অর্গানন অব মেডিসিন: সূত্র-২৪৫ থেকে ২৯১ পর্যন্ত। সমাপ্ত

ডি.এইচ.এম.এস (ডিপ্লোমা) কোর্সঃ ৩য় বর্ষের সিলেবাসঃ ২য় পর্ব।
(৩১) ঔষধ পুনঃপ্রয়োগ প্রণালী (সূত্র-২৪৫-২৫২)
#সূত্রঃ ২৪৫। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রধান ধরনের বিভিন্ন রোগের এবং তাহাদের সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট অবস্থার ক্ষেত্রে কতখানি মনোযোগ দেওয়া উচিত তাহা লক্ষ্য করিয়া আমরা এখন ঔষধ, তাহার ব্যবহারবিধি এবং তাহা ব্যবহারকালে কিরূপ পথ্যাদির ব্যবস্থা করিতে হইবে তাহা আলোচনা করিতেছি।
#সূত্রঃ ২৪৬। চিকিৎসাকালে প্রত্যেকটি উপশম যতক্ষণ স্পষ্ট, উন্নতিশীল ও ক্রমবর্ধমান থাকিবে ততক্ষণ কোন ঔষধই পুনঃ প্রয়োগ করা চলবে না। কারণ উপযুক্ত ঔষধ এর উপকার প্রদান করা এখন সম্পূর্ণ তার পথে চলিয়াছে। অচির রোগের ক্ষেত্রে এরূপ প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু অধিকতর চিররোগের ক্ষেত্রে, অপরপক্ষে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটি মাত্রা কখনও কখনও মন্হর গতিতে উন্নতি দেখাইয়া আরোগ্য সম্পর্ণ করিতে পারে এবং এইরূপ ক্ষেত্রে এই প্রকার ঔষধের পক্ষে স্বভাবত চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, একশত দিনের মধ্যে যেটুকু সাহায্য দেওয়া সম্ভব তাহা দিতে পারে। এইরূপ কিন্তু বড় একটা ঘটে না। তাহা ছাড়া, এই সময়কে অর্ধেক, সিকি এবং তাহার ও কম করা সম্ভব হইলে রোগীকে আরও দ্রুত আরোগ্য প্রদান করা যায়, ইহা ও চিকিৎসক ও রোগীর পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুনঃ পুনঃ পর্যবেক্ষণ এর ফলে সম্প্রতি যে অভিজ্ঞতা আমি লাভ করি আছি তাহাতে নিম্নলিখিত শর্তে উহা সুষ্ঠুভাবে সম্পূর্ণ করা যাইতে পারে।প্রথমত, সাধ্যানুসারে নির্বাচিত ঔষধ যদি সর্বতোভাবে সদৃশ্য লক্ষণযুক্ত হয়, দ্বিতীয়ত, যদি তাহা উচ্চ শক্তিতে পরিণত করা হয় এবং জলে দ্রবীভূত করিয়া সর্বাপেক্ষা দ্রুত আরোগ্যসাধনের ফলে নির্দিষ্ট সময়ান্তরে, অভিজ্ঞতা দ্বারা যাহা সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত বলিয়া বিবেচিত সেইরূপ স্বল্প মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সেই সাবধানতা অবলম্বন করিতে হইবে যেন প্রত্যেক মাত্রা পূর্ববর্তী টি হইতে কিছু পরিবর্তিত হয়। তাহা হইলে জীবনীশক্তি যাহাকে সদৃশ ভেষজব্যাধির অনুরূপ করিতে হইবে তাহার কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইবে না এবং সে বিদ্রোহ প্রকাশ করিবে না যাহা অপরিবর্তিত, বিশেষত মাত্রার অতি দ্রুত আছে পুনঃ পুনঃ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বদা দেখা যায় ।
#সূত্রঃ ২৪৭। আরোগ্য যাহাতে বিলম্বিত না হয় সেজন্য স্বল্প সময় অন্তর কোন প্রয়োগের কথা দূরে থাক, কাশির ঔষধ অপরিবর্তিত মাত্রায় পুনর্বার দেওয়াও অবাস্তব। জীবনীশক্তি এরূপ অপরিবর্তিত মাত্রাকে বিনা বাধায়, অর্থাৎ যেরূপ সরাইতে হইবে তাহার লক্ষণ ছাড়া ওষুধের অন্যান্য লক্ষণ প্রকাশিত হইতে নাদিয়া কখনই গ্রহণ করে না। কারণ, পূর্ববর্তী মাত্রা পূর্বেই জীবনীশক্তির উপর বাঞ্ছিত পরিবর্তন সাধন করিয়াছে এবং সেই ঔষধ এর সম্পূর্ণ সদৃশ সূক্ষ্ম অপরিবর্তিত দ্বিতীয় মাত্রা জীবনীশক্তির ঠিক একই অবস্থা আর খুজিয়া পায় না । এইরূপ অপরিবর্তিত মাত্রা আর প্রয়োগ করা হইলে রোগী অন্যভাবে কাতর হইয়া পড়ে, এমনকি যাহা ছিল তাহা অপেক্ষা ও বেশি অসুস্থ হইতে পারে, কারণ প্রদত্ত ঔষধ টি সেইসকল লক্ষণই এখন ক্রিয়াশীল থাকে যেগুলি মূল পীড়ার সদৃশ নহে, সেইজন্য আরোগ্যের পথে অগ্রগতি হয় না, রোগের বৃদ্ধির একটা অবস্থা মাত্র হয়। কিন্তু যদি পরবর্তী মাত্রাসমূহ প্রত্যেকবার অল্প অল্প পরিবর্তিত হয়, যেমন উচ্চ শক্তিতে উন্নতি করিয়া (২৬৯-২৭০), তাহা হইলে জীবনীশক্তি অনায়াসে সেই ঔষধ দ্বারাই পরিবর্তিত হতে পারে (প্রাকৃতিক রোগের অনুভূতি মন্দীভূত থাকে) এবং এইরূপে আরোগ্য আরও নিকটবর্তী হয়।
#সূত্রঃ ২৪৮। এই উদ্দেশ্যে আমরা নূতন করিয়া ঔষধ দ্রব্যকে (হয়তো ৮,১০,১২ বার ঝাঁকি দিয়া) শক্তিকৃত করিয়া লই এবং তাহা হইতে রোগীকে এক বা (বর্ধিত করিয়া) কতিপয় চাচামচ মাত্রা, দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় প্রত্যেহ কিংবা একদিন অন্তর, অচিররোগে দুই হইতে ছয় ঘণ্টা অন্তর খুব জরুরী ক্ষেত্রে এক ঘন্টা অন্তর কিংবা আরো শীঘ্র প্রদান করি। এই উপায়ে চিররোগের ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সঠিকভাবে নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, তাহার ক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হইলেও, অধিকতর সাফল্যের সহিত মাসের-পর-মাস প্রত্যহ পুনঃপ্রয়োগ করা যায়। দ্রব্যটি যদি (সাত বা পনের দিনে) শেষ হইয়া যায় এবং ঐ ঔষধের লক্ষণ যদি তখনও বিদ্যমান থাকে তাহা হইলেও সেই ওষুধের লক্ষণ যদি তখন ও বিদ্যমান থাকে তাহা হইলে সেই ওষুধের উচ্চতর শক্তি একটি (কদাচিৎ কয়েকটি) অণুবটিকা দিয়া পরবর্তী দ্রব্য প্রস্তুত করিতে হইবে এবং তাহা রোগীর ক্রমোন্নতির পথে তাহার জীবনে আর কখনও অনুভূত হয় নাই এমন কোনো লক্ষণ আসিয়া যতদিন উপস্থিত না হয় ততদিন চালাইয়া যাইতে হইবে। যদি এইরূপই হয়, যদি রোগের অবশিষ্ট অংশ একগুচ্ছ পরিবর্তিত লক্ষণ রূপে প্রকাশ পায়, তাহা হইলে শেষ ওষুধটির পরিবর্তে আর একটি অন্য সদৃশ ঔষধ নির্বাচন করিয়া একইভাবে পুনঃ পুন মাত্রায় প্রয়োগ করিতে হইবে, তবে মনে রাখিতে হইবে যে সজোরে ঝাঁকি দিয়া প্রত্যেক মাত্রার শক্তি যেন কিছু পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করা হয়। অপরপক্ষে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধের প্রায় প্রাত্যহিক পুনঃ প্রয়োগ কালে চিররোগ চিকিৎসার শেষের দিকে তথাকথিত (১৬১সূত্র) হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি দেখা যাইতে পারে যাহার ফলে রোগের অবশিষ্ট লক্ষণসমূহ কিছু পরিমাণে আবার বৃদ্ধি পাইয়াছে মনে হয় (মূল রোগের সদৃশ ওষুধসৃষ্ট লক্ষণই কেবল তখন অবিরত প্রকাশ পেতে থাকে)। সেই ক্ষেত্রে ঔষধের মাত্রা আরও হ্রাস করিতে হইবে এবং উহা অধিকতর সময়ের ব্যবধানে প্রয়োগ করিতে হইবে। হয়ত বা রোগমুক্তির জন্য আর ঔষধ প্রয়োজন আছে কিনা দেখিবার জন্য কিছুদিন ঔষধ বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধের অতি ব্যবহার হেতু আপাত লক্ষণ গুলি শীঘ্রই অন্তর্হিত হইয়া যাইবে এবং তৎপশ্চাতে উপদ্রবহীন স্বাস্থ্য বিরাজ করিবে। যদি ছোট একটি শিশি যেমন, এক ড্রাম জলমিশ্রিত সুরাসারে একটি অণুবটিকা ঝাঁকি দিয়া মিশাইয়া চিকিৎসার জন্য তাহার দুই, তিন বা চার দিন অন্তর ঘ্রাণ লইবার ব্যবস্থা করা হয়, তাহা হইলে সেইটিকেও প্রত্যেকবার ঘ্রাণ লইবার পূর্বে আট দশবার ঝাঁকি দিয়া লইতে হইবে।
#সূত্রঃ ২৪৯। কোন রোগীকে দেওয়া প্রত্যেকটি ঔষধ তাহার ক্রিয়া প্রকাশকালে যদি এরূপ নতুন এবং কষ্টদায়ক লক্ষণ উৎপাদন করে যাহা ব্যাধির অঙ্গ ছিল না তাহা হইলে বুঝিতে হইবে তাহা প্রকৃত উপকার সাধন করিতে অক্ষম এবং তাহা হোমিওপ্যাথিক নীতি অনুসারে নির্বাচিত হয় নাই। অতএব, বৃদ্ধির লক্ষণ যদি বেশি প্রকাশ পায় তাহা হইলে সদৃশ ক্রিয়া অনুসারে পরবর্তী সঠিক ঔষধ দিবার পূর্বে যত শীঘ্র সম্ভব কোনো প্রতিষেধক ঔষধ দ্বারা তাহার ক্রিয়াকে আংশিকভাবে নষ্ট করিয়া দিতে হইবে বা কষ্টদায়ক লক্ষণগুলি যদি খুব উগ্র না হয় তবে পরবর্তী ঔষধ অবিলম্বে দিতে হইবে যাহাতে বেঠিক ভাবে নির্বাচিত স্থান গ্রহণ করিতে পারে।
#সূত্রঃ ২৫০। যে পর্যবেক্ষণশীল চিকিৎসক রোগের অবস্থা সঠিকভাবে অনুসন্ধান করেন তিনি যখন জরুরী ক্ষেত্রে ছয়, আট বা বার ঘণ্টা বাদে বুঝিতে পারেন যে শেষ ওষুধটির নির্বাচন ঠিক হয় নাই, যাহার ফলে রোগীর অবস্থা খুব কম পরিমাণে হইলেও বোধগম্য ভাবে প্রতি ঘন্টায় নুতন লক্ষণ ও যন্ত্রণার আবির্ভাব খারাপের দিকে চলিয়াছে, তখন তৎকালীন অবস্থার জন্য উপযুক্ত একটি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচন দ্বারা তাহার ভ্রম সংশোধন শুধু অনুমোদনযোগ্য নহে, তাহা তাহার কর্তব্য (সূত্রঃ ১৬৭) ।
#সূত্রঃ ২৫১। এমন কতকগুলি ওষুধ আছে (যেমন, ইগ্নেশিয়া, ব্রায়োনিয়া, রাস টক্স এবং কখনও কখনও বেলেডোনা) যাদের মানুষের স্বাস্থ্য পরিবর্তন করিবার ক্ষমতা প্রধানত পর্যায়শীল ক্রিয়াসমূহের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত, একপ্রকার মুখ্য ক্রিয়া সংবলিত পরস্পর বিপরীত লক্ষণ। ঠিক সদৃশ নীতি অনুসারে ইহাদের একটি প্রয়োগ করিয়া চিকিৎসক যদি কোন উপকার দেখিতে না পান তাহা হইলে তাহার প্রয়োজন সাধন ত্বরান্বিত করিবার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে (অচির রোগের ক্ষেত্রে এমনকি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ও) স্বল্প মাত্রায় সেই ঔষধ পুনঃ প্রয়োগ করিতে পারেন।
#সূত্রঃ ১৫২। কিন্তু চির রোগের (সোরা) ক্ষেত্রে অন্যান্য ঔষধ প্রয়োগ করলে যদি আমরা দেখি যে, সর্বতোভাবে সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের (সোরাঘ্ন) যথোচিত (ক্ষুদ্রতম) মাত্রায় উপকার হইতেছে না, তাহা হইলে ইহাই প্রমাণিত হয় যে রোগের পরিপোষক কারণটি তখন ও বিদ্যমান এবং রোগীর জীবনযাত্রা পদ্ধতি কিংবা যে অবস্থায় সে নিপতিত তাহাতে এমন কোন ঘটনা আছে যাহা স্থায়ী আরোগ্য লাভের জন্য দূর করা অবশ্য কর্তব্য।
(৩২) পীড়ার বৃদ্ধি ও উপশম (সূত্র-২৫৩-২৫৮)
#সূত্রঃ ২৫৩। সমস্ত রোগে, বিশেষত উগ্র প্রকৃতিবিশিষ্ট রোগসমূহে যেসকল লক্ষণ উপশম বা বৃদ্ধির সামান্য সূচনা জানাইয়া দেয় যাহা প্রত্যেকের কাছে বোধগম্য হয় না, তাহাদের মধ্যে মানসিক লক্ষণ ও রোগীর সমগ্র আচরণ সর্বাপেক্ষা সুনিশ্চিত এবং শিক্ষাপ্রদ । সামান্য একটু বসলাম হইলেই রোগীর অধিকতর আরাম, আরও বেশি স্বস্তি এবং মনের স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রফুল্লতা যাহা প্রায় স্বাভাবিক অবস্থার দিকে প্রত্যাবর্তন আমরা লক্ষ্য করি। আবার অল্প একটু বৃদ্ধির সূচনায় ইহার ঠিক অবস্থা ঘটে ঃ মন, সমগ্র আচরণ, ক্রিয়া ও ভাবভঙ্গীতে একপ্রকার স্বাচ্ছন্দ্য, অসহায় শোচনীয় অবস্থা—-যাহা মনোযোগের সহিত লক্ষ্য করলে সহজেই ধরা যায়, কিন্তু কথায় প্রকাশ করা যায় না।
#সূত্রঃ ১৫৪। অন্য নুতন লক্ষণ লক্ষণের বৃদ্ধি, কিংবা তদ্বিপরীত, যথা নূতন লক্ষণের আবির্ভাব না ঘটিয়া মূল লক্ষণগুলির হ্রাস—মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণশীল ও অনুসন্ধানকারী চিকিৎসকের মন হইতে রোগের বৃদ্ধি বা উপশম সম্বন্ধে সকল সন্দেহ দুর করিয়ে দিবে, যদিও রোগীদের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে যাহারা উপশম বা বৃদ্ধির ঠিক বিবরণ দিতে অসমর্থ কিংবা তাহা স্বীকার করিতে অনিচ্ছুক।
#সূত্রঃ ২৫৫। ঔষধ নির্বাচন সঠিক হইয়াছে কিনা চিকিৎসকের জানার উপায়—-
এইরূপ রোগের ক্ষেত্রেও এই বিষয়ে আমরা নিশ্চয়ই বোধ করিতে পারি যদি রোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ সমস্ত লক্ষণ একে একে আলোচনা করিয়া মিলাইয়া লইয়া দেখি যে সেইগুলি ছাড়া অন্য কোন অসঙ্গত নুতন লক্ষণের কথা রোগী বলিতেছে না এবং পুরাতন লক্ষণগুলি ও আর খারাপের দিকে যায় না। এইরূপ হইলে এবং মন ও প্রকৃতিতে উন্নতির সূচনা দেখা গেলে বুঝিতে হইবে রোগের উপশমে ঔষধ নিশ্চয় কার্যকরী হইয়াছে বা এজন্য যদি যথেষ্ট সময়ে অতিবাহিত না হইয়া থাকে, তাহা হইলে শীঘ্র কার্যকরী হইবে। উন্নতি আসিতে তাহার পরেও যদি খুব বিলম্ব হয় তাহা হইলে রোগীর আচার আচরণে হয় কিছু গোলমাল আছে, আর নয় তো বাধা সৃষ্টিকারী অন্য কোন অবস্থা তাহার কারণরূপে বিদ্যমান।
