যদান দ্বারা নিজের যথার্থ উদ্দেশ্য বিষয়ে অবহিত থাকা ।
#সূত্রঃ ১৮। লক্ষণসমষ্টিই রোগের নিদর্শন এবং ওষুধ নির্বাচনের একমাত্র নির্দেশক-
রোগের আনুষঙ্গিক হ্রাসবৃদ্ধির লক্ষণসহ রোগের সমগ্র লক্ষণসমষ্টি ছাড়া রোগে এমন আর কিছুরই পরিচয় পাওয়া যায় না যাহার দ্বারা চিকিৎসার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই অবধারিত সত্য হইতে এই অবিসংবাদিত সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ঔষধ নির্বাচনে আমাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক হিসাবে প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে অবস্থা ও সমগ্র লক্ষণসমষ্টিই হইবে একমাত্র নির্দেশক ।
(৬) ঔষধ ও আরোগ্য (সূত্র-১৯-২৩)
#সূত্রঃ ১৯। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তি-
যেহেতু ব্যাধি বলিতে সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অস্বাভাবিক বিকৃতির লক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয় এবং যেহেতু রোগীর স্বাস্থ্য সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়া আসার মধ্যেই নিহিত থাকে আরোগ্যলাভের একমাত্র সম্ভাবনা, তখন স্পষ্টই বুঝা যায় যে অনুভব ও ক্রিয়ার দিক দিয়া স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন যদি ঔষুধে না ঘটাইতে পারিত তাহা হইলে ঔষধ কখনই আরোগ্যের সন্ধান করিতে পারিত না । বস্তুত ঔষধের আরোগ্যপ্রধান ক্ষমতার মূলে হইল একমাত্র তাঁহার সেই অন্তর্নিহিত শক্তি , যাহার দ্বারা তাহা মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটাইতে পারে ।
#সূত্রঃ ২০। ঔষধের স্বাস্থ্য পরিবর্তনকারী শক্তির উপলব্ধি-
ভেষজের অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে নিহিত যে সূক্ষ্মশক্তিদ্বারা মানুষের স্বাস্থ্যে বিকৃতি ঘটে তাহা কখনও আমরা যুক্তির বলে ধারণা করিতে পারি না।সুস্থ দেহের উপর তাহার পরিদৃশ্যমান ক্রিয়াশীলতা হইতেই তাহার স্পষ্ট পরিচয় আমরা অভিজ্ঞতাসূত্রে লাভ করিয়া থাকি।
#সূত্রঃ ২১। ঔষধের আরোগ্যসাধিকা শক্তির পরিচয়-
ইহা যেমন অনস্বীকার্য যে ভেষজের ভিতরে যে আরোগ্যদায়িনী শক্তি আছে তাহা অনুমানের বিষয় নহে এবং প্রকৃত পর্যবেক্ষকগণ ভেষজের বিশুদ্ধ পরীক্ষানিরীক্ষার ভিতর দিয়া মানুষের স্বাস্থ্যের, বিশেষত সুস্থ ব্যক্তির স্বাস্থ্যের বিকৃতিসাধন এবং নানাবিধ স্পষ্ট পীড়ালক্ষণ উৎপাদন ছাড়া তাহার ভেষজত বা আরোগ্যকারী ক্ষমতা বলিতে আর কিছু নির্ণয় করিতে পারেন না, তখন এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ভেষজ যখন রোগনিরাময়কারীরূপে কার্য করে তখন যে ক্ষমতাদ্বারা অসাধারণ লক্ষণসমূহ উৎপাদন করিয়া মানুষের স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে সেই ক্ষমতার ভিতর দিয়াই তাহার আরোগ্যকারী গুন প্রকাশিত হয় এবং সেই জন্য সুস্থদেহে ভেষজ যে বিকৃতি সাধন করে তাহার উপরেই তাহার অন্তর্নিহিত রোগ আরোগ্যকারী ক্ষমতার সম্ভব্য প্রকাশ নির্ভরশীল বলিয়া আমাদিগকে বিশ্বাস করিয়া লইতে হইবে । তাহা হইলেই প্রত্যেকটি ভেষজের ভিতরে রোগ উৎপাদনকারী শক্তি এবং সেই সঙ্গে রোগ আরোগ্যকারী শক্তি বলিতে কি বুঝায় তাহা জানা সম্ভব হইবে ।
#সূত্রঃ ২২। রোগ নির্মূলের জন্য প্রয়োগকারী ঔষধসমূহের প্রকারভেদ-
স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনার জন্য রোগের লক্ষণসমষ্টি পর্যবেক্ষণ করিয়া তাহা বিদূরিত করা ছাড়া আর যখন কিছুই করিবার নাই এবং ঠিক সেইভাবে সুস্থদেহে পীড়া উৎপাদন এবং রুগ্ন ব্যক্তিকে ব্যাধিমুক্ত করা ছাড়া ভেষজের আরোগ্যকারী ক্ষমতা বলিতে আর কিছু জানা যায় না, তখন এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে ভেষজসমূহই কেবল রোগ আরোগ্য করিতে এবং ব্যাধিসমূহকে ধবংস করিতে সমর্থ, কেননা ভেষজপদার্থ কতকগুলো ক্রিয়া ও লক্ষণ উৎপাদন দ্বারা অর্থাৎ একটা কৃত্রিম ব্যাধির অবস্থা সৃষ্টি করিয়া পূর্ব হইতে অবস্থিত প্রকৃত ব্যাধিরলক্ষণসমূহকে অর্থাৎ যাহা আমরা আরোগ্য করিতে চাই সেগুলিকে বিদূরিত ও বিলুপ্ত করে।অপরপক্ষে ইহা বুঝিতে পারা যায় যে লক্ষণসমষ্টি বিশিষ্ট পীড়া আরোগ্য করিবার জন্য সেই ঔষধকেই (দ্রুত,নিশ্চিত অস্থায়ীভাবে রোগ আরোগ্যের জন্য সাদৃশ বা বিপরীত কোন প্রকার লক্ষণের সহায়তা প্রয়োজন সেই অভিজ্ঞতা অনুসারে)নির্বাচন করিতে হইবে যাহার সদৃশ্য অথবা বিপরীত লক্ষণ সৃষ্টি করিবার প্রবণতা আছে।
