অর্গানন অব মেডিসিন: সূত্র- ৪৭ থেকে ৮২ পর্যন্ত।

ডি.এইচ.এম.এস (ডিপ্লোমা) কোর্সঃ ১ম বর্ষের সিলেবাসঃ ২য় পর্ব।
(১০) হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা (সূত্র-৪৭-৫৩)
#সূত্রঃ ৪৭। ঔষধ সম্বন্ধে প্রকৃতির শিক্ষা-
প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া নিশ্চিতভাবে, দ্রুত ও স্থায়ীরূপে আরোগ্যবিধান করিবার জন্য কোন্ জাতীয় ঔষধ নির্বাচন করা উচিত তাহা উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি ছাড়া আর কিছুই সহজ ও সন্দেহাতীতভাবে চিকিৎসককে শিখাতে পারে না ।
#সূত্রঃ ৪৮। বিসদৃশ ঔষধ নহে, সদৃশ শক্তিশালী ঔষধ দ্বারাই রোগ দূরীভূত হয়-
উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি হইতে আমরা দেখিতে পাই, প্রাকৃতিক বিধানে কিংবা চিকিৎসকের নৈপুণ্যে-কোন প্রকারেই এবং কোন ক্ষেত্রেই উপস্থিত কোন ব্যাধিকে বিসদৃশ রোগশক্তি দ্বারা-তাহা যতই শক্তিশালী হোক না কেন দূরীভূত করা যায় না । কিন্তু চিরন্তন অমোঘ প্রাকৃতিক নিয়মে- এই পর্যন্ত স্বীকৃত হয় নাই-একটি সদৃশ এবং বলবত্তর শক্তি দ্বারা তাহা দূরীভূত হয়।
সূত্রঃ ৪৯। সদৃশ বিধানমতে প্রকৃতিতে রোগারোগ্য এত কম দেখা যায় কেন?
হোমিওপ্যাথিক রীতিতে এইরূপ যথার্থ প্রাকৃতিক আরোগ্যবিধান আমরা আরও অনেক দেখিতে পাইতাম যদি পর্যবেক্ষকগণ আরও বেশি মনোযোগসহকারে সেদিকে লক্ষ্য রাখিতেন এবং অপরপক্ষে আরোগ্যসহায়ক সদৃশ লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক রোগ যদি এত কম না থাকিত ।
#সূত্রঃ ৫০। বসন্ত ও হাম প্রভৃতি প্রাকৃতিক পীড়া হোমিও ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না কেন?
আমরা দেখিতে পাই যে শক্তিসম্পন্ন প্রাকৃতির কর্তৃত্বাধীনে সদৃশ রীতিতে আরোগ্য বিধান করিবার যন্ত্ররূপে সূক্ষ্ম রোগবীজজাত স্থায়ী ধরনের পিড়াসমূহ (খোসপাঁচড়া), হাম, বসন্ত প্রভৃতি রোগশক্তি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই নাই। ভেষজরূপী সেই সকল ব্যাধি অত্যন্ত মারাত্মক এবং সেই জন্য যে রোগ সারাইবার জন্য তাহাদের প্রয়োগ করা হয় তাহা অপেক্ষা সেইগুলি আরও ভয়ঙ্কর অথবা সেগুলির প্রকৃতি এইরূপ (খোসপাঁচড়ার মতো ) যে রোগ সারাবার পরে তাহাদিগকেই নির্মল করিবার জন্য আবার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। উল্লিখিত উভয় কারণেই সেগুলি হোমিওপ্যাথিক ঔষধরূপে ব্যবহৃত হওয়া কষ্টকর, অনিশ্চিত ও ভীতিপ্রদ। আর যে সকল ব্যাধি দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয় তাহাদের কয়টিই বা বসন্ত, হাম বা খোসপাঁচড়া রোগের ভিতরে তাহাদের সদৃশ আরোগ্যশক্তি খুঁজিয়া পাইবে? সেই জন্য প্রাকৃতিক বিধানে অতি অল্প কয়েকটি পিড়াই সেই সকল অনিশ্চিত, বিপদসঙ্কুল, হোমিওপ্যাথিক রোগশক্তি দাঁড়া নিরাময় হইতে পারে। তাহা ছাড়া, তাহাদের মাধ্যমে যে আরোগ্যবিধান তাহাতে আরও বিপদ ও যথেষ্ট অসুবিধার কারণ আছে। তাহার এই যে ঐ সকল রোগশক্তির মাত্রাকে ওষুধের মাত্রার মতো অবস্থাঅনুযায়ী কামাইতে পারা যায় না, অথচ অনুরূপ দীর্ঘস্থায়ী পীড়ায় আক্রান্ত রোগীকে বসন্ত, হাম বা খোসপাঁচড়ার মতো ভয়াবহ ও যন্ত্রণাদায়ক পীড়া সম্পূর্ণভাবে ভোগ করিতে হয় এবং সেই রোগকে পরে আবার সারাইতে হয়। তথাপি যাহা দেখা গিয়াছে তাহার শুভ যোগাযোগে হোমিওপ্যাথিক রীতি দ্বারা সম্পন্ন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হোমিওপ্যাথিক রীতি দ্বারা সম্পন্ন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আরোগ্যবিধান দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারে। সেগুলি প্রকৃতির সন্দেহাতীত প্রমাণ এবং তাহার মধ্যে এই শিক্ষা নিহিত আছে, সদৃশ লক্ষণ দ্বারা আরোগ্য বিধান কর ।
#সূত্রঃ ৫১। এই আরোগ্য নীতি সকল বুদ্ধিমান ব্যক্তির নিকট স্পষ্টরূপে বোধগম্য হওয়ার পক্ষে এই সকল তথ্যই যথেষ্ট । আবার ইহাও দেখা যায়, স্হূল প্রকৃতির খেয়াল খুশি মাফিক ক্রিয়া পদ্ধতি অপেক্ষা মানুষ কত বেশি সুবিধার অধিকারী। সমস্ত জগতে কত সহস্র সহস্র সদৃশ রোগ উৎপাদনকারী ভেষজদ্রব্য রহিয়াছে যেগুলি মানুষের আয়াত্তাধীনে পীড়িত মানবকে আরোগ্যের জন্য ব্যবহৃত হইতে পারে। তাহাদের মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় সকল প্রকার সম্ভাব্য ক্রিয়াসমন্বিত রোগ উৎপাদক শক্তি,। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জন্য যাহা ধারণাগম্য ও ধারণাতীত অসংখ্য প্রাকৃতিক পিড়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইতে পারে। ঐ সকল রোগ উৎপাদক ভেষজসমূহের আরোগ্যবিধায়ক ক্রিয়া শেষ হইলে তাহাদের শক্তি জীবনীশক্তি দ্বারা পরাভূত হয় এবং নিজে নিজেই মিলাইয়া যায়। খোসপাঁচড়ার মতো তাহাদিগকে তারাইবার জন্য আর দ্বিতীয়বার চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। সেগুলিকে (ভেষজ) চিকিৎসক চূর্ণীকৃত ও বিভাজিত করিয়া অসীমশক্তির আধাররূপে পরিণত করিতে পারেন এবং তাহাদের মাত্রাকে তিনি এরূপ পরিমাণে হ্রাস করিতে পারেন যে, যে সদৃশ রোগকে সারাইবার জন্য তাহা প্রয়োগ করা হয় তদপেক্ষা (সেইমাত্রা) কিছু বেশি শক্তিশালী অবস্থায় থাকে। তাহার ফলে, এই অতুলনীয় চিকিৎসাপদ্ধতিতেই পুরাতন দুরারোগ্য ব্যাধির মূলোৎপাটন করিবার জন্য দেহের উপর প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া আনার প্রয়োজন হয় না। এই প্রণালীতে আরোগ্যলাভ ঘটে শান্তভাবে ও অজ্ঞাতসারে অথচ অনতিবিলম্বে যন্ত্রণাদায়ক প্রাকৃতিক পীড়াকে বাঞ্ছিত স্হায়ী সুস্থতায় রূপায়িত করে।
#সূত্রঃ ৫২। আরোগ্যবিধানের জন্য মাত্র একটি প্রধান পথ খোলা রহিয়াছে। একটি ভিত্তি হইল প্রাকৃতিকে নির্ভুলভাবে পর্যবেক্ষণ, সতর্ক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা- যাহাকে হোমিওপ্যাথিক রীতি বলা হয় (ইচ্ছাপূর্বক এই শব্দটি পূর্বে আমরা কখন ও ব্যবহার করি নাই) এবং দ্বিতীয়টি হলো হেটারোপ্যাথিক বা এলোপ্যাথিক পদ্ধতি যাহাতে এসব কিছু করা হয় না। একটি অপরটির বিপরীত; যিনি দুইটির একটিকেও জানেন না তাহারই এই ভ্রান্তি আসা সম্ভব যে দুইটি পদ্ধতি পরস্পর মিলিত হইয়া পরস্পরের সহিত যুক্ত হতে পারে। তিনিই রোগীর ইচ্ছানুসারে একসময়ে হোমিওপ্যাথিকমতে, অন্য সময়ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসা করিয়া নিজেকে হাস্যাস্পদ করেন। এইরূপ চিকিৎসাকে অনুপম হোমিওপ্যাথির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধ বলা যাইতে পারে।