#সূত্রঃ ২৫৬। ঔষধ প্রয়োগের পর রোগী নূতন গুরুতর লক্ষণের কথা প্রকাশ করিলে বুঝিতে হইবে ঔষধ নির্বাচন সঠিক হয় নাই—-
অপর পক্ষে, রোগী যদি এমন কোনো নতুন ঘটনা এবং জরুরী লক্ষণের কথা বলে যাহা নির্দেশ করে যে ওষুধটি ঠিকমতো হোমিওপ্যাথিক মতে নির্বাচিত হয় নাই, তাহা হইলে সে ভদ্রতাবশত ভালো আছে বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিলে ও—যেমন ফুসফুসে স্ফোটকযুক্ত যক্ষ্মারোগী প্রায়ই দিয়া থাকে–আমরা সেই আশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করিব না, বরং সেই অবস্থাকে বর্ধিত অবস্থা বলিয়াই মনে করি এবং তাহা শীঘ্র স্পষ্ট বুঝা যাইবে।
#সূত্রঃ ২৫৭। কোন ঔষধ এর প্রতি অযথা আসক্তি বর্জনীয় —-
যে সকল ঔষধ ব্যবহার করিয়া দৈবক্রমে উপকার পাইয়াছেন প্রিয় ঔষধরূপে সেই গুলির প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন যেন করা না হয় সে সম্বন্ধে প্রকৃত চিকিৎসককে সাবধান হইতে হইবে। যদি সেইরূপ করা হয় তাহা হইলে যে ওষুধগুলি কম ব্যবহার করা হয় অথচ সাদৃশ্য অনুযায়ী অধিকতর উপযুক্ত সুতরাং অধিকতর কার্যকরী সেইগুলি উপেক্ষিত হইবে।
#সূত্রঃ ২৫৮। কোন ওষুধের প্রতি অযথা অবহেলা ও বর্জনীয়—–
উপরন্তু, যিনি প্রকৃত চিকিৎসক তিনি নিজের ভুল নির্বাচন হেতু যে সকল ঔষধ প্রয়োগ করিয়া কুফল পাইয়াছেন সেইগুলির প্রতি অবিশ্বাসপূর্ণ দুর্বলতা দেখাইয়া অবহেলা প্রদর্শন করিবেন না বা অন্য কারণ হেতু যেমন, পূর্বক্ষেত্রে অসদৃশ ছিল বলিয়া সেগুলিকে পরিত্যাগ করবেন না। এই সত্য তাকে অবশ্যই স্মরণ রাখিতে হইবে যে প্রত্যেকটি রোগের ক্ষেত্রে পরিচায়ক লক্ষণসমষ্টির সহিত সঠিক মিল আছে এমন একটি মাত্র ঔষধি ভেষজ ভান্ডার এর মধ্যে প্রকৃষ্টতম এবং এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের পথে কোন ক্ষুদ্র পক্ষপাতিত্ব বাধাস্বরূপ হওয়া উচিত নহে।
(৩৩) পথ্য ও পরিচর্যা (সূত্র-২৫৯-২৬৩)
#সূত্রঃ ২৫৯। চিকিৎসাকালে ভেষজগুণ সম্পন্ন পথ্য বর্জনীয়—-
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় মাত্রার ক্ষুদ্রতা অবশ্যক ও উপযোগী—-ইহা স্বীকার করিয়া লইলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে চিকিৎসাকালে পথ্যাদি হইতে সেই সকল বস্তু বর্জন করিতে হইবে যাহাদের ভেষজ ক্রিয়া থাকিতে পারে, যাহার দ্বারা ক্ষুদ্র মাত্রাটি অভিভূত ও বিনষ্ট কিংবা অসঙ্গত অন্য কোন উত্তেজক বস্তু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত না হইতে পারে।
#সূত্রঃ ২৬০। চির রোগের ক্ষেত্রে ভুল পানাহারে পীড়ার বৃদ্ধি ঘটে—-
সেইজন্য আরোগ্যের পথে এই প্রকার বাধাসমূহের সযত্ন অনুসন্ধান বিশেষত, চিররোগীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ প্রয়োজন। কারণ তাহাদের ব্যাধির প্রায়ই সেই প্রকার অনিষ্টকর প্রভাব এবং ব্যাধি উৎপাদক ভুল পথ্যাদির দ্বারা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় যাহা প্রায়ই দৃষ্টির অগোচরে থাকে।
#সূত্রঃ ২৬১। চির রোগের ক্ষেত্রে আরোগ্যের বিঘ্ন দূর করতঃ বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি করা দরকার—-
চির রোগের ঔষধ প্রয়োগ কালে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পথ্যাদির ব্যবস্থা হইল আরোগ্যের পথে সেই সকল বাধাবিঘ্নাদি দূর করা এবং প্রয়োজনবোধে তদ্বিপরীত ব্যবস্থা করা যথা, নৈতিক ও মানসিক নির্দোষ আমোদপ্রমোদ, প্রায় সকল ঋতুতে মুক্ত বায়ুতে দৈহিক ব্যায়াম (প্রাত্যহিক ভ্রমণ, সামান্য দৈহিক পরিশ্রম) উপযুক্ত, পুষ্টিকর, ভেষজক্রিয়াবিহীন খাদ্য ও পানীয় প্রভৃতি।
#সূত্রঃ ২৬২। তরুণ রোগের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ চেতনা পথ্যাপথ্যের নির্ভুল নির্দেশ প্রদান করে——–
অপরপক্ষে অচিররোগে—মানসিক বিকৃতির ক্ষেত্র ছাড়া—জাগ্রত জীবনরক্ষিণী শক্তির তীক্ষ্ণ, নির্ভুল প্রেরণা এরূপ পরিষ্কার এবং সঠিকভাবে জানাইয়া দেয় যে চিকিৎসকের প্রয়োজন শুধু বন্ধু ও শুশ্রূষাকারীদের উপদেশ দেওয়া যাতে কোন খাদ্য সম্বন্ধে রোগীর একান্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না করিয়া বা কোনো ক্ষতিকর দ্রব্য খাইতে বাধ্য করিয়া তাহারা প্রকৃতির আদেশ পালনে যেন বাধা সৃষ্টি না করে।
#সূত্রঃ ২৬৩। রোগীর আকাংখিত আরামপ্রদ পথ্যাদির ব্যবস্থা করিলে জীবনীশক্তির অনেকটা সুস্থ বোধ করে——
অচিররোগে আক্রান্ত রোগীর খাদ্য ও পানীয় সম্বন্ধে যে আকাঙ্ক্ষা তাহা প্রধানত সেই সকল জিনিসের জন্য হয় যাহা সাময়িক আরাম প্রদান করে। সেইগুলি কিন্তু যথার্থ ভাবে ভেষজ প্রকৃতির নহে, সেইগুলি কেবলমাত্র এক প্রকার অভাব মিটায়। পরিমিত মাত্রায় এই অভাব পূরণ করা হইলে সমূলে রোগ দূরীকরণের পথে যদি সামান্য বাধা উপস্থিত ও হয় তবে তাহাকে সদৃশ ঔষধের শক্তি দ্বারা এবং একান্ত আকাঙ্ক্ষিত বস্তু গ্রহণ জনিত তৃপ্তিলাভের ফলে জীবনীশক্তি যে স্বাচ্ছন্দ্যলাভ করে তাহার দ্বারা উপযুক্তভাবে প্রতিরোধ ও জয় করা যাইতে পারে। ঠিক সেইভাবে অচিররোগে ঘরের উত্তাপ এবং বিছানার উষ্ণতা শীতলতা রোগীর সম্পূর্ণ ইচ্ছানুসারে ব্যবস্থা করিতে হইবে। তাহাকে অত্যধিক মানসিক শ্রম ও উত্তেজনার আবেগ হইতে মুক্ত রাখিতে হইবে।
(৩৪) ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী (সূত্র-২৬৪-২৭১)
#সূত্রঃ ২৬৪। চিকিৎসকের হাতে বিশুদ্ধ ও সতেজ ঔষধ থাকা অত্যাবশ্যক—-
প্রকৃত চিকিৎসকের অক্ষুন্ন শক্তি বিশিষ্ট বিশুদ্ধ ঔষধ থাকা চাই। তাহা হইলে তাহাদের আরোগ্যকারী ক্ষমতার উপর তিনি বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিবেন। তাহাদের বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে বিচার পরিবার সামর্থ্য তাহাদের নিজেরই থাকা আবশ্যক।