#সূত্রঃ ২৩। বিসদৃশ ওষুধের রোগারোগ্যের ক্ষমতা নাই-
সকল প্রকার বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা ও নির্ভুল অনুসন্ধান হইতে আমাদের এই প্রতীতী জন্মে যে ব্যাধির বদ্ধমূল লক্ষণসমূহ ঔষধের বিপরীত লক্ষণ দ্বারা দূরীভূত বা বিনষ্ট হওয়া সম্ভবপর নহে (যেমন অ্যান্টিপ্যাথিক, এনঅ্যান্টিওপ্যাথিক বা প্যালিয়েটিভ উপায়ে )। পক্ষান্তরে সামরিক উপায়ে প্রতীয়মান হইলেও পুনরায় সেগুলি দারুণভাবে বৃদ্ধি পাইয়া গুরুতর আকার প্রকাশিত হয় ( ৫৮-৬২ ও ৬৯ সূত্র দ্রষ্টব্য )।
(৭) হোমিওপ্যাথিক বিধান (সূত্র-২৪-২৯)
#সূত্রঃ ২৪। রোগলক্ষণের সদৃশ লক্ষণসম্পন্ন ঔষধই রোগ আরোগ্য করিতে পারে-
অতএব ব্যাধিতে সদৃশ পদ্ধতি ছাড়া ঔষধ প্রয়োগের আর এমন কোনো উপায় নাই যাহা প্রকৃত কার্যকারী বলিয়া বিবেচিত হতে পারে। ইহার (সদৃশ-পদ্ধতির)দ্বারা রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণসমষ্টির জন্য আমরা সমস্ত ঔষধের মধ্যে (সুস্থ শরীরে পরীক্ষার ফলে যাহাদের নিদান লক্ষণ জানা আছে) এমন একটি ঔষধ অনুসন্ধান করি যাহার বহুলাংশে ঐরূপ রোগীর প্রায় অনুরূপ রোগাবস্থা সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা ও প্রবণতা আছে।
#সূত্রঃ ২৫। সদৃশ ঔষধের সঠিক শক্তি ও মাত্রা প্রয়োগ করিতে হইবে-
সুতরাং সকল সতর্ক পরীক্ষার ভিতর দিয়া বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহাকে আরোগ্য-কলার একমাত্র অভ্রান্ত দৈবনির্দেশ বলা যায়- আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে প্রকৃতপক্ষে সেই ঔষধ যাহার সুস্থ শরীরের উপর ক্রিয়া-লক্ষণের,চিকিৎসিত রোগীর প্রকাশিত লক্ষণের সহিত সর্বাধিক সাদৃশ্য প্রকাশ করিবার ক্ষমতা আছে, তাহা উপযুক্ত শক্তি ও মাত্রায় দ্রুত ও স্থায়ীভাবে পীড়ার লক্ষণসমূহ কে অর্থাৎ (৬-১৬) সমগ্র পীড়াকে নির্মূল করিয়া স্বাস্থ্য পুনরানয়ন করিতে পারে। সকল ঔষধ, বিনা ব্যতিরেকে,সেই সকল পীড়ার ক্ষেত্রে আরোগ্যদান করিতে পারে যাহাদের লক্ষণাবলী ভেষজের নিজস্ব লক্ষণাবলীর প্রায় সদৃশ; তাহাদের কোনটিকেই অ-রোগমুক্ত রাখে না।
#সূত্রঃ ২৬। মানবদেহে দুইটি সদৃশ প্রাকৃতিক রোগ থাকিলে-
ইহা (অর্থাৎ সদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট ওষুধে রোগ নিরাময় হওয়া) নিম্নলিখিত হোমিওপ্যাথিক বিধি বা নিয়মের ওপর নির্ভর করে। ইহা কখনও কখনও অস্পষ্ট অনুমানের বিষয় হইলেও এ পর্যন্ত পুরাপুরিভাবে স্বীকৃতি লাভ করে নাই। প্রতিটি প্রকৃত আরোগ্য যাহা এযাবৎ ঘটিয়াছে তাহা এই নিয়ম অনুসারে। জীবন্ত দেহে সংক্রমিত একটি দুর্বল ব্যাধি অধিকতর বলশালী অপর একটি ব্যাধির সংক্রমণ দ্বারা স্থায়ীভাবে বিনষ্ট হয় যদি শেষোক্তটি (জাতিতে বিভিন্ন হইলেও) তাহার প্রকাশ লক্ষণে প্রথমোক্তটির খুব সদৃশ হয়।
#সূত্রঃ ২৭। কোন ঔষধ সমূলে রোগ বিনাশ করে-
অতএব ঔষধসমূহের আরোগ্যকারী ক্ষমতা নির্ভর করে তাহাদের সেই সকল লক্ষণসমূহের উপর যাহা রোগলক্ষণের সদৃশ অথচ তাহার অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী (১২-২৬)। তাহার ফলে প্রত্যেকটি রোগের পীড়া সুনিশ্চিত ও নির্ভুলভাবে দ্রুত ও স্থায়ী রূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও দূরীভূত হয় এমন একটি ঔষধ দ্বারা যাহা (মনুষ্যদেহে ) সর্বাধিক সদৃশ ও পূর্ণাঙ্গ অথচ অপেক্ষা অধিকতর ক্ষমতাসম্পন্ন লক্ষণসমষ্টি সৃষ্টি করতে সমর্থ।
