সত্যের সন্ধানে হ্যানিম্যান

১৭৫৫ সালের ১০ এপ্রিল জার্মান দেশের অন্তর্ভুক্ত মিশন নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রামে খুবই দরিদ্র পরিবারে স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের জন্ম হয়। প্রতিটি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি জন্ম সূত্রেই মেধাবী, প্রতিভাবান হয়ে থাকেন। সেটা বোঝা যায় তাঁর জীবন ধারার মধ্য দিয়ে। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি গ্রিক ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিলেন। অন্যান্য ছাত্রদের তিনি গ্রিক ভাষা শিক্ষা দিতেন। সেই কারণে তিনি পাঠশালার শিক্ষক ‘মাস্টার মুলারের’ অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। এ সময় হ্যানিম্যানের পিতা ক্রিস্টিয়ান গটফ্রায়েড দারিদ্র্যবশত তাঁর লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে মাস্টার মুলার অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং নিজে তাঁর লেখাপড়ার ব্যয়ভার গ্রহণ করেন।

পাঠশালার পাঠ শেষ করে ১৬ বছর বয়সে তিনি মিসন বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ সময় তাঁর পিতা বার বার চেষ্টা করেন তাঁর লেখাপড়া বন্ধ করে তাঁকে অর্থ রোজগারে কাজে লাগানোর জন্য। কিন্তু বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হ্যানিম্যানের সাহায্যে এগিয়ে আসায় তিনি ছাত্র হিসেবে টিকে যান।

হ্যানিম্যানের বয়স যখন ২০ বছর তখন তিনি বিভিন্ন ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। ২৪ বছর বয়সে এনলার্জেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘এমডি’ ডিগ্রি লাভ করেন এবং চিকিত্সা বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হন।

দীর্ঘ পাঁচ বছর তিনি ওই পেশায় নিযুক্ত থেকে লক্ষ্য করেছেন প্রচলিত চিকিত্সা পদ্ধতি অনুযায়ী চিকিত্সায় রোগ আরোগ্যের পরিবর্তে যন্ত্রণাসহ অন্যান্য নানা কষ্ট এবং ওষুধের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বহু রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটছে। তিনি মেনে নিতে পারলেন না। ১৭৮৪ সালে চিকিত্সাবৃত্তি ত্যাগ করে আবার অনুবাদের কাজে মন দিলেন। এ সময় থেকে স্ত্রী পুত্রসহ অর্থ সঙ্কটে পড়লেন। তবু আর চিকিত্সা বৃত্তি গ্রহণ করলেন না।

১৭৯০ সাল। বিশিষ্ট চিকিত্সক ডা. কালেনের মেটিরিয়া মেডিকা অনুবাদ করার সময় তত্কালীন পালাজ্বরের (বর্তমান ম্যালেরিয়া) বিশেষ ওষুধ হিসেবে ‘পেরুতিয়ান বার্ক’ (বর্তমানে সিঙ্কোনা বা কুইনাইন নামে পরিচিত) সম্বন্ধে ডা. কালেন সাহেবের ব্যাখ্যায় তার মনে কৌতূহল এবং সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হয়। তখন তিনি সিঙ্কোনোর ছালের নির্যাস তৈরি করে প্রায় ৫ ড্রামের মতো খেয়ে নিলেন। কয়েক দিন পর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হলেন। তখন তিনি চিন্তা করলেন যে, ভেষজ যে কৃত্রিম রোগ লক্ষণ উত্পন্ন করতে সক্ষম, ভেষজ ওই একই লক্ষণ সম্পন্ন রোগ আরোগ্য করতে সক্ষম। জন্ম হল হোমিওপ্যাথির। হোমিওপ্যাথি মানে সমবিধান মতের চিকিত্সা।

এরপর এ নিয়মে, সুস্থ দেহে তার ও বন্ধুবর্গের মধ্যে নানা প্রকার ভেষজের পরীক্ষা করতে আরম্ভ করলেন। রোগীদের ওষুধ দিয়ে পর্যবেক্ষণ চলতে থাকল। এভাবে গবেষণা চালাতে থাকলেন। তখন তিনি কোনিভাশ্লটার নগরে বাস করছিলেন। ১৭৯৩ সালে হের ক্লকিং ব্রেং নামে এক ভদ্রলোক উন্মাদ রোগে ভুগছিলেন। তত্কালীন চিকিত্সায় কোনো উপকার না হওয়ায় বাড়ির লোকেরা হ্যানিম্যানের নিকট আসেন এবং ভদ্রলোক আরোগ্য লাভ করেন। ১৭৯৬ সালে ওই স্থানে স্কার্লেট ফিভারের এক মহামারি দেখা দেয়। এ রোগে আক্রান্ত বহু রোগীকে বেলেডোনা নামক ওষুধের সাহায্যে তিনি আরোগ্য করেন।