#সূত্রঃ ৫৩। শান্তভাবে প্রকৃত আরোগ্যলাভ কেবলমাত্র হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতেই ঘটা সম্ভব। অভিজ্ঞতা ও সিদ্ধান্তসূত্রে আমরা দেখিয়েছি (৭-২৫) যে ইহা নিঃসন্দেহে ঠিক পথ যাহার অনুসরণে কলানৈপুণ্যের ভিতর দিয়া সর্বাপেক্ষা দ্রুত, সুনিশ্চিত ও স্থায়ী আরোগ্যলাভ সম্ভব; যেহেতু এই আরোগ্যকলা প্রকৃতির এক চিরন্তন অভ্রান্ত নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথিক আরোগ্যকলাই একমাত্র নির্ভুল পদ্ধতি, মানুষের কলাকৌশলসাধ্য, আরোগ্যলাভের সরলতম পথ, দুইটি নির্দিষ্ট বিন্দু মধ্যে একটি মাত্র সরল রেখার ন্যায় ধ্রুব।
(১১) হোমিওপ্যাথিক ও এলোপ্যাথিক চিকিৎসার তুলনা (সূত্র-৫৪-৬২)
#সূত্রঃ ৫৪। কল্পিত রোগবস্তূ খুঁজিয়া বিভিন্ন রোগ নামকরনান্তে মিশ্র ঔষধ ব্যবস্থা করাই এলোপ্যাথিক নীতি-
এলোপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালীতে রোগের বিরুদ্ধে অনেক কিছুই ব্যবহৃত হয়, কিন্তু সাধারণত সেগুলি অনুপযুক্ত এবং বহুকাল ধরিয়া ইহারা নানাপ্রকার পদ্ধতি নামে অভিহিত হইয়া আধিপত্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছে। ইহাদের প্রত্যেকটি এক এক সময়ে বিশেষভাবে আকার বদলাইয়া যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসাপদ্ধতি বলিয়া নিজেকে গৌরবদান করিয়াছে। এইরুপ পদ্ধতির প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠাতাই নিজের সম্বন্ধে মানবের অন্তঃপ্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহার সুস্পষ্ট পরিচয় পাইয়াছেন এবং কোন দূষিত বস্তু রোগীর দেহ হইতে বিদূরিত করিতে হইবে এবং তাহার স্বাস্থ্য ফিরাইয়া আনিবার জন্য কিভাবে তাহা করিতে হইবে তদনুসারে তিনি ব্যবস্থাপত্র দিয়াছেন। প্রকৃতির কাছে সরলভাবে জিজ্ঞাসু না হইয়া এবং সংস্কারমুক্ত চিত্তে অভিজ্ঞতার শিক্ষা না লইয়া তাহার এই সকল ব্যবস্থা হইল অসার কল্পনা ও মনগড়া অনুমানপ্রসূত ব্যাধিসমূহকে প্রায় একইভাবে পুনরাবর্তিত অবস্থা বলিয়া হইত। তদনুযায়ী অধিকাংশ পদ্ধতিতেই তাদের কল্পনাগড়া ব্যাধিচিত্তের একটি করিয়া নাম দেওয়া হইত এবং প্রত্যেকটি পদ্ধতিকে বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগের মধ্যে ফেলা হইত। ঔষধসমূহের উপর এমন কতকগুলি ক্রিয়া আরোপ করা হইত যাহা সেই সকল অস্বাভাবিক অবস্থা দূর করিতে পারিবে বলিয়া মনে করা হইত। (তাহা হইতে মেটেরিয়া মেডিকা বিষয়ে এত বেশি পাঠ্য পুস্তকের উৎপত্তি) ।
#সূত্রঃ ৫৫। সময় সময় আশু ও ক্ষণস্থায়ী উপশম দান করতে পারার জন্যই এলোপ্যাথি আজও টিকিয়া আছে-
শীঘ্রই কিন্তু সাধারণের এই বিশ্বাস জন্মিলযে এই সকল প্রণালী ও পদ্ধতির প্রত্যেকটি যথাযথ প্রবর্তিত হওয়ার ফলে রোগীর যন্ত্রণা বাড়িয়া চরম সীমায় উঠে। হাতুড়েপদ্ধতি দ্বারা আবিষ্কৃত এই সকল ঔষধ দ্বারা কখন ও কখন ও সাময়িক উপশম যদি পাওয়া না যায়ত এবং তৎক্ষণাৎ তাহার আরামপ্রদ ক্রিয়া রোগীর অনুভবগম্য না হইত তাহা হইলে অনেক আগেই এই সকল এলোপ্যাথিক চিকিৎসককে বিদায় লইতে হইত। এই সকলের জন্যই কিয়ৎ পরিমাণে তাহাদের মান রক্ষা পাইয়াছে।
#সূত্রঃ ৫৬। বিপরীত বিধান পীড়ার আংশিক উপশম করে মাত্র-
সতেরো শতাব্দি ধরিয়া গেলেনেরপ্রবর্তিত সাময়িক উপশমদায়ক – বিপরীতকে বিপরীত দিয়া চিকিৎসা (অ্যান্টিপ্যাথি, এনান্টিওপ্যাথি) শিক্ষালাভ করার ফলে চিকিৎসকগণ আশু উপশম প্রদানের ছলে লোকের বিশ্বাসভাজন হইবার করিয়াছিলেন।কিন্তু মূলে এই পদ্ধতি কত সাহায্যে অক্ষম ও ক্ষতিজনক (চিররোগে) তাহা পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখিতে পাইব। এলোপ্যাথগণের অনুসৃত চিকিৎসা প্রণালীর মধ্যে ইহা নিশ্চয়ই একটি যাহার সহিতপ্রাকৃতিক রোগ লক্ষণের একাংশের সুস্পষ্ট আছে; কিন্তু কি জাতীয় সম্বন্ধ? বাস্তবিকই ঠিক সেইটি (ঠিকেরই যথার্থ বিপরীত) যেটিকে সতর্কতার সহিত পরিহার করে চলা উচিত- যদি আমরা চিররোগগ্রস্ত রোগীর সম্বন্ধে ছলনা বা তামাশা করিতে না চাই।
#সূত্রঃ ৫৭। অসমলক্ষণ চিকিৎসায় সমগ্রলক্ষণের মধ্যে একটিমাত্র কষ্টকর লক্ষণের চিকিৎসা চলে-
এই ধরনের অসমলক্ষণ প্রথায় চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করার জন্য সমগ্র রোগলক্ষণের মধ্যে সবচাইতে কষ্টকর লক্ষণটি লইয়া অন্যান্য লক্ষণগুলি অবজ্ঞা করা হয়। সাধারণ চিকিৎসক এই যন্ত্রণাদায়ক লক্ষণটি দূর করার জন্য, বিপরীত লক্ষণ মতে চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করেন এবং উক্ত ঔষধ রোগলক্ষণের বিপরীত অবস্থা উৎপাদন করেন বলিয়া তিনি অবগত আছেন। এইভাবে ঔষধ নির্বাচনের পর তিনি অতিসত্বর উপকারের আশা করেন। সব ধরনের যন্ত্রণার অবসানের জন্য তিনি অতি মাত্রায় আফিম প্রয়োগ করেন। কেননা আফিম সত্ত্বর অনুভব শক্তিকে বিনষ্ট করিয়া ফেলে। এই ঔষধটি সব রকমের তরল ভেদে ব্যবহার করা হয়। কারণ ইহা শীঘ্রই অন্ত্রনালীর মল সঞ্চালন গতি রোধ করে এবং উহার অবসাদ আনিয়া দেয়। অবসাদকর অচেতন নিদ্রা আনয়ন করে বলিয়া নিদ্রাহীনতার জন্যও এই ঔষধটি দেওয়া হয়। কারণ আফিম অতিশীঘ্র মস্তিষ্কের অবসাদসূচক অচৈতন্যাবস্থায়কর নিদ্রা উৎপাদন করে। এই পদ্ধতির চিকিৎসক কোষ্ঠকাঠিন্য হলে জোলাপ দেন হাত পুড়িয়া গেলে ঠাণ্ডা জলে রোগীর হাত ডুবাইয়া দেন। ইহাতে জলের শীতলতার জন্যই পোড়ার জ্বালা আশু নিবারিত হয়। রোগী যখন উত্তাপহীনতার জন্য শীতবোধ করে তখন তাকে গরম জলে স্নান করান যেন তাহার শরীর গরম হইয়া উঠে। দীর্ঘদিনের দুর্বলতার জন্য মদের ব্যবস্থা করেন, যাহাতে রোগী মুহূর্তের মধ্যে সবল ও প্রফুল্ল হয়ে উঠে। এইভাবে আরও অনেক গুলি বিপরীত ক্রিয়া সৃষ্টিকারী ঔষধ ব্যবহার করেন কিন্তু উক্ত ঔষধগুলি ছাড়া তাহার আর অল্পই জানা আছে। কারণ খুব অল্প সংখ্যক ঔষধেরই বিশেষ ক্রিয়া (প্রাথমিক) সাধারণ তন্ত্রে জানা আছে।