#সূত্রঃ ২৮। আরোগ্য সাধনের সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য-
যেহেতু প্রাকৃতিক এই আরোগ্যবিধান জগতের প্রত্যেকটি বিশুদ্ধ পরীক্ষানিরীক্ষা এবং প্রত্যেকটি যথার্থ পর্যবেক্ষণের ভিতর দিয়ে ব্যক্ত, অতএব এই সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত। কেমন করিয়া তাহা ঘটে এবং তাহার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি হইতে পারে তাহাতে কিছু আসে যায় না এবং আমি সেই ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টার দিকে বেশি জোর দেই না। কিন্তু নিম্নলিখিত যুক্তি যেহেতু অভিজ্ঞতার ভিত্তির উপর স্থাপিত সেইজন্য গ্রহণযোগ্যরূপে ধরা যাইতে পারে।
#সূত্রঃ ২৯। সদৃশনীতি অনুসারে আরোগ্য সাধনের পদ্ধতি-
প্রত্যেকটি ব্যাধি ( যাহা সম্পূর্ণ সার্জারির অন্তর্ভুক্ত নহে ) যেমন প্রাণশক্তির (জীবনের মৌলিক উপাদানের সূক্ষ্মভাবে এক বিশেষ অসুস্থ পরিবর্তন মাত্র- যাহা অনুভূতি ও ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় – তেমনি প্রত্যেকটি হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য , প্রাকৃতিক ব্যাধি দ্বারা সূক্ষ্মভাবে পীড়িত এই মৌলিক উপাদান , লক্ষণসমষ্টির ঠিক সাদৃশ্য অনুসারে নির্বাচিত শক্তিকৃত ঔষধের প্রভাবে অধিকতর শক্তিশালী তৎসদৃশএকটি কৃত্রিম ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হয়। ইহার ফলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল সূক্ষ্ম প্রাকৃতিক ব্যাধির প্রকাশিত তিরোহিত হয়। রোগের এই প্রকাশ প্রাণক্রিয়াকে আর অধিকার করিয়া থাকে না । তাহার স্থানে তখন অবস্থান করে ও প্রভূত করে কেবলমাত্র প্রবলতর কৃত্রিম ব্যাধিসৃষ্ট লক্ষণসমূহ। সেই কৃত্তিম ব্যাধির লক্ষণসমূহের শক্তি শীঘ্রই নিঃশেষ হইয়া যায় এবং রোগী রোগমুক্ত হইয়া আরোগ্যলাভ করে ।জীবনীশক্তি এইভাবে রোগমুক্ত হইয়া তখন সুস্থভাবে প্রাণক্রিয়া সম্পাদন করে চলে। এই যে অতি সম্ভবপর প্রক্রিয়া তাহা নির্ভর করে নিম্নলিখিত প্রস্তাবসমূহের উপর।
(৮) প্রাকৃতিক রোগ ও ঔষধজ শক্তি (সূত্র-৩০-৩৮)
#সূত্রঃ ৩০। পীড়ার প্রাবল্য ও প্রকৃতি অনুসারে ঔষধের শক্তি নির্ধারণ-
উপযুক্ত ঔষধ দ্বারা প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহ নিরাময় ও পরাভূত হইয়া থাকে, সেজন্য সুস্থ অবস্থায় মানবদেহকে প্রাকৃতিক ব্যাধি অপেক্ষা ভেষজ দ্বারা অধিকতর প্রবলভাবে আক্রান্ত হইতে দেখা যায় (তাহার কতকটা কারণ ঔষধের মাত্রানিয়ন্ত্রণ আমাদের আয়ত্তে থাকে বলিয়া) ।
#সূত্রঃ ৩১। কখন জীবনীশক্তি রোগশক্তি দ্বারা আক্রান্ত হয়-
যে বিরুদ্ধ শক্তিসমূহ- যাহা কতকটা আধ্যাত্মিক ও কতকটা ভৌতিক এবং যাহাদের সম্মুখে উন্মুক্ত রহিয়াছে আমাদের পার্থিব অস্তিত্ব এবং যাহাদিগকে বলা হয় পীড়াসৃষ্টিকারি শক্তিসমূহকে-মানুষের সুস্থ দেহকে সর্তবিহীন ভাবে পীড়িত করিবার ক্ষমতা তাদের নাই। কিন্তু আমরা তাহাদের দ্বারা তখনই পীড়িত হই যখন আগন্তুক ব্যাধি কর্তৃক আক্রান্ত হইবার, স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হইবার এবং অস্বাভাবিক অনুভূতি ও ক্রিয়াসমূহের অধীন হইবার ভাব ও প্রবণতা দেহে বিদ্যমান থাকে। অতএব তাহারা (বিরুদ্ধ শক্তিসমূহ) প্রত্যেক ক্ষেত্রে কিংবা সকল সময় ব্যাধি উৎপাদন করিতে পারে না।
#সূত্রঃ ৩২। ঔষধশক্তি সকল অবস্থায় জীবনীশক্তিকে আবিষ্ট করিতে পারে-
কৃত্রিম পীড়া উৎপাদনকারী শক্তিসমূহ যাহাদিগকে আমরা ভেষজ বলি তাহাদের কথা কিন্তু সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।প্রত্যেকটি প্রকৃত ভেষজ সকল সময়েই , সকল অবস্থায়, প্রত্যেকটি জীবন্ত মানুষ্যদেহে ক্রিয়া প্রকাশ করে এবং তাহার ভিতর অদ্ভুত লক্ষণসমূহ সৃষ্টি করে (সর্তবিহীন ভাবে) আক্রান্ত এবং প্রভাবান্বিত হইতে বাধ্য হয়, যাহা-যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে-প্রাকৃতিক বিধিসমূহ সম্পর্কে খাটে না ।