তাঁর গবেষণার কাজ একটি সঠিক পথে এগুচ্ছে বুঝতে পেরে ডা. হিউফল্যান্ড সম্পাদিত ‘জার্নাল ফর দি প্রাকটিসিং ফিজিশিয়ান’ নামের পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। যার নাম ছিল ‘অন এ নিউ প্রিন্সিপাল ফর অ্যাসারটেইনিং দি কিউরেটিভ প্রপারটিস অফ ড্রাগস।’ এ প্রবন্ধে ৬০টি ওষুধের ক্রিয়া এবং বিভিন্ন প্রকার রোগ আরোগ্যের শক্তি সম্বন্ধে উল্লেখ করেন। ওই প্রবন্ধে তিনি এ অভিমত প্রকাশ করেন যে, হোমিওপ্যাথি মতের চিকিত্সা সঠিক, যুক্তিযুক্ত, বিজ্ঞানসম্মত ও কালোপযোগী।
ধীরে ধীরে হোমিও চিকিত্সার সাফল্য প্রচার হতে লাগল। এ কারণে ওষুধের প্রয়োজনীয়তা বাড়ল। হ্যানিম্যান তখন ওষুধ প্রস্তুত করে বিক্রি করতে থাকেন। তাঁর চিকিত্সা এবং গবেষণার সফলতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তার ফলে ওই অঞ্চলের ঔষধ প্রস্তুতকারকদের ওষুধের ব্যবসার ক্ষতি হতে থাকে। ওষুধ প্রস্তুতকারকরা বেআইনি ওষুধ তৈরির দায়ে হ্যানিম্যানকে তাড়িয়ে দিল শহর থেকে। এমন দুর্ঘটনা মহান এ বিজ্ঞানীর জীবনে বহুবার ঘটেছে, তবু গবেষণার কাজ তিনি বন্ধ করেননি। তারপর আজ প্রায় ২১৩ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।
হ্যানিম্যান ওই যুগে গবেষণাকালে রোগ সংক্রমণ সম্বন্ধে এ অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, অতি সূক্ষ্ম এক প্রকার রোগাত্পাদিকা শক্তির দ্বারা বিভিন্ন প্রকার রোগ সংক্রমণ হয়ে থাকে। অতি সূক্ষ্ম রোগ শক্তির প্রতিকারের জন্য প্রয়োজনবোধ করলেন শক্তিশালী ওষুধের। সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম শক্তিসম্পন্ন ওষুধ তৈরির তথ্য আবিষ্কার করলেন। প্রত্যক্ষ করলেন, এ ওষুধ দ্বারা রোগীর রোগ আরোগ্য হয়। রোগীদের দ্রুত ও স্থায়ীভাবে সুস্বাস্থ্য লাভ করতে দেখলেন তখন তিনি অভিমত দিলেন, উপযুক্তভাবে এ ওষুধ প্রয়োগে সকল প্রকার রোগের চিকিত্সা ও দ্রুত নিরাময় সম্ভব, যা আমরা আজ প্রত্যক্ষ করছি।

নদীর পানি যেমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, বিজ্ঞানও তাই। আজ ‘জিন’ গবেষকরা দাবি করছেন, মানুষের বহু প্রকার রোগ বংশগতভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে। যার প্রভাব জিনের মধ্যে পুরুষাক্রমে নিহিত আছে। যার ক্রমবিকাশ নানা রোগের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। হ্যানিম্যান এ প্রকার রোগ হওয়ার মূলে, মানব শরীরে নিহিত এক প্রকার বিষের প্রভাবের কথা বলেছেন। যা দীর্ঘকাল ধরে পুরুষানুক্রমে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নানা প্রকার জটিল রোগের সৃষ্টি করে থাকে। এ রোগ প্রবাহের বিষকে তিনি এক কথায় সোরা মায়া জাম নামে চিহ্নিত করেছেন। তিনি জটিল রোগ চিকিত্সার সময় বংশ ইতিহাস ও রোগীর আচার-ব্যবহার ও জীবন ধারার প্রতি বিশেষভাবে নজর দিতে বলেছেন।
আজও আমরা শ্রদ্ধেয় এ বিজ্ঞানীর সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি। বুঝে উঠতে পারিনি তাঁর গবেষণার প্রকৃত তাত্পর্য। তবু এ কথা সত্য, সঠিক হোমিও চিকিত্সায় রোগী যেমন দ্রুত সুস্বাস্থ্য লাভ করে, তেমনি ক্রমাগত ভুল চিকিত্সায় রোগী আরোগ্যের বাইরে চলে যায়। জটিল হয়ে পড়ে রোগের গতি-প্রকৃতি।
রোগীর মধ্যে শক্তিকৃত হোমিও ওষুধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অবশ্য লক্ষ্য করা সম্ভব। যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বৈজ্ঞানিক সত্য। যার সঠিক মূল্যায়ন এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
পর্যবেক্ষণশীল চিকিত্সক এবং গবেষকদের কাছে এ বৈজ্ঞানিক সত্য অবশ্যই প্রকাশ হয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে মহান এ বিজ্ঞানীর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং তথ্যসমূহ।

জীবনের শেষ মুহূর্তে ১৮৪৩ সালের ২ জুলাই রাতের অন্ধকার ছেদ করে প্রভাকর যখন ক্রমেই প্রস্ফুটিত হচ্ছিল, প্রাণত্যাগের পূর্বমুহূর্তে এ বিজ্ঞানী প্রিয়জনদের ধীরে ধীরে বলেছিলেন ‘আমার জীবন বৃথা যায়নি’।