#সূত্রঃ ৫৮। এলোপ্যাথিক বা অসমলক্ষণ চিকিৎসার ত্রুটি-
এই প্রকার পদ্ধতিতে চিকিৎসার মূল্য নিরূপণ করিতে যাইয়া ইহা যে একটি অত্যন্তযুক্ত লাক্ষনিক পদ্ধতি-যাহাতে চিকিৎসক সমগ্র লক্ষণের মধ্যে কেবলমাত্র একটি লক্ষণ এর দিকেই ঝোঁক দেন এবং সেজন্য রোগীর প্রার্থিত সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের আশা পূর্ণ হয় না-সে বিষয়ে ছাড়িয়া দিলেও অপরপক্ষে আমাদের অভিজ্ঞতা ইহাই কি আমাদিগকে জানাই না যে এন্টি প্যাথিক পদ্ধতিতে চিররোগে ঔষধ প্রয়োগ দ্বারা প্রথমে সাময়িক উপশমের পরে আবার সমগ্র পীড়ার বৃদ্ধি ঘটিয়া থাকে? প্রত্যেক মনোযোগী দ্রষ্টাই স্বীকার করিবেন যে অ্যান্টিপ্যাথিক সাময়িক উপশমের পর প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আসিয়াছে বৃদ্ধি, যদিও সাধারণ চিকিৎসক সেই পরবর্তী বৃদ্ধির কারণ রোগীকে অন্যভাবে বুঝাইয়া দেন এবং বলেন যে এই বৃদ্ধির প্রাথমিক রোগের মারাত্মক অবস্থার একটা প্রথম প্রকাশ অথবা অন্য কোন নুতন পীড়া ।
#সূত্রঃ ৫৯। অসমলক্ষণ মতে চিকিৎসায় উপশমিত লক্ষণের পুনঃ আবির্ভাবের দৃষ্টান্ত-
এই প্রকার সাময়িক উপশমদায়ক বিরুদ্ধধর্মী ঔষধ দ্বারা চিকিৎসায় স্থায়ী রোগের লক্ষণসমূহের কয়েক ঘণ্টা পরেই পুনরাবির্ভাব, তখন বিড়াল স্পষ্ট বিদ্রূপ বিপরীত অবস্থা আসা ছাড়া আর কিছুই হয় না। দিনের বেলায় অনবরত নিদ্রালুতার জন্য চিকিৎসক কফির ব্যবস্থা করেন। ইহার প্রাথমিক ক্রিয়া হইল সতেজতা আনায়ন করে। ইহার ক্রিয়া শেষ হইয়া গেলে দিবানিদ্রালুতা আবার বাড়িয়া যায়। রোগের অন্যান্য লক্ষণের দিকে দৃষ্টি না দিয়া রাত্রের অনিদ্রার জন্য সন্ধ্যার সময় আফিম ব্যবস্থা করা হয়। তাহার প্রাথমিক ক্রিয়ায় সেইরাত্রে একটা আচ্ছন্নভাব আসলেও পরবর্তী রাত্রিগুলিতে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর জাগরনে কাটাইতে হয়। অন্যান্য রোগলক্ষণের দিকে মনোযোগ না দিয়া পুরাতনয উদারাময়কে বন্ধ করিবার জন্য সেই আফিম আবার দেওয়া হয়। তাহার প্রাথমিক ক্রিয়ার ফল হইল কোষ্ঠবদ্ধতা,উদারাময় সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার পরে তাহা আবার খারাপ ভাবে দেখা দেয়। বিভিন্ন প্রকারের প্রচণ্ড যন্ত্রণার পুনঃপুনয়আক্রমণে আফিম দিয়া অল্প সময়ের জন্য তাহা দমন করা হইল অধিকতরভাবে, কখন ও অসহনীয়তীব্রতায় তাহা ফিরিয়া আসে কিংবা তাহা অপেক্ষা আরও খারাপ ব্যাধি তাহার স্থানে আসিয়া জোটে। দীর্ঘস্থায়ী রাত্রিকালীন কাশির জন্য সাধারণ চিকিৎসাক আফিম ছাড়া আর কিছুরই ব্যবস্থা জানেন না। আফিমের প্রাথমিক ক্রিয়ায় হইলো সকল প্রকার উত্তেজনাকে দমন করা, সেজন্য প্রথম রাত্রে কাশি হয়তো বন্ধ থাকে, কিন্তু পরবর্তী রাত্রিসমূহে তাহা আর ও প্রচন্ডভাবে দেখা দেয়। আরও অধিকতর মাত্রায় ব্যবহার করিয়া যদি পুনঃপুন তাহা দমন করা হয় তাহা হইলে জ্বর ও নিশার্ঘম আসিয়া তাহার সহিত যুক্ত হয়। মূত্রাশয়ের দুর্বলতা ও তৎসহ মুত্রাবরোধের প্রতিকারের জন্য এন্টিপ্যাথিক পদ্ধতিতে ক্যান্হারাইডিসপ্রয়োগ করিয়া মূত্রনালী সমূহকে উদ্দীপনা দিবার চেষ্টা করা হয়। তাহার ফলে প্রথমে মূত্রের নিঃসরণ ঘটিলেও পরে মূত্রাশয়কে আর ক্রিয়াশীল করিবার জন্য সম্ভাবনা থাকে না, সেই জন্য তাহার সংকোচন মন্দীভূত হওয়ার পক্ষাঘাত আসন্ন হইয়া পড়ে। বৃহৎ মাত্রায় জোলাপ দিয়া পুনঃপুন মলত্যাগের উত্তেজনা সৃষ্টি করিয়া পুরাতন কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করিবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাহার গৌণ ক্রিয়ার ফলে কোষ্ঠবদ্ধতা আরো বাড়িয়া যায়। সাধারণ চিকিৎসক বহুদিনের স্থায়ী দুর্বলতাকে দূর করিবার জন্য মদ্য ব্যবস্থা করিয়া থাকেন। প্রাথমিক ক্রিয়ায় তাহা সলতা আনিলেও প্রতিক্রিয়া অধিকতর অবসন্নতা লইয়া আসে। তিক্ত ভেষজ ও গরম মসলা দ্বারা পাকস্থলীর বহুদিনের স্থায়ী নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্বলতাকে সতেজ ও করিবার চেষ্টা করা হয়,কিন্তু এই প্রাথমিক উপশমের প্রতিক্রিয়ায় পাকস্থলী আর ও নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়ে। বহুদিন স্থায়ী দৈহিক উত্তাপ এর অভাব এবং উষ্ণস্নানে উপশম হয়, কিন্তু পরে রোগী অধিকতর দুর্বল, শীতল ও শীতকাতর হইয়া পড়ে। গুরুতরভাবে দুগ্ধ স্থানে শীতল জল প্রয়োগ করিলে সঙ্গে সঙ্গে উপশম বোধ হয় বটে কিন্তু দুগ্ধযন্ত্রণাপরে অবিশ্বাস্য রূপে বাড়িয়া যায় এবং প্রদাহ আরও অধিকস্থান লইয়া বিস্তৃত হয়। যে সকল ঔষধে হাঁচি জন্মাইয়া সর্দি নিঃসরণ করে সেই পোকার ঔষধ প্রয়োগে বহুদিনের স্থায়ী সর্দিতে নাক বন্ধ থাকা অবস্থা দূর করিবার ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু এই সকল বিরোধের প্রতিক্রিয়ায় অসুখ যে আরও বাড়িয়া যায় তাহা নজরে আসে না, নাক আরও বেশি বন্ধ হইয়া যায়। তড়িৎশক্তির প্রাথমিক ক্রিয়া হইল পেশীসমূহকে উদ্দীপিত করা। এই শক্তির ক্রিয়ায় বহুদিনের দুর্বল, প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গকে অতি দ্রুত ক্রিয়াশীল করা হয়, কিন্তু তাহার গৌণ ফল হইল পেশী সমূহের সকল উত্তেজনার স্তব্ধতা ও সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত। শিরা কাটিয়া মস্তকের স্থায়ী রক্ত সঞ্চয় দূর করিবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাহার ফলে রক্ত সঞ্চয় আর ও বেশী হইয়া থাকে। বিভিন্ন প্রকারের টাইফয়েডরোগে দেহযন্ত্র ও মনের যে অসাড়তা ও সেই সঙ্গে অচৈতন্য অবস্থা দেখা যায় তাহার চিকিৎসার জন্য সাধারণ চিকিৎসকগণের অধিকমাত্রায় ভ্যালেরিয়ান প্রয়োগ ছাড়া বিশেষ আর কিছু জানা নাই। কারণ সতেজতা প্রদান করিতে ও স্নায়ুতন্ত্রের গতিশীলতা বৃদ্ধি করে যে সকল ওষুধের ক্ষমতা সার্বাধিক ইহা তাদের অন্যতম। অজ্ঞানতাবশত তাহারা জানেন না যে এই ক্রিয়া প্রাথমিক মাত্র এবং তাহা অন্তর্নিহিত হইলে দেহযন্ত্র সুনিশ্চিতভাবে বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া কবলে পড়ে ও অধিকতর চেতনা হীনতা ও অসারতা আশিয়া দেখা দেয় অর্থাৎ ফলে হয় মানসিক ও দৈহিক পক্ষাঘাত, মৃত্যু। তাহারা লক্ষ্য করেন নাই যে, যেসকল রোগে বিপরীত ক্রিয়াশীল ভ্যালেরিয়ান প্রচুর পরিমাণে দিয়াছেন সেগুলির সুনিশ্চিত পরিমাণ হইয়াছে মৃত্যু। পুরাতনপন্থী চিকিৎসকগণ এই মনে করিয়া আনন্দ বোধ করেন যে, রক্তাভ ফক্সগ্লভের প্রথম মাত্রা প্রয়োগ করিয়াই (যাহার প্রাথমিক ক্রিয়া হইল নাড়ির গতিকে মন্দীভূত করা) রক্তহীন নাড়ীর গতিবেগকে কয়েক ঘণ্টার জন্য মন্হর করিয়া দিতে পারেন। কিন্তু ইহার বেগ আবার শীঘ্র ফিরিয়া আসে। পুনঃপুন মাত্রা বাড়াইয়া ক্রমশ অল্প অল্প বেগ কমতে কমতে শেষে আর উপকার হয় না। বস্তুত প্রতিক্রিয়ায় নাড়ির গতি এত দ্রুত হয় যে গনিয়া উঠিতে পারা যায় না; নিদ্রা, ক্ষুধা, বল চলিয়া যায়, অতি দ্রুত অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ঘনাইয়া আসে, আর নয়তো উন্মাদরোগ দেখা যায়। এক কথায়, এই প্রকার বিরুদ্ধ চিকিৎসার (অ্যান্টিপ্যাথিক) প্রতিক্রিয়ার ফলে কতবার ব্যাধির বৃদ্ধি হয় এবং খারাপ অবস্থা ঘটে মিথ্যা কল্পনাময় পুরাতনপন্থী চিকিৎসায় তাহার অনুভব হয় না, কিন্তু অভিজ্ঞতা ইহা ভয়ঙ্করভাবে শিখাইয়া দেয়।
#সূত্রঃ ৬০। বিসদৃশ অসমলক্ষণযুক্ত ঔষধের ক্রমাগত মাত্রা বৃদ্ধির কুফল-
এই সকল কুফল (যাহা স্বভাবতই অ্যান্টিপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগে উৎপন্ন হয়) উপস্থিত হইলে সাধারণ চিকিৎসক মনে করেন যে,প্রতিবার বৃদ্ধির সময় ঔষুধের আরো একটু চড়া মাত্রা দিলে সেই অসুবিধা অতিক্রম করা যাইবে। তদ্দ্বারা সমানভাবেই রোগকে কিছুকাল চাপা দিয়ে রাখা হয়। কিন্তু ক্রমশই ঔষধের মাত্রা আরও বাড়াইয়া উপশম দিবার প্রয়োজন হয়। তাহার ফলে আর একটি অধিকতর কঠিন রোগের সূত্রপাত হয় কিংবা রোগ প্রায়ই আরোগ্যের বাহিরে চলিয়া যায়, জীবনের আশঙ্কা আসে, এমনকি মৃত্যু ঘটে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী রোগকে তদ্দ্বারা কখনও আরোগ্য হইতে দেখা যায় না।
#সূত্রঃ ৬১। নির্মূলভাবে রোগ আরোগ্যের জন্য বিসদৃশ ঔষধ প্রয়োগের পরিবর্তে তদবিপরীত সদৃশ ঔষধ প্রয়োগ করা উচিত-
বিপরীত পদ্ধতিতে ঔষধ প্রয়োগ করিলে যে বিষাদময় ফল হয় সে সম্বন্ধে চিকিৎসকগণের যদি চিন্তা করিয়া দেখিবার ক্ষমতা থাকিত তাহা হইলে তাহারা এই মহান সত্য বহুকাল পূর্বেই আবিষ্কার করিতে পারিতেন যে প্রকৃত আরোগ্য করা অ্যান্টিপ্যাথিক চিকিৎসার ঠিক বিপরীত পদ্ধতিতেই (অর্থাৎ সদৃশ পদ্ধতিতেই) পাওয়া সম্ভব। তাহারা নিঃসন্দেহ হইতে পারিতেন যে রোগলক্ষণের বিপরীত পদ্ধতিতে ঔষধ প্রয়োগের ফলে আসে ক্ষণিকের উপশম এবং তাহা কাটিয়া গেলে দেখা যায় রোগের অবশ্যম্ভাবী বৃদ্ধি এবং তাহার উল্টা পদ্ধতিতে অর্থাৎ হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে লক্ষণের সাদৃশ্য ঢাকায় স্থায়ীভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে রোগ মুক্তি সম্ভব, অবশ্য যদি অ্যান্টিপ্যাথিক স্থূল মাত্রার পরিবর্তে সূক্ষ্মমাত্রার সেই সঙ্গে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু আন্টিপ্যাথিক চিকিৎসার ফলে ঘটে স্পষ্টভাবে রোগের বৃদ্ধি, ব্যবস্থাপত্রে দৈবক্রমে হোমিওপ্যাথিক সম্বন্ধবিশিষ্ট কোন ঔষধ মুখ্যত উপস্থিত না থাকিলে চিকিৎসকের পক্ষে কখনো কোন দীর্ঘস্থায়ী রোগ সম্পূর্ণ আরোগ্য করা সম্ভবপর নহে, অথবা প্রাকৃত জগতে এই যাবত যেসকল আরোগ্যলাভ দ্রুত ও সম্পূর্ণরূপে ঘটিয়াছে তাহা যে সর্বদা পুরাতন ব্যাধির উপর আরেকটি সদৃশ রোগ উৎপন্ন করিয়া, এই সকল তথ্য হইতে এই দীর্ঘ শতাব্দী ধরিয়াও তাঁহারা সেই সত্য উপলব্ধি করিতে পারেন নাই তাহা জানা থাকিলে প্রকৃতই রোগীর কল্যাণসাধন সম্ভব।
#৬২। বিসদৃশ বিধান ক্ষতিকর কিন্তু সদৃশ বিধান উপকারী-
ক্ষণিক উপশমকারী এন্টিপ্যাথিক চিকিৎসার অনিষ্টকর ফল এবং তাহার বিপরীত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় সুফল কিসের উপর নির্ভর করে তাহা নিম্নলিখিত– গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে এবং সেই সকল স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলেও আরোগ্য বিধানের জন্য তাকে অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নাই।—-ইউরোপ ও অন্যান্য স্থানের চিকিৎসকগণ সকল রোগের জন্য এই সুবিধাজনক চিকিৎসা পদ্ধতিকে গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তাহার মুখ্য কারণ হইলো ইহাতে বড় একটা ভাবনা চিন্তার দরকার হয়না। (যাহা পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা কঠিন কাজ) । বিবেকের দংশন হইতে মুক্তি ও নিজেদেরসান্তনার জন্য এইটুকু শুধু অবহিত হওয়া প্রয়োজন মনে করিতেন যে তাহারা নিজে এই চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কর্তা নহেন এবং সহস্র সহস্র ব্রুসোপন্হী সেই একই পদ্ধতিতে চলেছেন, আর তাহাদের গুরুর শিক্ষা হইল এই যে, যেভাবেই হোক মৃত্যুর পর সব স্তব্ধ হইয়া যায়। এইরূপে বহু সহস্র চিকিৎসক শোচনীয়ভাবে তাহাদের রোগীদের উষ্ণ রক্ত নির্মমভাবে মোক্ষণ করিবার ভ্রান্ত পথে পরিচালিত হইয়াছেন। লক্ষ লক্ষ রোগী, যাহাদিগকে আরোগ্য দান করা সম্ভবপর হইতে ব্রুসোর পন্থা অনুসরণ করিয়া ক্রমশ তাহাদের প্রাণ হরণ করা হইয়াছে। তাহাদের সংখ্যা নেপোলিয়নের যুদ্ধক্ষেত্রে যত লোক নিহত হইয়াছে তাহা অপেক্ষা বেশি। যে চিকিৎসা দ্বারা চিকিৎসাযোগ্য সকল রোগী সর্বাপেক্ষা কঠিন চিকিৎসা কলাকৌশল এবং অক্লান্ত কর্মী, বিশ্লেষণদক্ষ চিকিৎসকের বিশুদ্ধ বিচার বুদ্ধির সাহায্যে লইয়া স্বাস্থ্য এবং নবজীবন লাভ করিতে পারে, সেই একমাত্র প্রকৃত বিজ্ঞান ও কলা সম্মত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পৃথিবীর সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে, সেই জন্যই কি ভগবৎ বিধান অনুসারে আরোগ্য দানযোগ্য রোগীগণের মৃত্যু আনয়নকারী ব্রুসোরচিকিৎসা পদ্ধতির হোমিওপ্যাথির পূর্ববর্তী হওয়া প্রয়োজন ছিল?