#সূত্রঃ ৩৩। রোগশক্তি অপেক্ষা ঔষধশক্তি অধিকতর শক্তিশালী-
এই তথ্য অনুসারে ইহা সকল অভিজ্ঞতা দ্বারা অবিসংবাদিত ভাবে স্বীকৃত যে পীড়া উৎপাদিকা শক্তি ও সংক্রামক রোগবিষ অপেক্ষা ভেষজশক্তির দ্বারা জীবন্ত মানুষ্যদেহ আক্রান্ত হওয়া এবং তাহার অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা ও সম্ভাবনা অধিকতর । অর্থাৎ পীড়া উৎপাদিকা শক্তির মানুষের সুস্থ শরীরকে পীড়িত করিবার যে ক্ষমতা তাহা সর্তাধীন, প্রায়ই অত্যন্ত সর্তসাপেক্ষ; কিন্তু ভেষজশক্তির যে ক্ষমতা তাহা সম্পূর্ণ সর্তবিহীন এবং পূর্বোক্তটি অপেক্ষা প্রবলতর ।
#সূত্রঃ ৩৪। আরোগ্যক্রিয়ায় ঔষধ হইতে হইবে অধিকতর শক্তিসম্পন্ন এবং সদৃশ-
ঔষধ দ্বারা উৎপন্ন কৃত্রিম ব্যাধির প্রবলতর শক্তিই যে প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহকে সারাইবার একমাত্র কারণ তাহা নহে। রোগ আরোগ্য করিবার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানষ্যদেহে ভেষজজাত এমন একটি কৃত্রিম ব্যাধির সৃষ্টি করা যাহা যে রোগকে সরাইতে হইবে তাহা যথাসম্ভব তাহার সদৃশ হইবে এবং অধিকতর ক্ষমতাপ্রভাবে স্মৃতি ও চিন্তাশক্তিবিহীন স্বয়ংক্রিয় জীবনীশক্তিকে অনুরূপভাবে পীড়িত করিবে। ইহা প্রাকৃতিক পীড়াকে যে শুধু অভিভূত করিবে তাহা নহে, তাহাকে নির্বাপিত করিয়া ধ্বংস করে দিবে। ইহা যেরূপ সত্য যে প্রকৃতিদেবীও নূতন শক্তিশালী বিসদৃশ রোগ প্রবর্তিত করিয়া দেহাধিকৃত কোন পূর্বের রোগকে দূরীভূত করিতে পারেন না সেইরুপ যে ভেষজ সুস্থদেহে অনুরূপ সদৃশ অবস্থা সৃষ্টি করিতে পারে না চিকিৎসায় তাহার আরোগ্যবিধান করার ক্ষমতা ঠিক ততটুকু ।
#সূত্রঃ ৩৫। বিসদৃশ নীতিতে আরোগ্য হয় না-
প্রাকৃতিক জগতে বিসদৃশ লক্ষণ বিশিষ্ট দুইটি প্রাকৃতিক ব্যাধি একদেহে একত্র মিলিত হইলে কি ঘটে এবং সাধারণ চিকিৎসাক্ষেত্রে অনুপযুক্ত এলোপ্যাথিক ঔষধসমুহ- যাহা রোগের সদৃশ কৃত্রিম পীড়ার অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে না -তাহ প্রয়োগ করলেই বা কি ফল হয় এই সম্বন্ধে বুঝিবার জন্য তিনটি বিভিন্ন অবস্থার কথা আলোচনা করিব।
#সূত্রঃ ৩৬। মানবদেহ একই সময়ে দুইটি বিসদৃশ পীড়া একত্রিত হইলে কি হয়-
মানবদেহের যদি বিসদৃশ লক্ষণসম্পন্ন দুইটি পীড়া মিলিত হয় এবং তাহারা যদি সমশক্তিসম্পন্ন হয় বা পুরাতন পীড়াটি নতুন পীড়া হইতে অধিক শক্তিশালী হয় তাহা হইলে পরে যেই নতুন পীড়াটি মানবদেহে প্রবেশ লাভ করিয়াছে তাহা পূর্বের শক্তিশালী রোগটি দ্বারা বিতাড়িত হয় এবং কিছুতেই শরীরে ক্রিয়া প্রকাশ করিতে সক্ষম হয় না। কোনো রোগী যদি একটি চিররোগে ভুগিতে থাকে, তবে তাহাকে হেমন্তকালীন আমাশয় পীড়া দ্বারা বা অন্য কোনো মহামারী পীড়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায় না ।শ্যামলীর মতে যেখানে স্কা্ভি রোগ খুব বেশী, সেখানে প্লেগ হইতে দেখা যায় না। এমনকি যারা কাউর রোগে ভোগে তাহাদেরও প্লেগ হয় না। জেনার বলেন, যে ছেলে শীর্ণতায় ভুগিতে থাকে, তাহাকে বসন্তের টিকা দিলে ঐ টিকা উঠে না। ভন্ হিলডেন ব্যান্ড এর মতে, যে রোগী যক্ষ্মারোগে ভুগিতেছে তাহাকে প্রবল সংক্রামক জ্বরে সহজে আক্রমণ করতে পারে না।
#সূত্রঃ ৩৭। চিররোগে বিসদৃশ চিকিৎসায় কোন ফল হয় না-
তদ্রুপ কোন পুরাতন চিররোগ সাধারণ চিকিৎসার দ্বারা (প্রচলিত এলোপ্যাথি মতে চিকিৎসায় ) অর্থাৎ সেই সকল ঔষধ দ্বারা চিকিৎসায় সুস্থ দেহে যাহাদের ব্যাধির সদৃশ অবস্থা উৎপন্ন করিবার ক্ষমতা নাই, এমনকি সেই চিকিৎসা বহু বৎসর ধরিয়া করা হইলেও — অবশ্য তাহা যদি খুব প্রচন্ড ধরনের না হয়, তাহা ( চিররোগ ) নিরাময় না হইয়া অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকিয়া যায়। দৈনন্দিন চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়, সুতরাং উদাহরন দিয়া বলিবার কোন প্রয়োজন নাই।