#সূত্রঃ ২৬৫। চিকিৎসককে নিজ হাতে ঔষধ প্রস্তুত করিতে হইবে—
প্রত্যেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ থাকিবেন যে রোগী ঠিক ঔষধ গ্রহণ করিয়াছে এবং ইহা হইবে তাহার বিবেকের বিষয়। সেই জন্য সঠিক নির্বাচিত ঔষধ প্রস্তুত করিয়া তিনি প্রয়োগ করবেন।
#সূত্রঃ ২৬৬। ভেষজ পদার্থ সতেজ অবস্থায় সর্বাপেক্ষা উপযোগী—
প্রাণী এবং উদ্ভিদরাজ্যের বস্তুসমূহের ভেষজ ধর্ম তাহাদের কাঁচা অবস্থাতে সর্বাপেক্ষা পূর্ণভাবে বিদ্যমান থাকে।
#সূত্রঃ ২৬৭। স্থানীয় উদ্ভিদ হইতে ঔষধ প্রস্তুত প্রণালী—-
স্থানীয় উদ্ভিদ এবং যে সকল উদ্ভিদ টাটকা পাওয়া যায় তাহাদের নিষ্কাশিত টাটকা রসের সহিত প্রদীপে জ্বালানো যায় এইরূপ সুরাসার তখনই সমপরিমানে মিশ্রিত করিয়া সম্পূর্ণ ও নিশ্চিতরূপে আমরা তাহাদের শক্তির অধিকার লাভ করিতে পারি। ইহা একদিন ও একরাত্রি একটি ছিপিবদ্ধ বোতলে থিতাইতে দিলে এবং তন্তু ও অ্যালবুমিনজাতীয় পদার্থ তলানি পড়িয়া গেলে উপরিস্থিতি পরিষ্কার তরল পদার্থকে তখন ঔষধার্থে ব্যবহারের জন্য উপর ঢালিয়া লওয়া হয়। সুরাসার উদ্ভিদরসের তৎক্ষণাৎ গাজিয়া যাওয়া নিবারন করে এবং ভবিষ্যতেও গাজিয়া যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। উত্তমরূপে ছিপিবন্দ্ধ অবস্থায় এবং যাহাতে বাষ্পীভূত হইয়া উবিয়া না যায় সেই জন্য ঘুম লাগাইয়া সুরক্ষিত করিলে এবং সূর্যের আলো হইতে দূরে রাখিলে সেই উদ্ভিদরসের সমগ্র ভেষজশক্তি (পূর্ণ ও আবিষ্কৃতভাবে) চিরকাল সংরক্ষিত থাকে।
#সূত্রঃ ২৬৮। বিদেশ হইতে আনীত ভেষজ উদ্ভিদ নিঃসন্দেহ হইতে হইবে—–
অন্যান্য বিদেশীয় উদ্ভিদ, বল্কল, বীজ এবং শিকড়সমূহ যাহা টাটকা অবস্থায় পাওয়া যায় না, বিবেচক চিকিৎসক বিশ্বাস করিয়া কখনও সেইগুলিকে চূর্ণ অবস্থায় গ্রহণ করিবেন না। ঔষধরূপে ব্যবহার করিবার পূর্বে তাহাদের অপরিবর্তিত ও সম্পূর্ণ অবয়ব দেখিয়া তাহাদের বিশুদ্ধতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইবেন।
#সূত্রঃ ২৬৯। স্থূল ভেষজ পদার্থের অন্তর্নিহিত ভেষজ শক্তিকে অত্যন্ত উচ্চ শক্তিতে উন্নীত করা যায়—-
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রণালী তাহার বিশেষ প্রয়োগের জন্য ইতোপূর্বে আর কখনো ব্যবহৃত হয় নাই এইরূপ এক নিজস্ব প্রক্রিয়া অনুসরণ দ্বারা স্থূল পদার্থসমূহের অন্তর্নিহিত ভেষজশক্তিকে অশ্রুতপূর্ব মাত্রায় বিকশিত করিতে পারে। এমন কি যে সকল পদার্থের স্থূল অবস্থায় মানবশরীরে ভেষজশক্তির ও পরিচয় পাওয়া যায় না তাহারা ও তদ্দ্বারা অপরিমিত ও গভীরভাবে ফলপ্রদ আরোগ্যদায়িনী শক্তির অধিকার লাভ করে। প্রাকৃতিক বস্তুসমূহের এই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গুণগত পরিবর্তন এক প্রচ্ছন্ন, অননূভূতপূর্ব সুপ্ত অন্তর্নিহিত অতীন্দ্রিয় সূক্ষ্মশক্তিকে যেন জাগ্রত করে যাহা জীবনী-শক্তির উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া জীবের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটায়। ইহা ঘর্ষণ ও আলোড়নের মত যান্ত্রিক উপায়ে তাহাদের ক্ষুদ্রতম কণাগুলির উপর সাধিত হয় এবং সেইগুলি শুষ্ক অথবা তরল অন্য একটি নিষ্ক্রিয় দ্রব্যের সংমিশ্রনে পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় অতীন্দ্রিয়ায়িতকরণ, শক্তিসঞ্চারণ (ভেষজশক্তির স্ফুরণ), এবং তদুৎপন্ন যে ফল তাহাকে বলা হয় বিভিন্ন মাত্রার শক্তি।
#সূত্রঃ ২৭০। শক্তিকরন পদ্ধতি——-
শক্তির সেই সর্বোত্তম বিকাশ লাভের জন্য যে বস্তুতে শক্তি সঞ্চারিত করিতে হইবে তাহার একটি ক্ষুদ্র অংশ, ধরা যাক, এক গ্রেন প্রতিবার একশত গ্রেন করিয়া তিনবারে তিনঘন্টা দুগ্ধশর্করার সহিত নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসারে ১০ লক্ষ ভাগের ১ অংশ বিচূর্ণ করিবার জন্য ঘর্ষণ করিতে হইবে। নিম্নলিখিত কারণসমূহের জন্য এই বিচূর্ণের এক গ্রেন এক ভাগ সুরাসার ও চার ভাগ পাতিত জলের মিশ্রণের পাঁচশত ফোটার সহিত মিশ্রিত করিয়া তাহার এক ফোঁটা একটি শিশিতে রাখা হইল। ইহাতে একশত ফোটা বিশুদ্ধ সুরাসার দিয়া একটি শক্ত অথচ সম্প্রসারণশীল বস্তুর উপর হস্ত দ্বারা একশতবার সজোরে ঝাকি দেওয়া হইল। ইহাই শক্তিতে রূপান্তরিত ঔষধের প্রথম শক্তি। ইহার সহিত ক্ষুদ্র অণুবটিকা ভিজাইয়া লইয়া তখনই ব্লটিং কাগজের সাহায্যে শুকাইয়া লইয়া একটি উত্তমরূপে ছিপিবদ্ধ শিশিতে রাখিয়া প্রথম শক্তি (।) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাহারই একটি মাত্র অণুবটিকা পরবর্তী শক্তি প্রস্তুত করিবার জন্য একটি দ্বিতীয় নুতন শিশিতে (দ্রবীভূত করিবার জন্য এক ফোঁটা জলের) লওয়া হয়, এবং তাহাতে একশত ফোঁটা উত্তম সুরাসার মিশাইয়া পূর্ববর্ণিত উপায়ে একশতবার প্রবল ঝাঁকি দিয়া সূক্ষ্মায়িত করা হয় । সূরাসার মিশ্রিত এই তরল ঔষধ দিয়ে আবার অণুবটিকা সিক্ত করিয়া ব্লটিং কাগজের উপর তাড়াতাড়ি শুকাইয়া লইয়া উত্তাপ ও সূর্যের আলো না লাগিতে পারে এরূপ স্থানে উত্তম ছিপিবন্ধ শিশিকে সংরক্ষিত করিয়া দ্বিতীয় শক্তিরূপে (।।) চিহ্নিত করা হয়।
এইভাবে এই পদ্ধতি ঊনত্রিশ শক্তি পর্যন্ত অনুসরণ করা হয়। তাহার পর একশত ফোটা সুরাসারের সহিত একশত বার ঝাঁকি দিয়া সুরাসারঘটিত একটি তরল ভেষজ পাওয়া যায় যাহার দ্বারা শর্করা হইতে প্রস্তুত অণুবটিকা যথানিয়মে সিক্ত করিয়া ও শুকাইয়া লইয়া ত্রিশ শক্তি প্রস্তুত হয়।