(১২) ঔষধের মূখ্য ও গৌণক্রিয়া (সূত্র-৬৩-৭০)
#সূত্রঃ ৬৩। ঔষধের মুখ্য ও গৌণ ক্রিয়া-
জীবনে শক্তির উপর ক্রিয়াশীল প্রত্যেকটি বস্তু,প্রত্যেকটি ওষুধ জীবনী শক্তিকে অল্পাধিক বিপর্যস্ত করে এবং তার ফলে দীর্ঘকাল কিংবা স্বল্প সময়ের জন্য ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের কিছু পরিবর্তন ঘটায়। ইহাকে মুখ্য ক্রিয়া বলা হয়। যদিও ইহা ঔষধ ও জীবনীশক্তির ক্রিয়ার সম্মিলিত ফল তথাপি ইহার প্রধান হেতু হইল ঔষধ শক্তি। এই ক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের জীবনীশক্তি তাহার নিজস্ব ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার চেষ্টা করে। এই যে প্রতিরোধ ক্রিয়া তাহা বস্তুত আমাদের আত্মরক্ষা শক্তিরই স্বধর্ম ও তাহা স্বয়ংক্রিয় এবং তাকে বলা হয় গৌন ক্রিয়া বা প্রতিকূল ক্রিয়া ।
#সূত্রঃ ৬৪। আরোগ্যসাধন প্রক্রিয়া-
আমাদের সুস্থ শরীরের উপর কৃত্রিম রোগ উৎপাদক বস্তুসমূহের অর্থাৎ ওষুধেরমুখ্য ক্রিয়া প্রকাশকালে নিম্নলিখিত পন্হানুসার আমাদের জীবনীশক্তিকেএরূপভাবে আচরণ করতে দেখা যায় যেন তাহা কৃত্তিম বহিঃশত্রুর আক্রমণ নিশ্চেষ্টভাবে আগে নিজের উপর গ্রহণ করিয়া নিজের স্বার্থকে প্রবর্তিত হইতে দিতে বাধ্য হইতেছে। তাহার পর যেন পুনরায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ নিজের সাধ্যানুযায়ী ও কৃত্তিম ঔষধ জনিত মুখ্য ক্রিয়ার সমপরিমানে (ক) মুখ্য ও ক্রিয়ার ঠিক বিপরীত স্বাস্থ্যের অবস্থা আনয়ন করে (প্রতিকূল ক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া)—যদি বিপরীত অবস্থা বলিয়া কিছু থাকে, (খ) কিংবা, মুখ্য ক্রিয়ার কোন বিপরীতপ্রাকৃতিক অবস্থা যদি না থাকে তাহা হইলে নিজেকে স্বতন্ত্র করিয়া লইবার চেষ্টা করে অর্থাৎ স্বীয় বলবত্তর শক্তি প্রয়োগ করিয়া ঔষধ জনিত পরিবর্তনকে বিদূরিত করিয়া তাহার স্থানে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃস্থাপিত করে ( গৌন ক্রিয়া, আরোগ্যবিধায়িনী ক্রিয়া।)
#সূত্রঃ ৬৫। মুখ্য ও গৌণ ক্রিয়ার উদাহরণ-
ক) অংশের সিদ্ধান্ত সমূহ সকলের পরিচিত। গরম জলে ডুবানো হাতটি অন্য হাতটি অপেক্ষা প্রথমে বেশি গরম বলিয়া বোধ হয়( মুখ্য ক্রিয়া), কিন্তু তাহা গরম জল হইতে উঠাইয়া ভালো করিয়া শুকাইয়া লইলে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাহা ঠান্ডা এবং পরে অন্য হাত অপেক্ষা অধিকতর ঠান্ডা বলিয়া অনুভূত হয় (গৌণক্রিয়া)। অতিরিক্ত পরিশ্রমের পরে দেহে গরম বোধ হয় (মুখ্য ক্রিয়া), কিন্তু পরে ঠান্ডা বোধ হয় ও কাঁপুনি লাগে (যৌনক্রিয়া)। যে লোক গতকাল অত্যধিক মদ খাইয়া উষ্ণ করিয়াছিল (মুখ্য ক্রিয়া) আজ তাহার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যারপরনাই ঠান্ডা বলিয়া বোধ হইতেছে (প্রতিক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া)। যে বাহুকে অনেকক্ষণ ধরিয়া খুব শীতল জলে ডুবাইয়া রাখা হইয়াছেতাহা প্রথমে অধিকতর ফ্যাকাসে ও শীতল বলিয়া বোধ হয় (মুখ্য ক্রিয়া) কিন্তু ঠান্ডা জল হইতে সরাইয়া লইয়া জল মুছে ফেলিলে তাহা পরে অন্য বাহু অপেক্ষা অধিকতর উষ্ণই শুধু হয় না বরং উত্তপ্ত, লাল ও প্রদাহান্বিত হইয়া উঠে (গৌণ ক্রিয়া, জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়া) । কড়া কফি পান করিলে অত্যাধিক স্ফুর্তি আসে (মুখ্য ক্রিয়া), কিন্তু পরে আলস্য ও তন্দ্রালুতা অনেকক্ষণ ধরিয়া বিদ্যমান থাকে (প্রতিক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া) যদি না আবার নতুন করিয়া কফি পান করিয়া তাহা (ক্ষণিকের জন্য) তারাইয়া দেওয়া হয় (উপশমকারী) । আফিম সেবনজনিত জড়বৎ অঘোর নিদ্রার (মুখ্য ক্রিয়া) পরে পরবর্তী রাত্রে আসে অধিকতর নিদ্রাহীনতা (প্রতিক্রিয়া, গৌণ ক্রিয়া) । আফিম সেবনজনিত কোষ্ঠবদ্ধতা পরে (মুখ্য বা প্রাথমিক ক্রিয়া) উদারাময় আসে (গৌণ ক্রিয়া), আর অন্ত্রের উত্তেজনাজনক জোলাপ দিয়া কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করিয়া পরে (মুখ্য বা প্রাথমিক ক্রিয়া) কয়েকদিনব্যাপী কোষ্ঠবদ্ধতা শুরু হয় (গৌণ ক্রিয়া )। এইরূপ সব সময়ই ঘটে, সুস্থ দেহে অধিক মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগের ফলে স্বাস্থ্যে গুরুতর পরিবর্তন আসার পরে যদি তাহার ঠিক বিপরীত অবস্থা থাকে, যেরূপ আলোচিত হইয়াছে, তাহা জীবনীশক্তি কর্তৃক গৌন ক্রিয়ার ভিতর দিয়ে প্রতিফলিত হয়।
#সূত্রঃ ৬৬। হোমিও ঔষধে স্বাস্থ্যের পরিপন্থী কোন ক্রিয়া সৃষ্টি হয় না-
সুস্থ দেহের উপর বিশৃঙ্খলা উৎপাদনকারী কোন ঔষধের অতি ক্ষুদ্র হোমিওপ্যাথিক মাত্রায় ক্রিয়ার একটি বিপরীত প্রতিক্রিয়া খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হইবে বলিয়া ধারণা হতে পারে, কিন্তু তাহা হয় না। প্রত্যেকটি ঔষধের ক্ষুদ্রমাত্রা নিশ্চিতভাবে যে প্রাথমিক ক্রিয়া উৎপাদন করে তাহা খুব মনোযোগী পর্যবেক্ষকের কাছে ধরা পড়ে বটে কিন্তু জীবন্তদেহ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরানয়নের জন্য যতটুকু প্রতিক্রিয়া (গৌণ ক্রিয়া) প্রয়োজন ততটুকুই মাত্র প্রয়োগ করিয়া থাকে।
#সূত্রঃ ৬৭। হোমিও চিকিৎসার কল্যাণকর দিক ও বিসদৃশ চিকিৎসার অকল্যাণকর দিক-
এই অখন্ডনীয় সত্যসমূহ—যাহা প্রকৃত জগতে ও অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে স্বতই আমাদের চোখে পড়ে—-একদিকে যেমন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উপকারিতা আমাদের নিকট প্রমাণ করেছে, তেমনি অপরদিকে বিরুদ্ধ ক্রিয়াশীল ঔষধ প্রয়োগে অ্যান্টিপ্যাথিক ও উপশমকারী চিকিৎসার ফল ঘোষণা করিতেছে ।
#সূত্রঃ ৬৮। রোগারোগ্যের জন্য হোমিওপ্যাথিক ঔষধের স্বল্পমাত্রায় যথেষ্ট-
হোমিওপ্যাথিক আরোগ্য বিধানে অভিজ্ঞতা আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে, লক্ষণের সাদৃশ্যহেতু জীবনীশক্তির ক্ষেত্র হইতে সদৃশ প্রাকৃতিক ব্যাধিকে পরাভূত ও দূরীভূত করিতে এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ওষুধের অসাধারণ ক্ষুদ্র মাত্রায় যথেষ্ট। ব্যাধি বিনষ্ট হওয়ার পরে দেহের ভিতরে প্রথমে ঔষধজনিত পীড়া কিছু পরিমাণে অবশিষ্ট থাকে বটে কিন্তু ওষুধের অত্যন্ত স্বল্প মাত্রা প্রয়োগহেতু সেই পীড়া এত ক্ষণস্থায়ী, এত তুচ্ছ এবং তাহা আপনি এত শীঘ্র মিলাইয়া যায় যে স্বাস্থ্য পুনরানয়নের জন্য যতটুকু যথেষ্ট তাহার বেশি প্রতিক্রিয়া এই নগন্য কৃত্রিম পীড়ার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করিবার প্রয়োজন হয় না অর্থাৎ সেটুকু প্রতিক্রিয়া যেটুকু সম্পূর্ণ আরোগ্যবিধানের পক্ষে যথেষ্ট, এবং পূর্বেকার ব্যাধি দূরীভূত হওয়ার পরে তাহা অল্পই প্রয়োজন হয় ।
#সূত্রঃ ৬৯। বিসদৃশ ঔষধের কর্মকৌশল ও অপকারিতা-