#সূত্রঃ ৩৮। দুইটি বিসদৃশ পীড়ার মধ্যে নবাগত পীড়াটি প্রবলতর হইলে-
নবাগত বিসদৃশ রোগটি যদি বলবত্তর হয় তাহা হইলে নবাগত বলবত্তর পীড়ার সংক্রমণে যতদিন তাহার ভোগকাল শেষ না হয় ততদিন পূর্ব হইতে অবস্থিত দুর্বল পীড়াটি থাকে না এবং পরে সেই পুরাতন পীড়াটি না-সারা অবস্থায় আবার আবির্ভূত হইবে। টূলপিয়াস লক্ষ করিয়াছেন যে একপ্রকার মৃগী রোগে আক্রান্ত দুইটি শিশুর দদ্রুরোগ সংক্রামিত হওয়ার পর রোগটির আক্রমণ বন্ধ ছিল, কিন্তু মাথার চর্মরোগ অন্তর্হিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বের ন্যায় আবার মৃগী রোগ দেখা দিল। স্কোফ দেখিয়েছেন যে স্কার্ভির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে খোসচুলকানি অন্তর্হিত হইয়াছে, কিন্তু পূর্বোক্তটি সারিয়া যাওয়ার পরে পরেরটি আবার দেখা দিয়াছে। এইরূপে প্রবল টাইফাসরোগ আক্রমণের সময় ফুসফুসের যক্ষ্মা থাকে না, পূর্বোক্তটির ভোগ শেষ হওয়ার পরে আবার ফিরেয়া আসে। যক্ষ্মাগ্রস্থ রোগী উন্মাদরোগাক্রান্ত হইলে যক্ষ্মার সমস্ত লক্ষণ তিরোহিত হয়, কিন্তু উন্মত্ততা সারিয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে আবার যক্ষ্মা ফিরিয়া আসে এবং তখন তাহা আরও মারাত্মক হয়।যখন হাম ও বসন্ত উভয়ে একই সময়ে আসিয়া একটি শিশুকে আক্রমণ করে তখন হাম পূর্বে আসিলেও সাধারণত বসন্ত পরে আসা সত্ত্বেও তাহাকে চাপিয়া রাখে এবং বসন্ত সারিয়া না যাওয়া পর্যন্ত হামের ভোগ শুরু হয় না। আবার ম্যাঙ্গেট ইহাও দেখিয়েছেন যে হামের সংক্রমণের ফলে বসন্তের টিকা চারদিন স্থগিত থাকে, এবং হাম সারিয়া যাওয়ার পরে আবার টিকার ভোগ চলিতে থাকে। এমন কি যেখানে টিকা উঠিবার ছয় দিন পরে হাম হইয়াছে, এবং সেই সময়ে প্রদাহান্বিত টিকা একইভাবে থাকে এবং হামের সপ্তাহব্যাপী ভোগকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিকার কাজ আরম্ভ হয় না। হামজ্বর যখন ব্যাপকভাবে দেখা দেয় তখন বসন্তের টিকা লওয়ার চতুর্থ কিংবা পঞ্চম দিনেও অনেক লোক ঐ রোগে আক্রান্ত হইয়াছে এবং হামের ভোগকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিকা উঠা বন্ধ থাকে এবং তাহার পর আবার যথারীতি টিকা উঠিয়া তাহার ভোগ সমাপ্ত হয়। গলাক্ষতযুক্ত প্রকৃত, মসৃণ বিসর্পজাতীয় সিডেনহামস্কার্লেটিনা গোবীজটিকা লোয়ার চতুর্থ দিনে বন্ধ হইয়া যায় এবং টিকার ভোগকাল শেষ হওয়ার পরে আবার স্কার্লেটিনার পুনরার্বিভাব ঘটে। আবার অন্য এক সময়ে উভয় পিড়াই বোধহয় সামান শক্তিশালী বলিয়া গোবীজটিকা অষ্টম দিনে প্রকৃত, মসৃণ সিডেনহামস্কর্লেটিনা কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং যতদিন স্কার্লেটিনা সারিয়া না যায় ততদিন টিকার লাল ক্ষত দেখিতে পাওয়া যায় না, তাহার পর সঙ্গে সঙ্গেই আবার টিকা ওঠা শুরু হইয়া তাহার ভোগ শেষ হয়। কর্টুম লক্ষ্য করিয়াছেন, হাম গোবীজটিকাকে থামাইয়া রাখে, অষ্টম দিনে যখন গোবীজটিকার প্রায় পূর্ণাবস্হা তখন দেখা দেয়। টিকা তখন ঠিকভাবেই চলিতে থাকে এবং হাম শুকাইয়া না যাওয়া পর্যন্ত টিকার কাজ পুনরায় শুরু হয় নাই, সুতরাং দশম দিনে তাহা যে অবস্থায় দেখিতে পাওয়া উচিত ছিল তাহা ষোড়শ দিনের দিন দেখতে পাওয়া যায়। কুর্টুম ইহাও দেখিয়েছেন যে হাম ওঠার পরেও বসন্তের টিকা উঠিয়াছে, কিন্তু হাম সারিয়া না যাওয়া অবধি ইহার ভোগ শেষ হয় না।আমি নিজেও দেখেছি যে বসন্তের টিকা পূর্ণভাবে ওঠা মাত্র মাম্পস অন্তর্হিত হইয়াছে এবং গোবীজটিকা সম্পূর্ণ না উঠা পর্যন্ত ও তজ্জনিত লাল ক্ষত অন্তর্হিত না হওয়া পর্যন্ত একপ্রকার বিশেষ রোগবীজসৃষ্ট জ্বর ও তৎসহ গালগলা ফোলা পুনরাবির্ভূত হইয়া যথারীতি তাহার সপ্তাহব্যাপী ভোগকাল শেষ করে না। সকল বিসদৃশ ব্যাধি সম্বন্ধেই এই কথা খাটে, বলবত্তর পীড়া দূরের অপেক্ষাকৃত দুর্বল পীড়াকে দমন করিয়া রাখে (তাহারা পরস্পর উভয়কে জটিল করিয়া না ফেলিলে,যাহা তরুণ পীড়াসমূহ সম্বন্ধে কদাচিৎ ঘটে), কিন্তু কখনও পরস্পরকে আরোগ্যদান করিতে পারে না।