স্থূল ভেষজসমূহ হইতে এইরূপ প্রক্রিয়ায় এমন বস্তু পাওয়া যায় যাহা পীড়িত দেহের ক্লিষ্ট অংশের উপর প্রবল ভাবে প্রভাব বিস্তার করিবার পূর্ণ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। এই প্রকারে কৃত্তিম সদৃশ রোগ শক্তি দ্বারা জীবনীশক্তির উপর প্রভাব বিস্তারকারী প্রাকৃতিক রোগ প্রশমিত হয়। উল্লিখিত নির্দেশ ঠিকমত পালন করলে এই প্রক্রিয়া দ্বারা ভেষজের এরূপ রূপান্তর ঘটে যাহা স্থূল অবস্থায় কেবল জড়ধর্মী ছিল, যাহা ভেষজশক্তিহীন বস্তু বলিয়া মনে হয়ত তাহাও এইরূপ উচ্চ হইতে উচ্চতর সূক্ষ্মায়িতকরণের দ্বারা পরিবর্তিত হইয়া অবশেষে অতীন্দ্রিয় ভেষজশক্তিতে পরিণত হয়। বস্তুত ইহা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয় না বটে কিন্তু ঔষধরূপে প্রস্তুত ইহার শুষ্ক বটিকা যাহা জলে দ্রবীভূত করা হইলে অধিকতর কার্যকরী হয় তাহা বাহক হয় এবং এই অবস্থায় রুগ্ন দেহে এই অদৃশ্য শক্তির রোগ আরোগ্যের ক্ষমতা প্রকাশ করে।
#সূত্রঃ ২৭১। চিকিৎসক স্বহস্তে ঔষধ প্রস্তুত করবেন—-
রোগ হইতে মানুষকে রক্ষা করিবার কর্তব্যবোধে চিকিৎসক যদি তাহার নিজের হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নিজে প্রস্তুত করেন তাহা হলে তিনি টাটকা গাছগাছড়াই ব্যবহার করিবেন কারণ, আরোগ্যের উদ্দেশ্যে তাহার যদি নিংড়ানো রসের প্রয়োজন না হয় তাহা হইলে অল্প পরিমাণ স্হূল বস্তুতেই কাজ হইবে। ঝাঁকি দিয়া শক্তিকৃত করিবার পূর্বে খলে কয়েক গ্রেন মাত্র লইয়া তাহার সহিত একশত গ্রেন দুগ্ধশর্করা তিনবারে মাড়িলে একের দশ লক্ষাংশ শক্তিবিশিষ্ট ভেষজ পাইবেন (২৭০ সূত্র) । শুষ্ক বা তৈলাক্ত অন্যান্য ভেষজ সম্বন্ধেও এই একই প্রথা অনুসরণ করিতে হইবে।
(৩৫) ঔষধের প্রয়োগ ও মাত্রা (সূত্র-২৭২-২৭৪)
#সূত্রঃ ২৭২। অনুবটিকা প্রয়োগ———
এইরূপ একটি শুষ্ক অণুবটিকা জিহ্বায় দিলে অনুগ্র সাম্প্রতিক কোন রোগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রতম মাত্রা। এইক্ষেত্রে ঔষধ অল্প কয়েকটি স্নায়ুকেই স্পর্শ করে। ঐরূপ একটি অণুবটিকা কিছু দুগ্ধশর্করার সহিত গুড়া করিয়া অধিক পরিমান জলে মিশাইয়া (২৪৭ সূত্র) এবং প্রত্যেকবার প্রয়োগ করিবার পূর্বে ভালোভাবে ঝাঁকি দিলে কিছুদিন ব্যবহারের পক্ষে অধিকতর শক্তিশালী ঔষধ প্রস্তুত করা হয়। প্রত্যেকটি মাত্রা, তাহা যতই ক্ষুদ্র হউক, পক্ষান্তরে অনেকগুলি স্নায়ুকে স্পর্শ করে।
#সূত্রঃ ২৭৩। একসাথে একাধিক ঔষধ প্রয়োগ নিষিদ্ধ , একটিমাত্র ঔষধ প্রয়োগ যুক্তিযুক্ত——–
চিকিৎসার কোনো ক্ষেত্রেই একবারে একটির বেশি কোন অবিমিশ্র ভেষজদ্রব্য প্রয়োগ করা আবশ্যক হয় না এবং তাহা সমর্থনযোগ্যও নহে। অসুস্থতায় একবারে একটি মাত্র ঔষধ অথবা বিভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল কতকগুলি ওষুধের মিশ্রণের যুক্তিযুক্ত এবং নিয়মসঙ্গত সেই সম্বন্ধে কেমন করিয়া অনুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে তাহা ধারণাতীত। একমাত্র সত্য, সরল ও প্রাকৃতিক আরোগ্যকলা হোমিওপ্যাথিক বিধানে রোগীকে একেবারে দুইটি বিভিন্ন প্রকারের ভেষজদ্রব্য প্রয়োগ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
#সূত্রঃ ২৭৪। একটি মাত্র অবিমিশ্র ঔষধ প্রয়োগ ব্যতীত চিকিৎসক অন্য কোন চিন্তা করিতে পারেন না— এককভাবে, মিশ্রিত না করিয়া, প্রয়োগ করা হইলে প্রকৃত চিকিৎসক যখন অবিমিশ্রিত ভেষজের মধ্যে যাহা কিছু বাঞ্ছনীয় (কৃত্রিম রোগ শক্তি যাহা হোমিওপ্যাথিক ক্ষমতাবলে প্রাকৃতিক রোগকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত ও ধ্বংস করিয়া স্থায়ী আরোগ্যবিধান করিতে পারে) সকলই পাইতে পারেন তখন “সরল উপায় যথেষ্ট হইলে জটিল উপায় প্রয়োগ করা ভুল” এই নীতিবাক্য স্মরণে রাখিয়া তিনি কখনও একটি অবিমিশ্র ভেষজ দ্রব্য ছাড়া আর কিছু দিবার কথা চিন্তা করিবেন না। আরও এই কারণে যে, অবিমিশ্র ভেষজসমূহের বিশিষ্ট বিশুদ্ধ ক্রিয়া সুস্থ মানবশরীরে সম্পূর্ণ পরীক্ষিত হইয়া থাকিলেও দুই বা ততোধিক ভেষজদ্রব্য সংযুক্ত হইলে মানবশরীরে তাহাদের পরস্পরের ক্রিয়া কিভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পরিবর্তিত হয় তাহা পূর্ব হইতে জানা অসম্ভব। অপরপক্ষে একটি অবিমিশ্র ভেষজ যাহার লক্ষণসমষ্টি সঠিকভাবে জানা আছে তাহা হোমিওপ্যাথিক মতে নির্বাচিত হইয়া ব্যাধিতে প্রয়োগ করা হইলে একাই উপযুক্ত সাহায্য প্রদান করিতে পারে। আর যদি মন ধরা যায়, ঠিক সদৃশ লক্ষণানুসারে নির্বাচিত হয় নাই এবং সেইজন্য কোন উপকার দেখা গেল না তাহা হইলেও তাহা আমাদের ওষুধবিষয়ক জ্ঞান বৃদ্ধির সহায়ক হইবে। কারণ এইরূপ ক্ষেত্রে উদ্ভূত নূতন লক্ষণসমূহ যাহা সুস্থ শরীরে পরীক্ষাকালে পূর্বেই দেখা গিয়েছিল তাহা সমর্থিত হইল। যে সুযোগ একাধিক ঔষধের মিশ্রণের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।
(৩৬) ঔষধ শক্তি (সূত্র-২৭৫-২৮৩)
#সূত্রঃ ২৭৫। ঔষধের প্রতিযোগিতা শুধু উহার সদৃশ নির্বাচনের উপরই নির্ভর করে না, উপযুক্ত মাত্রার উপরও নির্ভরশীল——-
যে কোন পীড়ার ক্ষেত্রে কেবল সদৃশনীতি অনুযায়ী সঠিক নির্বাচনের উপর ঔষধের প্রতিযোগিতা নির্ভর করে না, সেই সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণ অর্থাৎ মাত্রার ক্ষুদ্রতার উপর তাহা নির্ভর করে। সদৃশনীতি অনুসারে নির্বাচিত হইলেও যদি আমরা কোন ঔষধ অত্যধিক মাত্রায় প্রদান করি তাহা হইলে উহার স্বাভাবিক উপকারিতা থাকা সত্বেও তাহা কেবল মাত্রাধিক্যহেতু ক্ষতিকারক হইতে পারে এবং হোমিওপ্যাথিক ক্রিয়ার সাদৃশ্যহেতু অপ্রয়োজনীয়রূপে প্রবলভাবে জীবনীশক্তিকে প্রভাবিত করিয়া ইহার মাধ্যমে জীবসত্তার সর্বাপেক্ষা অনুভূতিশীল অংশসমূহ আক্রমণ করে যেগুলি পূর্বেই প্রাকৃতিক রোগে সর্বাপেক্ষা আক্রান্ত হইয়াছে।
#সূত্রঃ ২৭৬। উপযুক্ত সদৃশ ঔষধের বৃহৎ মাত্রা অনিষ্ট সাধন করে———