অ্যান্টিপ্যাথিক (ক্ষণিক উপশমদায়ী) চিকিৎসাপদ্ধতিতে কিন্তু ঠিক ইহার বিপরীত ঘটে। চিকিৎসক কর্তৃক রোগলক্ষণের বিরুদ্ধে ঔষধলক্ষণের প্রয়োগকে (যেমন তীব্র বেদনায় আফিমের মুখ্য ক্রিয়ার ফলে অসাড়তা ও বোধশক্তিহীনতা) একেবারে সম্বন্ধবিহীন কিংবা সম্পূর্ণ বিভিন্ন জাতীয় সম্বন্ধেবিশিষ্ট বলা যায় না । রোগলক্ষণের সহিত ঔষধ লক্ষণ স্পষ্টই একটা সম্বন্ধ সূত্রে আবদ্ধ, কিন্তু যাহা হওয়া উচিত ইহা তাঁহার বিপরীত । এই প্রণালীতে ইহাই অভিপ্রেত যে ঔষুধের বিপরীত লক্ষণদ্বারা রোগলক্ষণ বিনষ্ট হইবে, কিন্তু তাহা কখনই সম্ভবপর নহে । তবে ইহা নিঃসন্দেহে যে, সদৃশ ব্যাধি সৃষ্টি করে বলিয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগের যে স্থানে গিয়ে লাগে, বিপরীত পদ্ধতি মতে নির্বাচিত ঔষধ ও ঠিক সেই স্থানে গিয়ে স্পর্শ করে। কিন্তু শেষোক্ত পদ্ধতিতে ঔষধ লক্ষণ হালকাভাবে রোগের বিপরীত লক্ষণের নিকট পৌঁছিয়া তাহাকে জীবনীশক্তির অনুভূতির ক্ষেত্র হইতে কেবল কিছুক্ষণের জন্য সরাইয়া দেয়। সেজন্য বিপরীতধর্মী উপশমদায়ক ঔষুধের ক্রিয়ার প্রথম ভাগে জীবনীশক্তি ঔষধ কিংবা পীড়া এই উভয়ের কোনটির দরুন অস্বস্তিবোধ করে না, মনে হয় যেন তারা পরস্পরকে সূক্ষ্মভাবে প্রশমিত করিয়া ফেলিয়াছে (যেমন, যন্ত্রণার ক্ষেত্রে অসাড়তা উৎপাদক আফিমের ক্রিয়া)। প্রথম কয়েক মুহূর্ত জীবনীশক্তি বেশ সুস্থ অনুভব করে, আফিমের অবসাদ কিংবা ব্যাধির যন্ত্রণা কিছুই অনুভব করে না।
কিন্তু বিপরীতধর্মী ঔষধের লক্ষণ (হোমিওপ্যাথির মতে ) জীবনীশক্তির অনুভূতির দিক দিয়া সদৃশ অথচ বলবত্তর কৃত্রিম ব্যাধির মতো দেহের পীড়িত স্থানটিকে অধিকার করিতে পারে না এবং সেইজন্য হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মত সদৃশ কৃত্রিম ব্যাধি সৃষ্টি করিয়া জীবনীশক্তিকে এরূপভাবে আক্রমণ করতে পারে না যাহাতে তাহা ঠিক প্রাকৃতিক ব্যাধির স্থানটিতে গিয়া প্রবেশলাভ করিতে পারে। ক্ষণিক উপশমদায়ী ঔষধ ব্যাধি হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং তাহার বিপরীত বলিয়া ব্যাধিকে নির্মূল করিতে অক্ষম। যেমন পূর্বে বলা হইয়াছে সূক্ষ্মভাবে পরস্পরের প্রশমন ঘটিয়াছে এইরূপ প্রতীয়মান হওয়ায় প্রথমে জীবনীশক্তি কিছুই অনুভব করিতে পারেনা, কিন্তু প্রত্যেকটি ঔষধিজাত ব্যাধির মতো ইহাও ( এন্টিপ্যাথিক ঔষধ ) আপনাআপনি অন্তর্হিত হইয়া গেলে পড়িয়া থাকে শুধু ব্যাধি- যেমন পূর্বে ছিল। শুধু তাহাই নহে, ও ঔষধ ( যেমন অন্যান্য উপশম দায়ী ঔষধ রোগ সারাবার জন্য বৃহৎ মাত্রায় দেওয়া হয়) তাহার বিপরীত অবস্থা আনয়নের জন্য ( ৬৩,৬৪ সূত্র) জীবনীশক্তিকে বাধ্য করে অর্থাৎ সেই অবস্থা ঔষুধের ক্রিয়ার বিপরীত এবং সেইজন্য তাহা তখনও বিদ্যমান অবিনষ্ট প্রাকৃতিক পীড়ার অনুরূপ। জীবনীশক্তির প্রতিক্রিয়ার ফলে শেষোক্ত পীড়ার সহিত তাহা যুক্ত হইয়া স্বভাবতই পীড়াকে আরো বাড়াইয়া শক্তিশালী করিয়া তোলে। ক্ষণিক উপশমের কাল কাটিয়া গেলে রোগলক্ষণটি ( ব্যাধির একটি অংশ মাত্র) আনুষঙ্গিকভাবে আরো বাড়িয়া যায় এবং এই বৃদ্ধি উপশমদায়ী ঔষধের মাত্রার পরিমাণের অনুপাতে হয়। অতএব (পূর্বোক্ত দৃষ্টান্ত অনুসারে ) যন্ত্রণার উপশমের জন্য আফিমের মাত্রা যত বাড়ান হইবে আফিমের ক্রিয়া চলিয়া গেলেই সেই পরিমাণে পূর্বের যন্ত্রণাকে অতিক্রম করিয়া যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইবে।
#সূত্রঃ ৭০। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সারমর্ম-
পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহা হইতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে পারি যে, রোগ বলিতে চিকিৎসক যাহা কিছু বুঝেন এবং সেজন্য আরোগ্যবিধান প্রয়োজন তাহা রোগীর যন্ত্রণা এবং তাহার স্বাস্থ্যের বোধগম্য পরিবর্তনের মাধ্যমে, এককথায় লক্ষণসমষ্টির ভিতর দিয়া প্রকাশিত হয়। এই লক্ষণসমষ্টির দ্বারা রোগী রোগমুক্তির জন্য উপযুক্ত ঔষধের দাবি জানায়। অপরপক্ষে ইহাকে নির্দেশ করিয়া যাহা কিছু আভ্যন্তরীণ কারণ আরোপ করা হয়, যাহা কিছু রোগ উৎপাদনকারী দুর্জ্ঞেয় বস্তুর কল্পনা করা হয় তাহা অলীক স্বপ্ন ভিন্ন কিছুই নহে। এই যে দৈহিক অসুস্থতা যাহাকে আমরা ব্যাধি বলি ওষুধ প্রয়োগ দ্বারা তাহাকে কেবল আরেকটি আবর্তন এর ভিতর দিয়া স্বাস্থ্যে ফিরাইয়া আনা সম্ভব। সেই ওষুধের আরোগ্যদায়িনী শক্তি শুধু নির্ভর করে মানুষের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন সাধন অর্থাৎ রোগলক্ষণ উৎপাদন করিবার বিশিষ্ট ক্ষমতার উপর এবং তাহা খুব স্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাবে জানা যায় ঔষধসমূহের সুস্থ শরীরে পরীক্ষা করিয়া। সকল অভিজ্ঞতা ইহাই শিক্ষা দেয় যে কোন প্রাকৃতিক ব্যাধি কখনোই সেই ওষুধ দ্বারা নিরাময় হয় না, যাহা সুস্থ শরীরে পরীক্ষায় যে রোগ সারাতে হইবে তাহা হইতে ভিন্ন একটা বিসদৃশ রোগ উৎপন্ন করে (অতএব এলোপ্যাথি মতে কখনোই নহে )। এমনকি প্রাকৃত জগতেও এরূপ আরোগ্যবিধান কখনই দেখা যায় না যাহাতে কোন আভ্যন্তরীণ ব্যাধি অন্য একটি বিসদৃশ রোগ সংযোগে- তাহা যতই হোক না- দূরীভূত, বিনষ্ট এবং আরোগ্যপ্রাপ্ত হয়। বরং সকল অভিজ্ঞতা হইতে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সুস্থ দেহের উপর পরীক্ষার ফলে ঔষধের যেসকল লক্ষণ পাওয়া যায় তাহা রোগের বিপরীত একটিকেই উদ্দেশ্য করিয়া প্রয়োগ করা হলে দীর্ঘস্থায়ী রোগকে কখনো দূরীভূত করা যায় না। তাহাতে কেবল সাময়িক উপশম হয় মাত্র, কিন্তু পরে আবার রোগের বৃদ্ধি ঘটে। এক কথায় বলা যায়, এই প্রকার সাময়িক উপশমদায়ী এনটিবেটিক চিকিৎসা দীর্ঘস্থায়ী গুরুতর রোগের আরোগ্য বিধানে একেবারেই নিষ্ফল।
অতএব, তৃতীয় এবং কেবলমাত্র অন্যতম সম্ভাব্য চিকিৎসাপদ্ধতিকে (হোমিওপ্যাথিক)– যাহাতে কোন প্রাকৃতিক ব্যাধির লক্ষণসমষ্টিকে উদ্দেশ্য করিয়া সুস্থ দেহের উপর অনুরূপ লক্ষণ উৎপাদনকারী ঔষধ উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়- বলা যায় একমাত্র ফলদায়ক আরোগ্যপন্থা। তাহার দ্বারা জীবনীশক্তির পীড়াদায়ক সূক্ষ্ম শক্তিবিশিষ্ট ব্যাধিসমূহ সম্পূর্ণরূপে ও স্থায়ীভাবে নিঃশেষিত ও তিরোহিত হইয়া যায়। বলবত্তর সদৃশলক্ষণবিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক ওষুধই জীবনীশক্তির অনুভূতি ক্ষেত্রে এইরূপ ক্রিয়া আনয়ন করিতে সমর্থ। মুক্ত প্রকৃতির নিকট হইতে আমরা এই পদ্ধতির উদাহরণ পাইতে পারি যেমন, যখন একটি পুরাতন ব্যাধির সহিত একটি নতুন সদৃশ ব্যাধির সংযোগ ঘটে তখন নতুন ব্যাধিটি দ্রুত এবং চিরকালের জন্য বিনষ্ট হইয়া আরোগ্য প্রদান করেন।
(১৩) রোগ সমীক্ষা (সূত্র-৭১-৮২)
#সূত্রঃ ৭১। আরোগ্যের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি বিষয়-
এ বিষয়ে যখন কোন সন্দেহ নাই যে মানুষের পীড়া বলিতে কেবল কতগুলি লক্ষণকে বুঝায় এবং সেগুলিকে সদৃশ কৃত্রিম লক্ষণ উৎপাদনকারী ঔষধ এর সাহায্যে বিনষ্ট করিয়া স্বাস্থ্য ফিরাইয়া আনা যায় (প্রকৃত আরোগ্য বিধানের ইহাই পদ্ধতি), তখন আরোগ্যবিধান প্রণালীকে নিম্নলিখিত তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়-
১) আরোগ্য বিধান করিবার জন্য কি জানা আবশ্যক তাহা চিকিৎসক কি রূপে নির্ধারণ করিবেন?
২) প্রাকৃতিক ব্যাধিকে নিরাময় করিবার জন্য উপকরণসমূহের অর্থাৎ ঔষধের রোগ উৎপাদনকারী ক্ষমতা সম্বন্ধে কিভাবে জ্ঞানলাভ করা যায়?
৩) প্রাকৃতিক ব্যাধিসমূহকে দূর করিবার জন্য সেই সকল কৃত্রিম রোগ উৎপাদক বস্তুসমূহকে (ঔষধ) প্রয়োগ করিবার সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত পদ্ধতি কি?