(৯) এলোপ্যাথিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা (সূত্র-৩৯-৪৬)
#সূত্রঃ ৩৯। এলোপ্যাথিক ঔষধের প্রচন্ড ক্রিয়ার দ্বারা প্রাচীন পীড়া আরোগ্য লাভ করে না-
সাধারণপন্থী চিকিৎসকগণ (অ্যালোপ্যাথিক) এরূপ ঘটনা বহু শতাব্দী ধরিয়া দেখিয়াছেন। তাহারা দেখিয়াছেন যে প্রকৃতিদেবী নিজেও একটি ব্যাধি সৃষ্টি করিয়া- তাহা যতই শক্তিশালী হউক না কেন- দেহস্থিত অন্য একটি বিসদৃশ ব্যাধিক সারাইতে পারেন না। এই সব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও চিররোগকে অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ দ্বারা অর্থাৎ সে সকল ঔষধের ব্যবস্থা দ্বারা-যাহাদের কী প্রকার পীড়া উৎপাদন করিবার ক্ষমতা তাহা ভগবানই জানেন-তাহারা যখন প্রায় সুনিশ্চিতভাবে রোগের বিসদৃশ অবস্থা উৎপাদন করিয়া চিকিৎসা করেন তখন তাহাদের সম্বন্ধে কি মনে করিব ?আর যদি চিকিৎসকগণ এতোকাল মনোযোগের সহিত প্রাকৃতিক বিধানের দিকে লক্ষ না করিয়া থাকেন তাহা হইলেও তাহাদের চিকিৎসার শোচনীয় ফল হইতে এই শিক্ষালাভ করা উচিত ছিল যে তাহারা একটি অনুপযুক্ত মিথ্যা পথ অনুসরণ করিয়া চলিয়াছেন। তাহাদের রীতি অনুসারে তাহারা যখন চিররোগে প্রচন্ড অ্যালোপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করিয়া থাকেন তখন তাহারা কি টের পান না যে তদ্দ্বারা মূল রোগের বিসদৃশ আর একটি কৃত্তিম পীড়া তাহারা সৃষ্টি করিয়াছেন। আর সেই রোগকে যতক্ষণ বজায় রাখা হয় তাহা মূল রোগটিকে সরাইয়া রাখে, স্থগিত রাখে,চাপা দিয়া রাখে এবং যখনই রোগীর দুর্বল শক্তি অ্যালোপ্যাথিকআক্রমণ আর গ্রহণ করিতে পারে না তখনই সেই মূল রোগটির আবার সুনিশ্চিত আবির্ভাব ঘটে। এইরূপেই কডা জোলাপ পুনঃপুন প্রয়োগ করার ফলে নিশ্চিতরূপে অতি সত্বর তাহা অন্তর্হিত হয়,কিন্তু যখন রোগী অন্তের উপর সেই কৃত্তিম পীড়ার বেগ সহ্য করিতে না পারিয়া আর জোলাপ লইতে চাই না তখন হয় চর্মরোগ পূর্বের মতো বাহির হয় কিংবা অন্তর্নিহিত সোরা কোন খারাপ লক্ষণ লইয়া আত্মপ্রকাশ করে; আর তাহার ফলে রোগের মূল ব্যাধি হ্রাসপাওয়া দূরে থাক তাহাকে অধিকন্তু যন্ত্রণাদায়ক অজীর্ণরোগ ও দুর্বলতা আশ্রয় করে। ঠিক এই প্রকারে সাধারণ চিকিৎসকগণ কোন চিররোগ নির্মল করিবার উদ্দেশ্যে যখন শরীরে চর্মের উপর ক্ষত উৎপাদন করেন তখন তদ্দ্বারা তাহাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয় না। সেই উপায় অবলম্বন করিয়া তখনই তাহারা আরোগ্যদান করিতে পারেন না, যেহেতু চর্মের কৃত্রিম ক্ষত অন্তঃস্থিত ব্যাধি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক ও বিসদৃশ। কিন্তু (ক্ষতজনিত) কতকগুলি কোষের উত্তেজনা অভ্যন্তরীণ পীড়ার বিসদৃশ হইলেও অন্তত কখন ও প্রবলতর হয়ে, সেইজন্য অভ্যন্তরীণ পীড়াও কখন তদ্দ্বারা দুই এক সপ্তাহ চুপ থাকে কিংবা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইহা কেবল স্থগিত থাকে মাত্র এবং তাহাও খুব অল্প সময়ের জন্য। ইতিমধ্যে রোগীর শক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে। পেকলিন ও আরও অনেকেই স্বীকার করেন, ক্ষত উৎপাদন দ্বারা বহু বৎসর চাপা থাকলেও ক্ষত সারিবার মুখে মৃগীরোগ আবার ঠিক আবির্ভূত হয় এবং তাহা ও বর্ধিত আকারে।সাধারণ চিকিৎসায় নানা প্রকার নাম-না-জানা ব্যাধির জন্য ব্যবহৃত অজ্ঞাত মিশ্রণ সংবলিত প্রচলিত ব্যবস্থাপত্র অপেক্ষা এই সকল প্রয়োগ যথা, খোসচুলকানির জন্য জোলাপ, মৃগীর জন্য ক্ষত- নিশ্চয়ই অধিকতর বিরুদ্ধধর্মী, অধিকতর বিসদৃশ, অধিকতর ও বলক্ষয়কারী হইতে পারে না। ইহারা রোগীকে কেবল দুর্বল করা ছাড়া আর কিছুই করে না, আর রোগ নিরাময় করিতে না পারিয়া তাহাকে অল্পকালের জন্য দমন বা স্থগিত করিয়া রাখে মাত্র। আর সেগুলিকে দীর্ঘকাল ধরিয়া চালানো হইলে তার অবশ্যম্ভাবী ফল হয় মূল রোগের সহিত আর একটি নূতন পীড়ার সংযোগ।