এইজন্য কোন ব্যাধিতে হোমিওপ্যাথিক মতে উপযুক্ত ঔষধ নির্বাচন হইলেও তাহার মাত্রা যদি বৃহৎ হয় তাহা হইলে ঐ প্রত্যেকটি বৃহৎ মাত্রাই ক্ষতিকর হয় এবং তাহা তত অধিক সদৃশ হইবে এবং তাহার যত উচ্চশক্তি (এখানে উচ্চশক্তি বলিতে হ্যানেমান বোধ হয় পরিমাণ বুঝাইতে চাহিয়াছেন ।) নির্বাচিত হইবে উহা তত বেশি ক্ষতিকর হইবে যাহা অদৃশ্য এবং রোগলক্ষণ অনুসারে নির্বাচিত নহে এইরূপ ঔষুধের (অ্যালোপ্যাথিক) ক্ষেত্রে যত না হয়। সঠিক নির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের মাত্রাসমূহ বিশেষত তাহা পুনঃ পুনঃ প্রয়োগ করা হইলে সাধারণত প্রভূত অনিষ্ট সাধিত হইয়া থাকে। ইহা প্রায়শই রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে কিংবা রোগকে অসাধ্য করিয়া তোলে । প্রাণশক্তির অনুভূতির দিক দিয়া তাহা প্রাকৃতিক রোগকে ধ্বংস করে এবং অত্যধিক মাত্রার হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ক্রিয়া প্রকাশের মুহূর্ত হইতে রোগী আর মূলরোগে কষ্ট পায় না বটে কিন্তু তাহার ফলে রোগী সদৃশ ওষুধজ ব্যাধির প্রবল প্রভাবে অধিকতর পীড়িত হইয়া পড়ে—যাহা দূর করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য ।
#সূত্রঃ ২৭৭। সুনির্বাচিত সদৃশ ওষুধের ক্ষুদ্রমাত্রা অধিকতর কার্যকরী—–
ঠিক একই কারণে এবং যেহেতু একটি ঔষধ, যদি তাহার মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষুদ্র হয়, যত অধিক সদৃশভাবে নির্বাচিত হইবে তত অধিক হিতকারী এবং বিস্ময়করভাবে কার্যকরী হইবে, সেইহেতু কোন ঔষধের নির্বাচন ঠিক সদৃশভাবে করা হইলে তাহার মাত্রাকে অতি ক্ষুদ্র করিয়া যদি নিরুপদ্রব্য নিরাময়ের উপযুক্ত পর্যায়ে হ্রাস করা হয় তাহা হইলে তাহা তত বেশি পরিমাণে হিতকারী হইবে।
#সূত্রঃ ২৭৮। উপযুক্ত ক্ষুদ্রমাত্রা অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার দ্বারা নির্ণয় করা যায়——
এখন প্রশ্ন এই, সুনিশ্চিত ও বিনাকষ্টে আরোগ্যবিধানের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ক্ষুদ্রতম মাত্রা কি? অর্থাৎ যে কোন রোগের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম আরোগ্যবিধানের জন্য সদৃশভাবে নির্বাচিত প্রত্যেকটি ওষুধের মাত্রা কত ক্ষুদ্র হইবে? এই সমস্যার সমাধানের জন্য এবং প্রত্যেকটি ওষুধের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক মতে আরোগ্য প্রদানের জন্য তাহার কি মাত্রা যথেষ্ট হইবে অথচ তাহা এত ক্ষুদ্র হইবে যাহাতে সর্বাপেক্ষা নিরুপদ্রব্য ও দ্রুত আরোগ্যলাভ করা যায়—- এই সমস্যার সমাধান যে অনুমান বা জল্পনা-কল্পনার বিষয় নহে এবং তাহা যে যুক্তির জাল বুনিয়া বা আপাতমধুর তর্ক ও আলোচনা দ্বারা করা যায় না তাহা সহজে ধারণা করা যায়। আবার সকল রকম সম্ভাব্য রোগীক্ষেত্রও হিসাবে আনা অসম্ভব। বিশুদ্ধ পরীক্ষা, প্রত্যেকটি রোগীর অনুভূতিপ্রবণতা সম্বন্ধে যত্নসহকারে পর্যবেক্ষণ এবং সঠিক অভিজ্ঞতাই প্রত্যেকটি রোগীক্ষেত্রে তাহা নির্দেশ করিতে পারে । হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যের জন্য মাত্রার ক্ষুদ্রতা সম্বন্ধে বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা যাহা ব্যক্ত করে তাহার বিপক্ষে পুরাতন পন্থানুযায়ী (অ্যালোপ্যাথিক) ঔষধের বৃহৎ মাত্রার—-যাহা দেহের পীড়িত অংশকে সদৃশনীতি অনুযায়ী স্পর্শ করে না, ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত নহে এমন অংশকেই কেবল আক্রমণ করে—নজির দেখান অযৌক্তিক।
#সূত্রঃ ২৭৯। উচ্চ শক্তির ঔষধের নূন্যতম ক্ষুদ্রমাত্রাও ব্যাধিকে পরাভূত করিতে পারে——–
এই বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা সর্বতোভাবে প্রকাশ করে যে, যদি ব্যাধি প্রকাশ্যভাবে দেহের কোন প্রধান আন্তরযন্ত্রের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির উপর নির্ভর না করে (এমন কি ইহা যদি চির ও জটিল পীড়াসমূহেরও অন্তর্ভুক্ত হয়) এবং চিকিৎসাকালে যদি অন্যান্য বিরুদ্ধ ঔষধের প্রভাব হইতে রোগীকে দূরে রাখা হয় তাহা হইলে কোন মুখ্য বিশেষত চিররোগচিকিৎসার আরম্ভে সদৃশনীতি অনুসারে নির্বাচিত উচ্চশক্তির ঔষধের মাত্রাকে কখনই এত ক্ষুদ্র কোরিয়া প্রস্তুত করা যায় না যে যাহা প্রাকৃতিক রোগ হইতে অধিক বলশালী হইবে না কিংবা তাহাকে অন্তত আংশিকভাবে পরাভূত করিতে পারিবে না এবং প্রাণশক্তির অনুভূতির ক্ষেত্র হইতে তাহাকে মুছিয়া ফেলিয়া আরোগ্যের সূচনা করিবে না।
#সূত্রঃ ২৮০। ঔষধের যে মাত্রাটির দ্বারা উপকার পাওয়া যায়————
নূতন কোন কষ্টকর উপসর্গ উৎপন্ন না করিয়া ঔষধের মাত্রা দ্বারা উপকার পাওয়া যাইতেছে তাহা ক্রমোন্নত শক্তিতে প্রয়োগ করিয়া চলিতে হইবে যতদিন সাধারণ উন্নতির সহিত রোগী একটি বা কতিপয় পুরাতন প্রাথমিক উপসর্গের মৃদু প্রত্যাবর্তন অনুভব করিতে আরম্ভ না করে। ইহা দ্বারা সূচিত হয় যে প্রত্যেকবার ঝাঁকি দিয়া পরিবর্তিত ক্রমোন্নত মাত্রার ভিতর দিয়া আরোগ্য নিকটবর্তী হইতেছে (২৪৭ সূত্র)। ইহা নির্দেশ করে যে প্রকৃতির ব্যাধির অনুভূতি হইতে মুক্তিলাভ করিবার জন্য জীবনীশক্তিকে সদৃশ ওষুধজ ব্যাধির দ্বারা প্রভাবিত করিবার আর প্রয়োজন নাই (১৪৮ সূত্র) । ইহা দ্বারা বুঝা যায়, প্রাকৃতিক ব্যাধি হইতে মুক্ত জীবনীশক্তি এখন হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি বলিয়া এযাবৎ পরিচালিত ওষুধজনিত কিছু ব্যাধি ভোগ করিতে শুরু করিয়াছে।
#সূত্রঃ ২৮১। অল্পদিন ঔষধ বন্ধ রাখিয়া প্রকৃত আরোগ্য পর্যবেক্ষন করিতে হইবে——-