#সূত্রঃ ৭২। রোগ দুই প্রকার ( অচির রোগ ও চির রোগ)-
অনুসন্ধানের প্রথম বিষয়টি সম্বন্ধে সাধারণভাবে নিম্নলিখিত প্রাথমিক আলোচনা করা যাইতেছে । মানুষ যেসব রোগে ভোগে সেইগুলি হয় অস্বাভাবিক বিশৃংখলাগ্রস্থ জীবনীশক্তির অসুস্থতাব্যঞ্জক দ্রুত প্রণালী- যাহার ভোগকাল কমবেশি অল্প সময়ের মধ্যে, কিন্তু সবসময়ই নিয়মিত সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় এবং সেই গুলিকে বলা হয় অচিররোগ অথবা সেগুলি এরূপ প্রকৃতির যে সামান্যভাবে ও প্রায় অজ্ঞাতসারে সূচনা লইয়া সূক্ষ্মভাবে দেহযন্ত্রকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে পীড়িত করে এবং ক্রমশ সুস্থ অবস্থা হইতে তাহাকে এইরূপভাবে বিচ্যুত করে যে, স্বয়ংক্রিয় জীবনীশক্তি- যাহার কাজ হইল স্বাস্থ্য বজায় রাখা- কেবল প্রথম এবং বিকশিত অবস্থায় সেগুলিকে অসম্পূর্ণ ও অযোগ্যভাবে ব্যর্থ প্রতিরোধ দিলেও নিজের চেষ্টায় তাহাদের ধ্বংসসাধন করিতে অসমর্থ হয় এবং অসহায়ভাবে তাহাদিগকে বর্ধিত হইতে দিয়া নিজেকে- যতদিন মৃত্যু না ঘটে- অধিকতর পীড়িত হইতে দিতে বাধ্য হয়। এই সকল পীড়াকে বলা হয় চিররোগ। তাহাদের উৎপত্তি ঘটে কোন চিররোগবীজের সূক্ষ্ম সংক্রমণ দ্বারা।
#সূত্রঃ ৭৩। অচির রোগের প্রকারভেদ-
অচিররোগসমূহ সম্বন্ধে বলা যায়, উহাএই ধরনের যে ব্যক্তিগতভাবে তাহা মানব কে আক্রমণ করে এবং তাহাদের উদ্দীপক কারণসমূহ হইল পারিপার্শ্বিক ক্ষতিকর প্রভাব। অতিভোজন কিংবা অতিস্বল্পাহার দেহের উপর যথেচ্ছাচার, ঠান্ডা লাগান, অত্যাধিক গরম লাগান, অসংযম, শুরু পরিশ্রম প্রভৃতি কিংবা দৈহিক উত্তেজনা, মানসিক উদ্বেগ বা ঐ প্রকার কোনকিছু অচির জ্বররোগসমূহের উদ্দীপক কারণ। বাস্তবিকপক্ষে সেইগুলি কেবল অন্তর্নিহিত সোরার সাময়িক স্ফুরণ ছাড়া আর কিছুই নহে। সেই এচিররোগগুলিয়খুব ভীষণ প্রকৃতির না হইলে এবং সেই গুলিকে শীঘ্র দমন করা গেলে সোরা আবার তাহার সুপ্ত অবস্থায় ফিরে যায় । অথবা সেইগুলি (অচিররোগসমূহ) এইরূপ ধরনের যে কতকগুলি লোক আবহাওয়া অথবা পার্থিব কারনে ক্ষতিকর বস্তুসমূহ দ্বারা একই সময়ে এখানে সেখানে (বিক্ষিপ্তভাবে) আক্রান্ত হয় । সেগুলির দ্বারা পীড়িত হইবার প্রবণতা এককালে অল্প কয়েকটি লোকের মধ্যে দেখা যায় । এই প্রকার সমজাতীয় আরও কতকগুলি ব্যাধি আছে যাহাদের দ্বারা একই কারণে এবং ঠিক অনুরূপ পীড়ায় অনেক লোক আক্রান্ত হইয়া থাকে (মহামারীরূপে) । এই সকল ব্যাধি ঘনবসতিযুক্ত স্থানে দেখা দিলে সাধারণত তাহা সংক্রামকরূপ ধারণ করে। তাহার ফলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং একই কারণ হইতে উদ্ভূত বলিয়া সকল পীড়িত ব্যক্তির একই প্রকার উপসর্গ আনয়ন করে এবং অচিকিৎসিত অবস্থায় থাকিলে একটা নিয়মিত সময়ের মধ্যে হয় রোগীর মৃত্যু ঘটে নতুবা রোগ সরিয়া যায় । যুদ্ধ, জলপ্লাবন ও দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি সঙ্কট প্রায়ই তাহাদের উদ্দীপক কারণ এবং উৎপাদনের হেতু। কখনও কখনও সেইগুলি এক বিশেষ ধরনের অচির রোগবীজ যাহা একইভাবে বারবার ফিরে আসে (সেই জন্য বিশেষ পরিচিতি কোন নামে খ্যাত) । তদ্দ্বারা জীবনে একবার মাত্র আক্রান্ত হয়, যেমন বসন্ত, হাম, হুপিংকাশি, সিডেনহামের পুরাতন মসৃণ রক্তবর্ণ স্কর্লেটজ্বর মাম্পস প্রভৃতি ।
#সূত্রঃ ৭৪। এলোপ্যাথিক ঔষধ সঞ্জাত চিররোগ সর্বাপেক্ষা উৎকট ও শোচনীয়-
হায়! চিররোগসমূহের মধ্যে এমন কতকগুলি রোগকে গণ্য করিতে হয় যেগুলি সাধারণত দেখা যায় এবং যেগুলি দীর্ঘকাল ধরিয়া এলোপ্যাথিক চিকিৎসার অধিক ও অধিকতর মাত্রায় প্রচন্ড ঔষধসকল ব্যবহারের ফলে উৎপন্ন হয়। ক্যালোমেল, করোসিভ সাবলিমেট, পারদঘটিত মলম, সিলভার নাইট্রেট, আয়োডিন এবং তাহার মলম, আফিম, ভ্যালেরিয়ান, সিঙ্কোনা ছাল এবং কুইনিন, ফক্সগ্লোভ, প্রুসিক অ্যাসিড, সালফার ও সালফিউরিক অ্যাসিড, নিত্য ব্যবহৃত বিরেচকসমূহ, শিরাকর্তন, রক্তমোক্ষণ, জোক লাগান, কৃত্তিম ক্ষত প্রভৃতি কুফলে ঐ প্রকার রোগের উৎপত্তি ঘটে এবং যার দ্বারা জীবনীশক্তিকে কখনও কখনও নির্দয়ভাবে বলহীন করা হইয়া থাকে এবং ইহা একেবারে অভিভূত না হইলে এরূপভাবে পীড়িত হইয়া পড়ে (প্রত্যেকটি পদার্থের বৈশিষ্ট্য অনুসারে) যে, ঐ সকল বিরুদ্ধ ও হানিকর আক্রমণ হইতে বাচার জন্য দেহাভ্যন্তরে অবশ্যই একটি বিদ্রোহের সৃষ্টি করে এবং হয়না কোন অংশ হইতে উত্তেজনা ও অনুভবশক্তি হরণ করে বা অতিমাত্রায় তাহা বর্ধিত করে, কোন অংশকে প্রসারিত বা সংকুচিত করে, শিথিল বা শক্ত করে, এমনকি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ও বাহিরে বা ভিতরে ত্রুটিপূর্ণ যান্ত্রিক পরিবর্তন আসে (দেহের বাহির ও ভিতর অকর্মণ্য করিয়া দেয়); আর তাহা করে ঐ সকল ধ্বংসাত্বক শক্তির নিত্য নব বিরুদ্ধ আক্রমণ দ্বারা সম্পূর্ণ বিনাশের কবল হইতে জীবনকে রক্ষা করিবার জন্য।
#সূত্রঃ ৭৫। অ্যালোপ্যাথির অনারোগ্যদায়ক প্রথায় (বিশেষ করে বর্তমান সময়ে) মানুষের স্বাস্থ্যের উপরে এইরূপ ক্রমাগত আক্রমণ সকল প্রকার রোগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শোচনীয় ও অসাধ্য। দুঃখের সহিত আমি আরও বলি যে, তাহাদের খুব বাড়াবাড়ি অবস্থায় আরোগ্যবিধানকল্পে কোন ঔষধ নির্ধারণ বা নির্বাচন করা স্পষ্টত অসম্ভব।
#সূত্রঃ ৭৬। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক রোগের জন্য দয়াময় ঈশ্বর হুমিওপেথির ভিতর দিয়া আরোগ্য বিধান করিয়াছেন। কিন্তু মানুষ্যদেহের বাহিরে ও ভিতরে বৎসরের পর বৎসর অবিরাম-ভাবে ঐ সকল ক্ষতিকর ঔষধ দিয়ে চিকিৎসার দ্বারা যে ধ্বংস ও বিকৃতি সাধিত হয় তাহার সহিত প্রতিকার জীবনে শক্তিকেই করিতে হইবে (ভিতরে যদি কোন চিররোগবীজ লুকাইয়া থাকে তাহা নির্মূল করবার জন্য যথোপযুক্ত সাহায্য দেওয়া প্রয়োজন) ইহা সম্ভব, যদি জীবনীশক্তি ঐরূপ ক্ষতিকর ক্রিয়ার পূর্ব হইতেই অত্যাধিক দুর্বল হইয়া না পড়িয়া থাকে এবং কতিপয় বৎসর অবাধে এই বৃহৎ কার্যকরী বার অবসর পায়। অনারোগ্য দায়ক এলোপ্যাথিক চিকিৎসা হইতে প্রায়শ উৎপন্ন ঐসকল অসংখ্য বিপর্যস্ত অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরাইয়া আনার জন্য মানুষের আয়ত্তাধীন এ কোন চিকিৎসা নাই এবং থাকিতে পারে না।