#সূত্রঃ ৪০। বিসদৃশ পুরাতন পীড়ার সহিত নবাগত পীড়াটি যুক্ত হইয়া জটিল রোগের সৃষ্টি করে-
কিংবা নবাগত ব্যাধিটি অনেকদিন ভোগ হওয়ার পরে অবশেষে বিসদৃশ পুরাতন ব্যাধিটির সহিত যুক্ত হইয়া একটি জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তাহাদের প্রত্যেকে দেহের একটি বিশিষ্ট স্থান অর্থাৎ যেটির যেরূপ উপযুক্ত সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অধিকার করিয়া বসে এবং বাকি অংশে অন্য বিসদৃশ রোগটিকে ছাড়িয়া দেয়। যেমন, একটি সিফিলিসরোগী সোরাগ্রস্থ হইতে পারে, কিংবা সোরাগ্রস্থ রোগী সিফিলিস দ্বারা সংক্রামিত হইতে পারে। কিন্তু ব্যাধি দুইটি পরস্পরের বিসদৃশ বলিয়া একটি অপরটিকে দূরীভূত কিংবা আরোগ্যদান করিতে পারে না । সোরার উদ্ভেদ যখন প্রকাশিত হইতে আরম্ভ হয় তখন সিফিলিসের লক্ষণ সমূহ স্থগিত এবং চাপা থাকে । পরে আবার ( সিফিলিস অন্তত সোরার সমান শক্তিশালী বলিয়া) তাহারা উভয়ে একত্রে মিলিত হয় অর্থাৎ প্রত্যেকটি সেই সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অধিকার করিয়া বলে যেগুলি তাহার উপযুক্ত, তাহার ফলে রোগী আরও পীড়িত হয় এবং তাহাকে রোগমুক্ত করা অধিকতর কষ্টসাধ্য হইয়া পড়ে। যখন দুইটি বিসদৃশ অচিরসংক্রামক ব্যাধি মিলিত হয়, যথা বসন্ত ও হাম, তখন একটি সাধারণত অপরদিকে চাপা দিয়া রাখে– ইহা পূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে । তথাপি এমন প্রচন্ড মহামারী দেখা গিয়াছে যেখানে বিরল হলেও দুইটি বিসদৃশ অঢিররোগের একই সঙ্গে একই দেহে আবির্ভাব ঘটিয়াছে এবং অল্প সময়ের জন্য উভয়ে একত্র মিলিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়।
#সূত্রঃ ৪১। দেহস্থ প্রাকৃতিক রোগ ও বিসদৃশ এলোপ্যাথিক কৃত্রিম রোগ পরস্পর মিলিত হইয়া অধিকতর জটিল পীড়া সৃষ্টি করে–
একই দেহে প্রাকৃতরোগসমূহ একত্র মিলিত হইয়া জটিলতা সৃষ্টি করার যে সম্ভাবনা তাহা অপেক্ষা দীর্ঘকাল ধরিয়া অনুপযুক্ত ঔষধ ব্যবহার দ্বারা অসঙ্গত চিকিৎসাব্যবস্থার ফলে ( এলোপ্যাথিক পদ্ধতি ) জটিল রোগ উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়। যে প্রাকৃতিক ব্যাধিকে আরোগ্য করিবার জন্য ইহা ব্যবহার করা হয়, পুনঃপুনঃ প্রয়োগের ফলে সেই অনুপযুক্ত ওষধের প্রকৃতি অনুযায়ী উৎপন্ন এক নতুন, কষ্টসাধ্য রোগ তাহার সহিত সংযুক্ত হয়। উভয়ে ক্রমশ মিলিত হইয়া চিররোগকে জটিল করিয়া তোলে। ঔষধসৃষ্টপীড়া চিররোগটির বিসদৃশ, সুতরাং সদৃশ মতে আরোগ্যদান করিবার ক্ষমতা তাঁহার না থাকায় পুরাতন ব্যাধিটির সহিত আর একটি বিসদৃশ, কৃত্রিম দীর্ঘস্থায়ী নূতন পীড়া জুড়িয়া দিয়া রোগীর একটির স্থলে দুইটি পীড়া উৎপাদন করে অর্থাৎ তাহার ফলে রোগীর যন্ত্রণা আরও বাড়িয়া যায় এবং রোগ আরোগ্য করা দুঃসাধ্য, প্রায় অসাধ্য হইয়া পড়ে।চিকিৎসাসম্বন্ধীয় পত্রিকাদিতে যে সকল রোগের জন্য উপদেশ চাওয়া হয় এবং চিকিৎসাসম্পর্কিত লেখায় অন্যান্য যেসকল বিবরণী প্রকাশিত হয় সেগুলি ইহার সত্যতা বহন করে। ঠিক এইভাবেই প্রায় দেখা যায় উপদংশরোগের সহিত সোরা কিংবা অর্বুদযুক্ত গনোরিয়ার সংমিশ্রণজনিত জটিল পীড়া দীর্ঘকাল ধরিয়া পুনঃপুনঃ পারদঘটিত ঔষধের অযথা বৃহৎ মাত্রায় ব্যবহারেও আরোগ্য হয় না। বরং তাহা দেহের মধ্যে পারদঘটিত পুরাতন পীড়ার পাশেই নিজের স্থান করিয়া লয়। ইতিমধ্যেই বর্ধিত পারদঘটিত রোগের সংগে ইহা মিলিত হইয়া এক বিকট বীভৎস জটিল রোগ সৃষ্টি করে- যাহাকে সাধারণভাবে বলা হয় যৌনব্যাধি। তাহা তখন নিরাময় করা সম্পূর্ণ অসাধ্য যদি নাও হয় তাহা হইলেও অতি কষ্টেই তাহার আরোগ্য বিধান করা সম্ভব হয়।
#সূত্রঃ ৪২। মানবদেহে একাধিক বিসদৃশ পীড়া উপস্থিত হইলে উহারা দেহে আপন আপন স্থান বাছিয়া লয়-