এ বিষয়ে সুনিশ্চিত হইবার জন্য আট, দশ কিংবা পনের দিন কোন ঔষধ না দিয়া শুধু দুগ্ধশর্করার পুরিয়া দিয়া রোগীকে রাখা হয় । শেষের দিকে আগত উপসর্গগুলি যদি ঔষধজনিত হয় এবং তাহা যদি পূর্বেকার প্রাথমিক রোগলক্ষণের অনুরূপ হয় তাহা হইলে এই সকল উপসর্গ কয়েক দিন বা ঘণ্টার মধ্যেই তিরোহিত হইবে। ঔষধ বিহীন দিন গুলির মধ্যে স্বাস্থ্যনীতি বজায় রাখিয়া যদি প্রাথমিক ব্যাধির আর কিছুই দেখিতে পাওয়া না যায় তাহা হইলে, সম্ভবত রোগী আরোগ্যলাভ করিয়াছে। কিন্তু কিছুদিন পরে পূর্বের ব্যাধিলক্ষণ কিছু কিছু যদি পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হয় তাহা হইলে সেইগুলি প্রাথমিক রোগের অবশিষ্টাংশ যাহা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস প্রাপ্ত হয় নাই। উহাকে ঔষুধের উচ্চতর শক্তি দ্বারা পূর্ব নির্দেশ অনুসারে নতুনভাবে চিকিৎসা করিতে হইবে। আরোগ্যবিধান করিতে হইলে প্রাথমিক অল্পমাত্রাকে অনুরূপভাবে পুনরায় ক্রমোন্নত করিতে হইবে। তবে তাহা স্বল্প অনুভূতিপ্রবণরোগীর ক্ষেত্রে যেমন দ্রুত গতিতে উচ্চতর শক্তিতে অগ্রসর হওয়া যায়, অধিকতর উত্তেজনাপ্রবণ রোগীর ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত ধীর ও মন্হর গতিতে তাহা করা যাইতে পারে। এমন অনেক রোগী আছে যাহাদের অনুভূতিপ্রবনতার সহিত অনুভূতিবিহীনের অনুপাত হাজারে এক ।
#সূত্রঃ ২৮২। প্রথম মাত্রার ঔষধ জনিত রোগ বৃদ্ধি ওষুধের বৃহৎ মাত্রার পরিচায়ক——-
চিকিৎসাকালে বিশেষত চিররোগ চিকিৎসায় প্রথম মাত্রাতে এবং প্রত্যেকটি পুনঃপ্রযুক্ত মাত্রা ( ২৪৭ সূত্র ), তাহা প্রয়োগ করিবার পূর্বে ঝাঁকি দিয়া যতই পরিবর্তিত (অর্থাৎ অধিকতর শক্তি সঞ্চারিত) করা হোক না কেন, যদি তথাকথিত হোমিওপ্যাথিক বৃদ্ধি অর্থাৎ প্রথমে লক্ষিত মূল পীড়ার সুস্পষ্ট বৃদ্ধি আনে তাহা হইলে ইহা মাত্রাধিক্যের সুনিশ্চিত লক্ষণ।
#সূত্রঃ ২৮৩। ক্ষুদ্র মাত্রার সুবিধা———
প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুবর্তী হইয়া কাজ করিবার জন্যই প্রকৃত আরোগ্যশিল্পী সর্বতোভাবে উপযোগী হয় এমন সুনির্বাচিত হোমিওপ্যাথিক ওষুধ অতি অল্প মাত্রায় ব্যবস্থা করিবেন। মনুষ্যোচিত দুর্বলতা দ্বারা বিভ্রান্ত হইয়া যদি তাহাকে অনুপোযোগী ঔষধ প্রয়োগ করিতে হয় তাহা হইলে রোগের সহিত ওষুধের ভুল সম্বন্ধহেতু অসুবিধা এত অল্প হয় যে রোগী তাহার জীবনীশক্তির সাহায্যে এবং সদৃশ লক্ষণানুসারে নির্ভুলভাবে নির্বাচিত ঔষধের (ইহাও অতি ক্ষুদ্রতম মাত্রায়) শীঘ্র বাধা প্রদানের দ্বারা ( ২৪৯ সূত্র) তাহা দ্রুত দূর করিতে ও তাহার সংস্কার করিতে পারে।
(৩৭) চুম্বক, বিদ্যুৎ, মর্দন ও মেসমেরিজম (সূত্র-২৮৪-২৯১)
#সূত্রঃ ২৮৪। ঔষধ দ্বারা কোন কোন অঙ্গ প্রভাবিত হয়———
জিভ, মুখ ও পাকাশয় সাধারণভাবে ওষুধের দ্বারা সর্বাপেক্ষা প্রভাবিত হইলেও নাসিকা ও শ্বাসযন্ত্রও নিঃশ্বাস গ্রহণ ও ঘ্রাণের সাহায্যে তরল ঔষধের ক্রিয়া গ্রহণ করিতে পারে। কিন্তু দেহের ত্বক আচ্ছাদিত সমস্ত অংশ ও তরল ভেষজ দ্রব্যের ক্রিয়া গ্রহণে উপযুক্ত, বিশেষত ঔষধ মর্দনের সহিত যদি উহার অভ্যন্তরীণ প্রয়োগও করা হয়।
#সূত্র- ২৮৫। পুরাতন রোগে নির্বাচিত ঔষুধের বাহ্যিক মর্দন আরোগ্য সাধনকে ত্বরান্বিত করে——–
এইরূপে, চিকিৎসক যে ঔষধ সেবনে করিতে দিয়াছেন এবং আরোগ্যপ্রদ বলিয়া জানা গিয়েছে তাহা বাহ্য প্রয়োগে পৃষ্ঠে, বাহুতে হস্তপদে মর্দন করিতে দিয়া অতি পুরাতন ব্যাধির আরোগ্য বিধান দ্রুততর করিতে পারেন। ইহা করিতে গিয়া ব্যাথা, আক্ষেপ কিংবা উদ্ভেদযুক্ত অংশ অবশ্যই বাদ দিবেন।
#সূত্রঃ ২৮৬ । চুম্বক, বিদ্যুৎ প্রভৃতিও জীবনীশক্তির উপর ক্রিয়া করে থাকে ———
মুখ দিয়ে সেবন, ত্বকে মর্দন কিংবা ঘ্রাণের সাহায্যে রোগ প্রশমনকারী তথাকথিত ঔষধ অপেক্ষা খনিজ চুম্বকের সূক্ষ্মশক্তি, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন তড়িৎশক্তির প্রাণশক্তির উপর ক্রিয়া কম নহে এবং ঐগুলি কম সদৃশগুণসম্পন্ন নহে। এমন রোগ ও থাকিতে পারে বিশেষত, সংবেদনশীলতা ও উত্তেজনা, অস্বাভাবিক অনুভূতি এবং অনৈচ্ছিক পেশিকম্পনসংক্রান্ত যেগুলি ঐ সকল উপায়ে নিরাময় হইতে পারে। কিন্তু শেষোক্ত দুইটির সুনিশ্চিত প্রয়োগপদ্ধতি তথা তড়িৎচুম্বক যন্ত্রের প্রয়োগ সম্বন্ধে জ্ঞান এত অল্প যে হোমিওপ্যাথিক মতে তাদের ব্যবহার চলে না। এই পর্যন্ত বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক তড়িতের সাময়িক উপশমের জন্য যে ব্যবহার হইয়াছে তাহা রোগীর ক্ষতিরই কারণ হইয়াছে। সুস্থ মানবদেহে উভয়ের সুনির্দিষ্ট বিশুদ্ধ ক্রিয়া এখনও পর্যন্ত সামান্যই পরীক্ষা করা হয়েছে।
#সূত্রঃ ২৮৭। খনিজ চুম্বকের ব্যবহার————
মেটেরিয়া মেডিকা পিউরা শক্তিশালী চুম্বক শলাকার উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর প্রত্যক্ষ ক্রিয়া সম্বন্ধে যে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে তদনুসারে রোগ নিরাময়ের জন্য উহা অধিকতর নিশ্চয়তার সহিত প্রয়োগ করা যাইতে পারে। যদিও উভয় মেরুই সমান শক্তিশালী তথাপি নিজস্ব ক্রিয়া অনুসারে তাহারা পরস্পর বিপরীত আচরণ করে। লক্ষণানুযায়ী সূচিত উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর স্পর্শকালের সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বারা মাত্রার তারতম্য ঘটানো হয়। বিষম ক্রিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে পালিশ করা দস্তার প্লেট ব্যবহারই যথেষ্ট।
#সূত্রঃ ২৮৮। জৈবিক চুম্বক বা মেসমেরিজম———