#সূত্রঃ ৭৭। পরিহার্য দূষণীয় প্রভাবসমূহ এর অধীনে ক্রমাগত থাকিয়া লোকে যে রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহাকে অযথা চিররোগ আখ্যা দেয়া হয়। অনিষ্টকর মদ্যাদি বা খাদ্যে আসক্ত হইয়া, স্বাস্থ্যনাশকারী বিভিন্ন প্রকার অসংযত আচরণের লিপ্ত হইয়া, জীবনধারণের প্রয়োজনীয় বস্তু সমূহ হইতে সুদীর্ঘকাল বঞ্চিত থাকিয়া, অস্বাস্থ্যকর স্থানে বিশেষত জলাজমিতে, গুহা বা আবদ্ধ গৃহে বাস করিয়া, ব্যায়াম ও মুক্তবাতাস বর্জন করিয়া, শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের স্বাস্থ্য নষ্ট করিয়া, সর্বদা মানসিক দুশ্চিন্তায় কাটাইয়া এই প্রকার ব্যাধি উৎপন্ন হয়। যদি কোন চিররোগবীজ দেহের ভিতর লুকাইয়া না থাকে তাহা হইলে এই প্রকার স্বকৃত অসুস্থ অবস্থা, উন্নততর জীবনযাপন আরম্ভ করিলে, আপনাআপনি দূরীভূত হয় ও তজ্জন্য সেগুলিকে চিররোগ বলা যায় না।
#সূত্রঃ ৭৮। যথার্থ প্রাকৃতিক চিররোগ সেই গুলিকে বলা হয় যাহা কোন চিররোগবীজ হইতে উৎপন্ন এবং যাহা যথোপযুক্ত ঔষধ দিয়া না সরাইলে দৈহিক ও মানসিক সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা সত্ত্বেও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং ক্রমাবনতির পথে চলে অধিকতর যন্ত্রণা দিয়া রোগীকে সারাজীবন কষ্ট দেয়। কচি কিৎসা হইতে উৎপন্ন পীড়াসমূহ (৭৪ সূত্র) বাদ দিলে এইগুলি সর্বাপেক্ষা অধিক ও মনুষ্যজাতির সর্বাপেক্ষা বড় শত্রু। কেননা, বলিষ্ঠ দেহ, নিয়মনিষ্ঠ জীবনযাপন ও জীবনীশক্তির সতেজ ক্রিয়াশীলতা তাহাদিগকে নির্মূল করতে অক্ষম।
#সূত্রঃ ৭৯। সিফিলিস ও সাইকোসিস প্রকৃত চিররোগবীজ-
এখন পর্যন্ত সিফিলিসকেই কিছুটা চিররোগবীজোৎপন্ন বলিয়া ধরা হইয়াছে, যাহা অচিকিৎসা অবস্থায় থাকলে জীবনের সমাপ্তির সঙ্গে শেষ হয়। অর্বুদযুক্ত সাইকোসিস ( প্রমেহ) ঠিক একইভাবে উপযুক্ত ঔষধ দ্বারা চিকিৎসা ব্যতীত যাহাকে নির্মূল করা যায় না—-নিঃসন্দেহে চিররোগবীজজাত একটি বিশিষ্ট ব্যাধি হইলেও তাহা স্বীকৃত হয় নাই। চিকিৎসকগণ চর্মের উপরকার উদ্ভিদগুলি নষ্ট করিয়াই মনে করিতেন যে তাহারা আরোগ্যদান করিয়াছেন, কিন্তু রোগজনিত ঋতুদোষের একগুঁয়েমিতা তাহাদের দৃষ্টি এড়াইয়া যাইত।
#সূত্রঃ ৮০। সিফিলিটিক ও সাইকোটিক রোগ ব্যতীত সকল প্রকৃত চিররোগের জননী সোরা-
এইমাত্র যে দুইটি চিররোগবীজের কথা বলা হইল তাহা অপেক্ষা চিররোগে সোরাবীজের প্রাধান্য ও গুরুত্ব সহস্রগুণ বেশি। পূর্বোক্ত দুইটি তাহাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুসারে ধাতুদোষ প্রকাশ করে, একটি যৌনক্ষত দ্বারা, অন্যটি ফুলকপির ন্যায় অর্বুদ উৎপন্ন করিয়া। সোরাবীজও সমগ্র দেহে সংক্রামিত হওয়ার পরে এক প্রকার বিশেষ চর্মোদ্ভেদের ভিতর দিয়া আত্মপ্রকাশ করে। কখনও সেগুলি ফোস্কাজাতীয় এবং তাহার সঙ্গে থাকে আরামদায়ক সুড়সুড়িযুক্ত অসহ্য চুলকানি (এবং একপ্রকার বিশেষ গন্ধ )। এই ভয়ঙ্কর অভ্যন্তরীণ চিররোগবীজ সোরা বিভিন্ন প্রকার অগণিত পীড়ার একমাত্র প্রকৃত মূলকারণ এবং জনক। এই সকল রূপ রীতি সম্মত নিদানশাস্ত্রসমূহে স্নায়ুদৌর্বল্য, হিস্টিরিয়া, চিত্তোন্মাদ, পাগলামি, বিষণ্নতা, জড়বুদ্ধি, মৃগী ও নানাবিধ তড়কা, র্যাকাইটিস, মেরুদন্ড সংক্রান্ত রোগ, অস্থিক্ষত, ক্যান্সার, গেঁটেবাত, অর্শ, ন্যাবা, নীলরোগ , শোথ, রজঃরোধ, পাকস্থলী নাসিকা ফুসফুস মূত্রাশয় ও জরায়ু হইতে রক্তস্রাব, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্ষত, ধ্বজভঙ্গ ও বন্ধ্যাত্ব, আধকপালে, বধিরতা, ছানি অন্ধতা, মূত্রপাথরি, পক্ষাঘাত, ইন্দ্রিয়াদির অকর্মণ্যতা এবং সহস্র প্রকারের ব্যথা-বেদনা প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ স্বতন্ত্র রোগরূপে পরিচয় পাইয়াছে।
#সূত্রঃ ৮১। শতশত বংশপরস্পরায়, লক্ষলক্ষ মানবদেহের ভিতর দিয়া সঞ্চালিত হইয়া অতি প্রাচীন এই সংক্রামক রোগের এইভাবে বিশ্বাসাতীত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আমাদিগকে বুঝাইয়া দেয় মানুষ্য পরিবারের এখন তাহা কত অসংখ্য প্রকারের পীড়া সৃষ্টি করিয়াছেন; বিশেষত যখন আমরা চিন্তা করি, বংশগত ধাতুপ্রকৃতি সংবলিত মানবগোষ্ঠীর বর্ণনাতীত বৈচিত্র ছাড়াও কত বিভিন্ন অবস্থা এই প্রকার নানা চিররোগসমূহ ( সোরার গৌণ লক্ষণসমূহ) সৃষ্টি করার জন্য দায়ী। সুতরাং এইরূপ ক্ষতিকর বিভিন্ন কারণসমূহ সোরাবীজাক্রান্ত বিভিন্ন মানবদেহের উপর প্রকাশ করিয়া যদি অসংখ্য প্রকারের বিকৃতি, ক্ষতি, বিশৃংখলা ও যন্ত্রণা লইয়া আসে তাহা হইলে বিষ্মেয়ের কিছু নাই। পুরাতন নিদান গ্রন্থসমূহে এই সকলকে এযাবৎকাল বিশেষ বিশেষ নাম দিয়া প্রত্যেকটিকে স্বতন্ত্র ব্যাধি বলিয়া ধরা হয়েছে।
#সূত্রঃ ৮২। সোরাঘটিত চিররোগের ঔষধ নির্বাচন-
যদিও চিররোগসমূহের প্রধান উৎপত্তিস্থল নির্ণয় এবং সোরার চিকিৎসার জন্য অমোঘ হোমিওপ্যাথিক ঔষধসমুহ আবিষ্কারের সঙ্গে চিকিৎসা প্রণালী, চিকিৎসিতব্য অধিকাংশ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের সীমানার মধ্যে আসিয়া পৌঁছিয়াছে তবুও প্রত্যেকটি চিররোগে ( সোরাজাত ) আরোগ্যদান করিবার জন্য ঔষধ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে লক্ষণ ও বিশেষত্বগুলি সাবধানে সংগ্রহ করার কাজ উক্ত আবিষ্কারের পূর্বের ন্যায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পক্ষে এখনো অপরিহার্য। কারণ, এই রোগ কিংবা অন্য রোগের প্রকৃত আরোগ্যবিধান যথানিয়মে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তিগত বিশেষত্ব নির্ণায়ক চিকিৎসা ব্যতীত সম্ভব হয়না। এই অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে- রোগ কখনো অচির ও দ্রুতগতিতে বাড়িয়া উঠে এবং কখনো তাহা ধীর গতিতে চলিতে থাকে (চির)- এই পার্থক্য নির্ণয় করিতে হইবে। এরূপ দেখা যায় যে, অচির রোগে প্রধান লক্ষণসমূহ অপেক্ষাকৃত দ্রুত আমাদের কাছে ধরা দেয় এবং আমাদের অনুভবে আসে, সেইজন্য রোগের চিত্র অঙ্কন করিতে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে এবং সেইজন্য কয়েকটি অল্প প্রশ্ন করিলেই চলে কারণ সবটাই আপনা হইতেই প্রকাশমান । সেই তুলনায় চিররোগ কয়েক বৎসর ধরিয়া ক্রমবর্ধমানভাবে চলিতে থাকে বলিয়া লক্ষণসমূহ সংগ্রহ করা অধিকতর কষ্টসাধ্য।