পূর্বেই বলা হইয়াছে, প্রকৃতি দেবী নিজেও কোন কোন ক্ষেত্রে একই সময়ে দুইটি (তিনটিও) প্রাকৃতিক ব্যাধি একই দেহে স্থান লাভ করিতে দেন। ইহা লক্ষ্য করবার বিষয়, এইরূপ জটিলতা দুইটি বিসদৃশ রোগের পক্ষেই ঘটা সম্ভব, যাহারা প্রাকৃতিক অমোঘ নিয়মে একটি অপরটিকে দূর করিতে পারে না, ধ্বংস করিতে পারে না এবং নিরাময় করতে পারে না। কিন্তু দৃশ্যত উভয়ে ( কিংবা তিনটিতে) দেহের ভিতরে পৃথকভাবে বাস করে এবং সেই সকল অংশ ও যন্ত্রসমূহ অধিকার করিয়া বসে যেগুলি তাহাদের প্রত্যেকটির উপযুক্ত। এই সকল পীড়ার পরস্পরের মধ্যে কোন সাদৃশ্য না থাকায় এইরূপ ঘটা সম্ভব এবং তাহাতে জীবনসত্তার কোন হানি হয় না।
#সূত্রঃ ৪৩। আরোগ্য সাধনে প্রাকৃতিক শিক্ষা-
দুইটি সদৃশ রোগ যখন আসিয়া একত্র মিলিত হয় তখন ফল হয় কিন্তু বিভিন্ন। অর্থাৎ যেখানে পূর্ব হইতে উপস্থিত একটি রোগের সহিত অন্য একটি বলবত্তর সদৃশ রোগ যুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কেমনভাবে আরোগ্য সম্পাদিত হয় তাহা দেখিয়া কিরূপে আরোগ্য বিধান করা যায় আমরা শিক্ষা লাভ করি।
#সূত্রঃ ৪৪। দুইটি সদৃশ পীড়ার ক্ষেত্রে কি ঘটিয়া থাকে-
দুইটি সদৃশ পরস্পরকে বিদূরিত করিতে পারে না (যেমন বিসদৃশ রোগ সম্পর্কে প্রথম ক্ষেত্রে বর্ণিত হইয়াছে) কিংবা তাহাদের একটি অপরটিকে স্থগিত রাখিতে পারে না (যেমন বিসদৃশ রোগ সম্বন্ধে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দেখানো হইয়াছে) যাহাতে নূতন ব্যাধিটিরভোকাল শেষ হওয়ার পরে আবার পুরাতনটি আবির্ভূত হয়। তাহা ছাড়া দুইটি সদৃশ ব্যাধির (যেমন বিসদৃশ ব্যাধি সম্পর্কে তৃতীয় ক্ষেত্রে দেখানো হইয়াছে) একই দেহে পাশাপাশি অবস্থান করা কিংবা উভয়ে মিলিত হইয়া একটি জটিল রোগ উৎপন্ন করার সম্ভাবনাও দেখা যায় না
#সূত্রঃ ৪৫। উৎপত্তি হিসাবে বিভিন্ন কিন্তু প্রকাশ ভঙ্গিমায় ও লক্ষণরাজির মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য থাকিলে তাহারা পরস্পর পরস্পরকে ধ্বংস করে-
না! দুইটি ব্যাধি সমজাতীয় না হইলেও যদি প্রকাশ ও ক্রিয়া উৎপাদনে এবং যন্ত্রণা ও লক্ষণাদির স্ফুরণের তাহাদের উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য থাকে তাহা হইলে যখনই তাহারা দেহাভ্যন্তরে একত্র মিলিত হয় একটি অপরটির ধ্বংসসাধন করিয়া থাকে।
#সূত্রঃ ৪৬। সদৃশ নীতিতে পীড়া অপসারণের কতিপয় উদাহরণ-
সদৃশ লক্ষণযুক্ত অন্যান্য বিধি কর্তৃক হোমিওপ্যাথি মতে রোগ নিরাময়ের অনেক দৃষ্টান্ত প্রাকৃত জগৎ হইতে দেওয়া যাইতে পারে। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য আরো কিছু নিশ্চিত ও সন্দেহাতীত বিষয় সম্বন্ধে বলা ও এমন কয়েকটি ব্যাধি সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিনিবন্ধ করা যেগুলি বরাবর একইভাবে একই নির্দিষ্ট রোগবীজ হইতে উৎপন্ন এবং সেজন্য একটি সুস্পষ্ট নামে পরিচিত।
ইহাদের মধ্যে নানা মারাত্মক লক্ষণযুক্ত ভীতিপ্রদ বসন্তরোগ একটি প্রধান স্থান অধিকার করিয়া আছে এবং তাহা সদৃশ লক্ষণযুক্ত অনেক পীড়াকে বিদূরিত ও আরোগ্যদান করিয়াছে।
বসন্তরোগ কত ক্ষেত্রেই না চক্ষু প্রদাহ সৃষ্টি করিয়াছে, এমনকি অন্ধত্বও! কিন্তু দেখুন, বসন্তের টিকা দিয়া ডিজোটো ও লেরয় প্রত্যেকে একটি করিয়া পুরাতন চক্ষু ওঠা রোগ স্থায়ীভাবে সারাইয়াছিলেন।
ক্লাইন বলেন মাথার চর্মরোগ চাপা পড়ার ফলে উৎপন্ন দুই বৎসরের স্থায়ী অন্ধত্ব ইহার (বসন্ত) দ্বারা সম্পূর্ণ নিরাময় হইয়াছে।
বসন্তরোগের ফলে কত ক্ষেত্রেই না বধিরতা ও শ্বাসকষ্ট দেখা যায়! জে ক্লস দেখিয়াছিলেন, এই রোগের চরম অবস্থায় বহুদিনের পুরাতন ঐ দুইটি রোগ সারিয়ে গিয়াছিল।
অণ্ডকোষফোলা, এমনকি প্রচন্ড ধরনের প্রায়ই বসন্তরোগে দেখা যায়। ক্লাইন লক্ষ্য করেন যে আঘাত জনিত বাম অন্ডকোষের একটি বৃহৎ শক্ত স্ফীতি সাদৃশ্যের জন্য ইহার দ্বারা আরোগ্যপ্রাপ্ত হইয়াছে ।অন্য একজন পর্যবেক্ষক ঐ ধরনের অন্ডকোষস্ফীতি ঐ রোগে সারিয়া যাইতে দেখিয়াছিলেন।