আমি এখনো জৈবিক চুম্বকত্ব অভিহিত অর্থাৎ মেসমেরিজম সম্বন্ধে (প্রথম আবিষ্কারক মেসমারের প্রতি শ্রদ্ধাবশত যে নাম উল্লেখযোগ্য) যাহা অন্য সকলপ্রকার আরোগ্যদায়ী বস্তু হইতে প্রকৃতিতে এত ভিন্ন—উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি। শতাব্দি ধরিয়া নির্বোধের মতো অস্বীকৃত ও অবজ্ঞাত এই আরোগ্যদায়ী শক্তির ক্রিয়া বিভিন্নমুখী। ইহা মনুষ্যসমাজে ভগবানের এক বিস্ময়কর অমূল্য দান, যদ্দারা প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পূর্ণ কোন হিতাকাঙ্খী ব্যক্তি স্পর্শ. এমন কি ইহা ব্যতীত দূর হইতেও রোগীর ভিতরে নিজের সুস্থ জীবনীশক্তিকে সুক্ষ্মভাবে সঞ্চারিত করিতে পারেন (ঠিক যেমন শক্তিশালী চুম্বকের একটি মেরু একটি ইস্পাত শলাকার উপর করে)। রোগীর দেহে যে সকল স্থানে জীবনীশক্তি ক্ষীণ অবস্থায় থাকে এবং অন্যান্য অংশে অধিকমাত্রায় সঞ্চিত হইয়া উহা স্নায়ুবিক বিশৃঙ্খলা ঘটায় সেই সকল স্থানে উহা সরাইয়া দিয়া, হ্রাস করিয়া এবং তাহার সমতা রক্ষা করিয়া এবং সাধারণভাবে রোগীর প্রাণশক্তির ব্যাধিসমূহ যথা, পুরাতন ক্ষত, অন্ধতা, একটি অঙ্গের পক্ষাঘাত প্রভৃতিকে দূরীভূত করিয়া সম্মোহক তাহার শক্তিশালী সম্মোহকের বিভিন্ন যুগে যে সকল দ্রুত আপাত আরোগ্যসাধন করিয়া থাকেন তাহা এই শ্রেণীর অন্তর্গত। পূর্ণ তেজ ও শক্তি-সম্পন্ন ব্যক্তির সহানুভূতিপূর্ণ অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ইচ্ছাশক্তিরূপ মানবীয় ক্ষমতা প্রয়োগ দ্বারা সমগ্র মানবদেহে শক্তি সঞ্চারণে মৃতকল্প ব্যক্তির পুনরুজ্জীবন চমৎকারভাবে দেখা গিয়াছে এবং এইপ্রকার পুনর্জীবনলাভের অনেক অনস্বীকার্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বর্ণিত আছে। যদি সক্ষম সম্মোহনকারী স্ত্রী অথবা পুরুষ—-সৎপ্রভৃতির এবং উৎসাহশীল হন (এমন কি তাহা বিকৃত হইয়া যদি গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, অতীন্দ্রিয়তা ও বিশ্বহিতৈষণার স্বপ্নেও দাঁড়ায়) তাহা হইলে তিনি আরও অধিক এই জনহিতকর আত্মোৎসর্গকারী ক্রিয়াশীল ব্যবহার করিয়া তাহার সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির প্রতি তাঁহার আদেশব্যঞ্জক সদিচ্ছাকে পরিচালনা করিতে পারেন এবং কখনও কখনও তাহা কেন্দ্রীভূত করিয়া অলৌকিক ঘটনা দেখাইতে পারেন।
#সূত্রঃ ২৮৯। মেসমেরিজমের প্রকার———-
রোগীর ভিতরে অল্পাধিক জীবনীশক্তির অনুপ্রবেশের উপর সম্মোহনশক্তি ব্যবহারের উল্লিখিত সকল পদ্ধতি নির্ভর করে বলিয়া উহাদের বলা হয় পজিটিভ মেসমেরিজম (positive mesmerism)। সম্মোহনশক্তি প্রয়োগের বিপরীত পদ্ধতি যাহা বিপরীত ফল প্রদান করে তাহাকে বলা হয় নেগেটিভ মেসমেরিজম (negative mesmerism)।
স্বপ্নচারিতা হইতে জাগরিত করিবার জন্য হস্তচালনা এবং প্রশমন ও সঞ্চালন নামক সকল প্রকার দৌহিক কৌশল এই শ্রেণীর অন্তর্গত। দুর্বল নয় এইরূপ ব্যক্তি বিশেষ কোন স্থানে বেশি পরিমাণে সঞ্চিত জীবনীশক্তিকে নেগেটিভ মেসমেরিজম দ্বারা নিশ্চিত ও সহজভাবে বিমোচন করা যায় প্রসারিত হাতের তালুকে শরীর হইতে এক ইঞ্চি দূরে সমান্তরালভাবে রাখিয়া মস্তকশীর্ষ হইতে পায়ের আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত দ্রুত সঞ্চালন করিয়া। যত দ্রুত হস্ত সঞ্চালন করা যাইবে তত ফলপ্রদরূপে বিমোচন ঘটিবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পূর্বে সুস্থ ছিল এইরূপ স্ত্রীলোক প্রচন্ড মানসিক আঘাতহেতু হঠাৎ রজঃস্রাব বন্ধ হইয়া মৃতকল্প হইয়া পড়িল জীবনীশক্তি সম্ভবত হৃৎপ্রদেশে কেন্দ্রীভূত হয় যাহা দ্রুত নেগেটিভ মেসমেরিজম প্রয়োগে বিমোচিত হইয়া সমগ্র দেহে সমতা প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে এবং তাহার ফলে তৎক্ষণাৎ তাহার পুনরুজ্জীবন ঘটে। সেইরূপ কোন অত্যধিক উত্তেজনাপ্রবণ ব্যক্তির উপর অত্যধিক শক্তিশালী পজিটিভ হস্তচালনাজনিত অতিরিক্ত অস্থিরতা ও অনিদ্রা এবং তৎসহ উৎকণ্ঠা মৃদু ও ধীর নেগেটিভ সঞ্চালনে উপশম প্রাপ্ত হয়।
#সূত্রঃ ২৯০। অঙ্গ দলনে স্বাভাবিক শক্তি ফিরিয়া আসে—————
রোগ সরিয়া গিয়াছে কিন্তু ধীরে ধীরে সুস্থ হইয়া উঠিতেছে এমন ক্ষীণ দেহ, দুর্বল পরিপাকশক্তিযুক্ত ও নিদ্রাহীন চিররোগীর সৎপ্রকৃতিবিশিষ্ট কোন বলবান ব্যক্তি কর্তৃক অঙ্গমর্দন ও ইহার অন্তর্ভুক্ত। হাত,পা, বুক ও পিঠের মাংসপেশিকে পৃথকভাবে ধরিয়া ও পরিমিত চাপ দিয়ে মর্দন করিলে জীবনী- শক্তি জাগ্রত হইয়া মাংসপেশি, ধমনি ও লসিকানালীসমূহে সঞ্চালিত হয় এবং তাহাদের স্বাভাবিক শক্তি ফিরাইয়া আনে। সম্মোহনের প্রভাবই হইল এই পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য এবং উত্তেজনাপ্রবণ রোগীতে ইহা অতিরিক্ত করা উচিত নহে।
#সূত্রঃ ২৯১। বিভিন্ন তাপমাত্রায় স্নানের উপকারিতা——-
বিশুদ্ধ জলে স্নান কতকটা উপশমকারী, কতকটা অচিররোগ এবং চিররোগ সারিয়া যাওয়ার পর স্বাস্থ্যলাভের পথে হোমিওপ্যাথিক মতে সাহায্য করে যদি স্বাস্থ্যের অবস্থা, জলের তাপমাত্রা, স্নানের স্থিতিকাল এবং পুনরায় স্নান করা সম্বন্ধে যথাযথ বিচার করা যায়। কিন্তু উত্তম প্রয়োগ হইলেও তাহা কেবল রুগ্ন দেহের শারীরিক পরিবর্তনই আনয়ন করে, উহা কোন প্রকৃত ঔষধ নহে। ২৫-২৭ ডিগ্রীর রেওমিউর (Reaumur) [৩১°-৩৪° সেলসিয়াস—ত্রি না ব] ঈষদুষ্ণ জল মৃতকল্প ব্যক্তির (ঠান্ডায় অসাড়, জলমগ্ন, রুদ্ধশ্বাস) সাড়হীন স্নায়ুচেতনাকে জাগ্রত করে। যদিও ইহা সাময়িক উপশমকারী তথাপি ইহা অনেক সময় যথেষ্ট কার্যকরী বলিয়া বিবেচিত হয়, বিশেষত কফি ও হস্তদ্বারা ঘর্ষণসহ প্রয়োগ করা হইলে। হোমিওপ্যাথিক মতে তাহাদের ক্রিয়া সেই সকল ক্ষেত্রে প্রকাশ পায় যেখানে উত্তেজনা খুব অসমভাবে ছড়াইয়া থাকে এবং শরীরের অভ্যন্তরস্থ কোন যন্ত্রে অত্যন্ত অসমভাবে জমিয়া থাকে, যেমন কতিপয় হিস্টিরিয়া রোগীর আক্ষেপ এবং শিশুদের তড়কায় হয়। ঠিক একই প্রকারে চিররোগ চিকিৎসার দ্বারা সারিয়া যাইবার পর এবং জীবনীশক্তির উত্তাপের অভাব ঘটিলে হোমিওপ্যাথিক মতে শীতল জলে (১০ হইতে ৬ ডিগ্রি রেওমিউর) [১৩°-৮° সেলসিয়াস-ত্রি না বা ] স্নান সহায়ক হয় । তাৎক্ষণিক এবং পরে পুনঃপুন অবগাহন অবসন্ন মাংসপেশির শক্তি সাময়িকভাবে পুনরুদ্ধার করে। এই উদ্দেশ্যে এইরূপ স্নান মুহূর্তকালের বেশি বরং কয়েক মিনিটের জন্য এবং ক্রমশ নিম্ন উত্তাপে হওয়া উচিত। উহা সাময়িক উপশমপ্রদ এবং উহা কেবল বাহ্যত ক্রিয়া প্রকাশ করে বলিয়া সাময়িক উপশমকারী অতীন্দ্রিয় ভেষজ হইতে যেমন বিপরীত ক্রিয়ার আশঙ্কা থাকে ইহাতে সে অসুবিধার সম্ভাবনা নাই।
—– সমাপ্ত—–